শ্রীচরণেষু দাদা: ১২


অরুণের জীবনে শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়।
ঢাকা শহরে বেঁচে থাকার এক নতুন লড়াই। অরুণের কাছে মনে হলো এ যেন এক নতুন ভোরের দ্যুতি। এই নতুন ভোর তার হৃদয়ে হঠাৎ করেই যেন এক নতুন আশার আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। কি শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তই না ছিল গতকাল পর্যন্ত। কিন্তু আজকের সকালটা কেমন জানি একটু অন্যরকম। আনন্দময়, সোনালী সূর্যের প্রথম বিচ্ছুরিত কিরণ চোখে-মুখে আছড়িয়ে পড়ার মতো সুখকর। গতকালের দুঃস্বপ্ন যেন আজ কেটে গেছে। সে বুঝতে পারলো, আর কোনো দুঃস্বপ্ন, অতীতের কোন কষ্ট তার সামনে এগিয়ে চলার পথকে আর আটকাতে পারবে না। আজ সকাল থেকে যে পথটার সূচনা হয়েছে সেটা শুধু নতুন সম্ভাবনার, নতুন আশার এবং আলোকিত ভবিষ্যতের। তার কাছে অতীত এখন মৃত। পেছনে ফিরে দেখার কোনো সময় নেই। প্রতিটি মুহূর্ত যেন তাকে এক নতুন চ্যালেঞ্জের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আর সে জানে, এই মুহূর্তগুলোই তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষার মুহূর্ত।
অরুণ বুঝে ফেলেছে—সে আর সেই সহজে ভয় পেয়ে যাওয়া গ্রাম্য বালক নয়। যে মেঠো পথে পা বাড়াতেই বুক ধড়ফড় করত, বাঁশবনের পাতার ফিসফিস শব্দেই যার গা ছমছম করত—সে ছেলেটি আজ ইতিহাস। এখন সে ঢাকায়, কংক্রিটের বুকে ধুন্ধুমার এক শহরে। এখানে ভয় মানে পিছিয়ে পড়া, দুর্বলতা মানেই বিসর্জন। বোকাদের এ শহর কখনোই কদর করে না—কলার খোসার মতোই ছুড়ে ফেলে দেয়। যারা কলার শাঁস দাঁতে চেপে, জিহ্বায় মেখে মজা নিতে জানে—এই শহর কেবল তাদেরই আপন করে নেয়।
তাই সমস্ত দ্বিধা, হতাশা ও ব্যর্থতা পেছনে ফেলে, সে সাহসের সঙ্গে এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়িয়েছে। তার চোখে এখন শুধুই একরকম দৃঢ়তা—এক নতুন পৃথিবী, যেখানে কোনো কিছুই অনিশ্চিত নয়। এই নতুন পথে, অজানা যাত্রায়, তার সঙ্গী হবে তার আত্মবিশ্বাস। আর এই যাত্রার শুরুটা হলো তার প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গেই। আসলাম আর তমাল। সত্যিই অবাক লাগছে। পর কেমনি আপন হয়ে যায়। দাদিমার মুখে ছোটকালে অনেকবার শুনেছে একটি কথা। দাদিমা বলতেন-“আপনার থেকে পর ভালা, পর থেইক্যা জঙ্গল ভালা।“ এই দুইজনের সাথেই প্রথম রাতের শেষে চোখ খুলতেই সাক্ষাৎ হয়। একেবারেই অচেন। তারাই অরুণকে একা পেয়েও যখন সে একেবারে হারিয়ে যেতে বসেছিল, কোন ক্ষতি না করে বরং সেই মুহূর্তে সাহস ও ভালোবাসা দিয়েছিল। তারা যেন তার জীবনযাত্রার সহযাত্রী। তাদের হাত ধরে সে এগিয়ে যাবে, তাদের সহায়তায় নতুন আকাশের দিকে পাড়ি দেবে।
এই নতুন জীবন, এই নতুন সকাল, সত্যিই হয়তো সহজ হবে না। অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে, নানা ঝঞ্ঝাট, বাধা ও প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু অরুণ ঠিক করেছে—এবার সে থামবে না। প্রতিটি পদক্ষেপে সে শিখবে, ভুলে যাবে, আবার নতুন করে শুরু করবে। তার চোখে এখন শুধু এক দৃঢ় সংকল্প—অন্যদের মতো না হলেও, সে নিজের মতো করে চলবে, এবং এই যাত্রায়, এই সংগ্রামে, একদিন সে সফল হবে, কোনো না কোনো ভাবে।
গতকাল সারাদিন হন্যে হয়ে ঘুরেও কিছুই হলো না। একেবারে হতাশ হয়ে পড়েছল। তবু আজ সকাল থেকেই তার মনটা হালকা লাগছিল। যেন এক অদৃশ্য আশার আলো তার ভিতরটাকে আলতো করে ছুঁয়ে গেছে। অদৃশ্য কোনো ভালবাসার অবয়ব, যেন এক স্বপ্ন-মেদুর মানবী, নিঃশব্দে এসে কপালের গভীরতায় চুম্বন এঁকে রেখে গেছে গত রাতে—এক অপার্থিব মমতার ছোঁয়া, যাকে ছুঁয়ে দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায় হৃদয়ের গোপনতম অলিন্দে। অরুণ ভাবল—ভাগ্য বুঝি একটু সহানুভূতিশীল হয়েছে। না হলে হঠাৎ করেই চাচার সঙ্গে এমন অদ্ভুতভাবে দেখা হবে কেন? সেই বস্তির ভাঙা দালানে রাত কাটানো, তারপর সকালবেলা আসলাম আর তমালের সঙ্গে আকস্মিক দেখা—সবটা যেন পূর্বনির্ধারিত কোনো গল্পের মতো।
এই ঘটনাগুলোর ভেতর অরুণ খুঁজে পেল এক ক্ষীণ সম্ভাবনার রেখা। হয়তো তা খুব দৃশ্যমান নয়, কিন্তু অনুভবে স্পষ্ট। ধীরে ধীরে সে বুঝতে শিখেছে—জীবন শুধু আশার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না। তাকে এগিয়ে নিতে হয় বাস্তবতার কাঁধে ভর দিয়েই। স্বপ্ন একা কিছু করে না, তাকে রক্ষা করতে হয় পরিশ্রম আর সিদ্ধান্তে।
তাই অরুণ স্থির করল—এ মুহূর্তে যে সামান্য সুযোগ তার সামনে এসেছে, তাকেই আঁকড়ে ধরতে হবে। পান-সিগারেট বিক্রি—এই কাজকে অনেকে তুচ্ছ মনে করলেও, অরুণ তা ভাবে না। সে তো চুরি করছে না, কারও ক্ষতি করছে না। কেবল বাঁচার তাগিদে সে নেমেছে নগরের নির্দয় জীবন-যুদ্ধে। এই লড়াইয়ে কোনো কাজই ছোট নয়—শুধু দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আছে। বন্ধুদের সঙ্গেই শুরু করবে পান-সিগারেট বিক্রির কাজ। রোদ, ধোঁয়া, ক্লান্তির ভেতর থেকেও সে খুঁজে নিচ্ছে নিজের পায়ের তলার মাটি। এখান থেকেই সে শুরু করতে চায়—নিজের মতো করে, নিজের শ্রমে, একটুখানি জায়গা দাঁড়িয়ে থাকার।
অরুণের হাতে ছিল মাত্র পঞ্চাশ টাকা—তার পৃথিবীর শেষ সম্বল। টাকার অঙ্কে সেটা খুব বেশি নয়, কিন্তু সেই টুকরো কাগজে গেঁথে ছিল তার সমস্ত আশা, ভয়, নির্ভরতা। সে জানত, যদি এই টাকাটা শেষ হয়ে যায়, আর এই পান-বিড়ি-সিগারেটের‘ব্যবসা’টা না চলে—তাহলে সামনে শুধু অনিশ্চয়তা আর অন্ধকার। ঘরে ফেরার কোনো রাস্তা নেই। এই অচেনা শহরে বন্ধু বলতে আসলাম আর তমাল। তাও মাত্র এক দিনের পরিচয়। কিন্তু বন্ধুদের পাশে থাকাও তো শর্তহীন নয়—সময় গড়ালে কে কোথায় থাকবে, বলা যায় না।
এই টাকাটুকুর ওপর ভর করেই শুরু হলো অরুণের জীবনের এক নতুন অধ্যায়। ছয় টাকা খরচ করে কিনল পুরনো এক কাঠের পানের বাক্স, আর বিশ টাকা দিল আগাম—তাতে মিলল কিছু পান, সাদা শোলা, দেশি সিগারেট, সস্তা বিড়ি, কিছু ম্যাচ আর অল্প একটু জর্দা। দোকান না, বলা চলে একটা অবস্থান—জীবনের প্রথম অবস্থান।
জায়গাটা গুলিস্তান বাস স্ট্যান্ডের ফুটপাতে—চির-ব্যস্ত এক কোণ, পেছনে ধুলো মাখা ভাঙাচোরা দেয়াল, পাশে রিকশাওয়ালার কোলাহল, আর পথচারীর ছুটে চলা ভিড়।
অরুণ বসে পড়ল নিজের ছোট্ট ঘরের মতো করে, মাটির ওপর বাক্স বিছিয়ে। বুকের ভিতর কেমন এক অনামা কাঁপুনি। যদি আজ কেউ না আসে? যদি কেউ না থামে তার সামনে? যদি কারও দরকারই না হয় তার কাছে কিছু কেনার? প্রশ্নগুলো তীক্ষ্ণ কাঁটার মতো বিঁধে বুকের মধ্যে। তবু নিজেকে বোঝায়—ঢাকার এই ভিড়ে কেউ না কেউ তো একখানা পান নেবেই, কেউ একটা বিড়ি তো কিনবেই, সিগারেট তো কেউ একটা ধরাবেই!
কিন্তু সে জানে, এ লড়াই কেবল টাকার নয়। এটা তার অস্তিত্বের লড়াই। এই বাক্সটা যদি চলে, তাহলে হয়তো অরুণ একটু মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে, অন্তত খাওয়ার মতো কিছু জুটবে, একটু নিজের মতো করে বাঁচা যাবে। আর যদি না চলে—তাহলে? তাহলে আর কিছুই থাকবে না। চোখের পাতার গহ্বরে ধরা দেয় মায়ের মুখ—সমস্ত ক্লান্তি আর মমতার প্রতিচ্ছবি হয়ে। ভেসে ওঠে ছোট বোনের ফ্যালফ্যালে চোখ, তার কান্না যেন নিঃশব্দে কাঁপিয়ে দেয় হৃদয়ের অন্তঃপুর। চোখের কোণে ফুটে ওঠে ছোট ছোট ভাইদের বিবর্ণ মুখগুলো, যেন অনাহার আর উদ্বেগে ধূসর হয়ে যাওয়া শৈশব। আর দূরে, এক অসীম বেদনায় স্থির হয়ে থাকে বাবার মুখ—নিরুপায়, নিঃশব্দ, অথচ সমস্ত যন্ত্রণার ভার বুকে বয়ে চলেছে নির্বাক সহিষ্ণুতায়। আর নিজেরই ছিঁড়ে যাওয়া একটা অতীত—যেখানে ছিল বই, ছিল স্বপ্ন, ছিল আগুনে পোড়া সম্ভাবনার এক ভবিষ্যৎ। এখন সব সরে গিয়ে হাতে রইল একটা কাঠের বাক্স আর কিছু টুকরো জিনিস। অথচ সেগুলোই তার বেঁচে থাকার হাতিয়ার।
সে চায়, প্রতিদিন অন্তত একটা সকাল তাকে আশ্বস্ত করুক—
“তুই পারবি, অরুণ। তুই পারবি।”
অরুণ সেদিন পুরো সকাল এবং দুপুরটাই বসে ছিল, কিন্তু তেমন কিছু বিক্রি হয়নি। রোদের তাপে চোখে ঝাপসা হয়ে আসছিল, আর শরীর একেবারে মুচড়ে যাচ্ছিল। ফুটপাতের এক কোণে, গুলিস্তানের ভিড়ে, সে একদিকে যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। বিকেলের দিকে, পায়ের নিচে মাটির টুকরো থেকে যেন আর কোনো শক্তি আর পাওয়া যাচ্ছিল না। ঠিক তখন, একজন কলেজ ছাত্র তার দিকে এগিয়ে এসে সিগারেট চাইলো। “স্টার আছে? এক প্যাকে। একটি পানও দাও। জর্দা, খয়ের দিও না।“
অরুণের বুকটা এক মুহূর্ত থেমে গেল, যেন স্বপ্ন বাস্তব হয়ে দাঁড়ালো। তার হাত থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর পানটি নিতে নিতে, ছাত্রটি এক টাকার দুটি নোট দেয়, অরুণের অজানা হাত যেন কাগজের টাকা দটিকে সঠিকভাবে ধরতে পারছিল না। পকেট থেকে খুচরা পয়সা বেড় করে ৮০টি পয়সা ফেরত দিতে গেলেই ছেলেটি চোখ দিয়ে ইশারা দিতে দিতে বললো-“তুমি রেখে দাও। “
এ বলেই ছাত্রটি চলে গেলো। অরুণ মুখ খুলে কিছুই বলতে পারলো না। অবাক হয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকলো। মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করতে থাকে অরুণের। এটাই তার প্রথম বিক্রি, তার প্রথম অর্জন। আশি পয়সা বকশিস? অনুভূতিটা যেন আকাশ ছুঁয়ে যায়। হয়তো সারা দিনের কষ্ট, ক্লান্তি, আশঙ্কা, সবকিছু একসাথে যেন মিলিয়ে গেল সেই ছোট্ট হাসির মধ্যে। তার মনে মনে বলে—“এটাই তো শুরু।”
বিক্রির পর তার মনে হয়, "এই শহর, এই রাস্তা, আমাকে অযথাই ভয় দেখাচ্ছে না, আমি যদি চেষ্টা করি, কিছু না কিছু তো হবে।"
তার পর মনে পড়লো আসলামের গলার হাঁক। এই নাকি ফেরিওয়ালাদের স্টাইল। “এই যে মিয়া ভাইরা একখানে মাল আছে, একদম খাসা! পান চাইলে রস দিয়া দিমু, সিগারেট লাগলে আগুন দিমু!”-এই ভাবেই আসলাম চীৎকার করে লোক জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো।
এবার অরুণ উঠে দাঁড়ালো। গলায় বাক্সটা মজবুত করে ঝুলিয়ে নিলো। রোদে পোড়া পিচ-ঢালা রাস্তায় ছায়ার মতো হাঁটতে হাঁটতে সে আচমকা এক গাঢ় সুরে ডাক ছাড়লো, যেন তার কণ্ঠই শহরের ধ্বনির মাঝে এক নতুন সঙ্গীত:
এই যে ভাইজান! একটু থামেন, চোখে দেখেন খাঁটি মাল। পান লাগবে? মিষ্টি জর্দা দিয়া, কামড় দিলেই মুখে ফুরফুরে ঘ্রাণ। সিগারেট? ক্যাপস্টেন, পাইলট, স্টার—যা চান, সব আছে। আর আবুল বিড়ি... এক টানেই বুঝে যাবেন, কেন লোকে বারবার আসে।“
চারপাশে লোক থেমে যায়, কেউ চোখ মেলে দেখে, কেউ হাসে।
সে আবার বলে—
“দুই প্যাকেট নিলেই বিশ পয়সা ছাড়, আর বেশি নাই ভাই! ভাববেন না ভাই, শেষ হইয়া গেলে আফসোস কইরেন না। আসামী সুপারির যশোহরের পান। নিয় যান।“
হকারের মুখে হাসি, চোখে আত্মবিশ্বাস। পথচলতি মানুষ কৌতূহলী চোখে তার দিকে ফিরে তাকায়, যেন তার কণ্ঠের জাদু পথের ক্লান্তিকে ভুলিয়ে দেয়।
— “এই যে হকার ভাই, আবুল বিড়ি প্যাকেট কত? কয়টা বিড়ি আছে? একটা মধ্য বয়সী লোক এসে জিজ্ঞেস করে।
-“মাত্র ৫০ পয়সা স্যার। পঁচিশটি বিড়ি পাইবেন। একদম ভালা মাল। দুই প্যাকেট নিয়া যান। ৯০ পয়সা মাত্র।“
-“দে দুই প্যাকেট আবুল বিড়ি দে। আর মিষ্টি জর্দা দিয়ে পানের দাম কত?”
-“অরুণ মনের আনন্দে দুই প্যাকেট আবুল বিড়ি দিতে দিতে বলতে থাকে-“আসামী সুপারি আর চাঁপাইনবাবগঞ্জের মিষ্টি জর্দা দিয়া পান মাত্র বিশ পয়সা স্যর? মুখে দিলেই ঝাঁজ, ঘ্রাণে পুরা আস্ত স্বর্গ! খয়ের একটু কম দিমু, দাঁতে দাগ লাগবেনা।
এক ফোটা চুন, ছোট্ট একটা এলাচ, আর শেষটায় রূপার তুলি দিয়া সাজাইয় দিমু। কয়টা দিমু স্যার?”
-“পাঁচটা বানাইয়া একটা প্যাকেট কইরা দে। বাড়ীতে নিয়া যামু। আমার মায়ের লাইগ্যা।“
অরুণ একেবারে আনন্দ টগবগ। টাকা পয়সা নিয়ে “আবার আইসেন স্যার। আমাকে এইখানেই পাইবেন।“-এই বলে মাথা হেলে বড়ো একটা পেন্নাম করে।
পেছন থেকে এক রিকশাওয়ালা চিৎকার করে উঠলো,
— “ক্যাপস্টেন আছে? থাকলে এক প্যাকেট দে?
একটা দু’টো করে ক্রেতা আসতে থাকলো।
এক অফিস ফেরত ভদ্রলোক এসে তিন প্যাকেট স্টার সিগারেট কিনে বললেন,
— “ঘরে রাখবো ভাই। দামও ঠিক, মালও খাঁটি।”
এক বৃদ্ধ বললেন,
— “তোর গলার আওয়াজেই কিনে ফেললাম, দে ভাল কইরা একটা মিষ্টি জর্দা দিয়া পান বানাইয়া দে।“
কত লোক যে এলো—কেউ শুধু পান, কেউ সিগারেট, কেউ একেবারে প্যাকেট হিসাবেই।
দুই ঘণ্টার মধ্যেই বাক্সটা যেন অর্ধেকের বেশী খালি হয়ে এলো। পানের স্টক প্রায় শেষ।
অরুণ থেমে একবার হিসাব করলো। তার চোখ ছানাবড়া—বারো টাকার বেশি বিক্রি। তার মুখে তখন একরাশ তৃপ্তি, একটা নরম হাসি।
এই ছিল তার দিনের জয়। একজন হকারের জন্য এটাই তো অনেক—আশার আলো, পরিশ্রমের স্বীকৃতি।
দিনের শেষে, যখন সন্ধ্যার বাতাস একটু ঠাণ্ডা হয়ে আসে, অরুণ এক কোণায় দাঁড়িয়ে চায়ের দোকানে গিয়ে একটা কাপ চা কেনে—এটা ছিল তার প্রথম উপার্জন দিয়ে কেনা চা। চা’র সেঁতিয়া গরম তরলটা গলায় নামতে নামতে, সে এক সেকেন্ডের জন্য চুপ হয়ে ভাবতে থাকে—মা, আমি শুরু করেছি।
সেই সময়টা ছিল যেন এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণ—যেখানে অতীতের ছায়া আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনা পাশাপাশি হাঁটছে। মাত্র একটি বছর পেরিয়ে গেছে স্বাধীনতার যুদ্ধের। দেশ এখন মুক্ত, কিন্তু সেই মুক্তির আনন্দে যেন মিশে আছে এক গভীর শূন্যতা, ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে নতুন কিছু গড়ে তোলার আকুলতা। চারদিকে তখনও জেগে আছে বিজয়ের উত্তাপ, অথচ সেই উন্মাদনার বুকেই লুকিয়ে আছে ক্ষুধা, অনিশ্চয়তা, আর জীবনের কাঁধে হঠাৎ চাপিয়ে দেওয়া বড় হয়ে ওঠার দায়।
অরুণ তখনো কিশোর, অথচ যুদ্ধ তাকে অসময়ে টেনে এনে ফেলেছে প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের দরজায়। পলিটেকনিকে শেষ বর্ষের পরীক্ষা পর্যন্ত দিতে পারেনি। গ্রাম ছাড়ার তাড়ায় অনেক কিছু ফেলে এলেও, স্কুলের সার্টিফিকেট আর পলিটেকনিকের প্রথম বর্ষের মার্কশীটটা আঁকড়ে ধরে এনেছিল সে—ভেবেছিল, এগুলো তার ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।
কিন্তু ঢাকায় এসে বুঝতে পারল, এই শহরের কোলাহলে তার কাগজগুলো কতটা মূল্যহীন। রাস্তায় পড়ে থাকা বাতিল কাগজের টুকরোর মতোই। এখানে প্রয়োজন শুধু ডিগ্রি নয়, দরকার পরিচয়, প্রভাব, অভিজ্ঞতা। পড়াশোনার এই অল্প সঞ্চয় শহরের চাকরির বাজারে কোনো দরজাই খুলতে পারে না।
পুরাণ ঢাকার অলিগলি তখনো সেই পুরনো ঢঙেই ব্যস্ত, কিন্তু চারপাশে বদলাচ্ছে বাতাস। বারুদের গন্ধ মিলিয়ে গিয়ে তার জায়গা নিচ্ছে ধোঁয়া, রাস্তায় ভাজাভুজি, আর পান-সিগারেটের দোকানের তীব্র জর্দার গন্ধ। ঘড়ির কাঁটার মতো চলে সেই পুরাণ ঢাকার সকাল-বিকেল, কিন্তু এখন গলির মোড়ে মোড়ে নতুন নতুন মুখ বসে। অরুণের মতো তরুণ ছেলেরা। কারো হাতে রিকশার হাতল, কারো কাছে একটা পানের বাক্স। যুদ্ধ তাদের বইয়ের পাতা থেকে টেনে এনেছে রাস্তায়।
চাকরি তখন ছিল ভাগ্য দিয়ে নির্ধারিত—যার তেল ছিল, সে-ই চাকা ঘোরাত। অরুণদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে—যারা ভদ্রতা পুঁজি করে বড় হয়েছিল—তাদের কাছে ফুটপাতে বসে পান বেচা ছিল যেন নিজের গায়ে দাগ লাগানো। কিন্তু তখন সেই দাগটাই ছিল বেঁচে থাকার গর্ব।
পুরাণ ঢাকায় এই বাস্তবতা একটু আলাদা ছিল। এই জায়গাটা সব সময়ই একটু বর্ণময়, একটু উচ্ছল, একটু জীবনমুখী। চকবাজার, নাজিরা বাজার, বংশাল, কসাইটুলী, আরমানিটোলা, বেবি আইসক্রিমের গলি—সব জায়গা যেন একেকটা জীবন্ত সিনেমা। এখানকার মানুষ গলার স্বরে, হাসিতে, খাবারে, আর সম্পর্কের টানেই চিনিয়ে দেয় নিজেদের।
এই শহরের পুরনো দেওয়ালগুলোর ফাঁকে পাকিস্তানী দস্যুরা গোলা-বারুদ মেরেছিল। পাখির বাসার মতো গুঁড়িয়ে দিয়েছিল অনেক ঘর। সেই ভাঙ্গা ঘরের ভেতরেই আবারও জীবন বুনছিল মানুষ। অরুণ যখন তার পানের বাক্স খুলে বসে, তখন মনে হচ্ছিল, এই একচিলতে বসার জায়গাটি শুধু রোজগারের জায়গা না—এ যেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ঘোষণা। কেউ হয়তো এক টাকার বিড়ি নিচ্ছে, কেউ ম্যাচ, কেউ পান—কিন্তু প্রতিটা লেনদেনের ভেতর লুকিয়ে আছে বিশ্বাস আর বেঁচে থাকার যুদ্ধ।
ঢাকার এই দিকটাই অদ্ভুত রকম প্রাণবন্ত। শহরের বাকিটা তখনো গুছিয়ে উঠতে পারেনি, কিন্তু পুরাণ ঢাকা ছিল নিজের গতিতেই ছুটে চলা এক মহল্লা-প্রাণ। এখানে “চাচা” বললেই দরজা খুলে যায়, আর “খাইবেন কিছু?” শুনলেই জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় এক থালা মুগের ডালপুরি।
এই পুরাণ ঢাকাই অরুণের মতো ছেলেদের একটু জায়গা দেয় বাঁচার, সাহস দেয়—তুই পারবি। লজ্জা লাগবে, ভয় করবে, কিন্তু দাঁড়াতে হবে। এই শহরের বুকেই অনেকগুলো গল্প একসাথে হাঁটে—মোল্লাবাড়ির মুড়ি, শাঁখারিবাজারের কাচের চুড়ি, সূত্রাপুরের ফুটবল, আর চকবাজারের নুন-পানির শরবত—সবকিছু মিলে একটা রঙিন সময় বয়ে যাচ্ছিল শহরের গায়ে।
১৯৭৩-এর বাংলাদেশ তখন ঠিক যেন একটা সদ্য জন্ম নেওয়া শিশু—কিছুটা ক্লান্ত, কিছুটা ক্ষুধার্ত, কিন্তু চোখে টলটলে স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্নের ভেতরেই পানের বাক্স খুলে বসে অরুণ, পাশে আসলাম আর তমাল, চারপাশে ঘুরছে জীবন, ঢাকার শব্দ, মানুষ, আর ইতিহাস।
চলবে—
ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট