শ্রীচরণেষু দাদা: ১৫


অবশেষে সন্ধ্যা নামে গুলিস্তানে।
রাস্তার বাতিগুলো একে একে জ্বলে ওঠে। যেন শহরের বুকের গভীরে জেগে ওঠে একেকটি নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস। হেডলাইটের ঝলক ঝলকে মানুষজন ডুবে যায় এক অপার ভিড়ের নদীতে। তার মধ্যেই একজন—অরুণ। ধীরে ধীরে ফিরছে, পায়ে পায়ে, যেন হাওয়ার সুরে বাঁধা গানের কলি।
তার গন্তব্য সেই ছোট্ট ঘরটিতে। যেখানে টিনের ছাদে একটা ফুটো আছে। বৃষ্টির রাতে সেখান দিয়ে টুপটাপ জল পড়ে, আর পূর্ণিমার রাতে সেই ফুটো দিয়েই ঢুকে পড়ে এক চিলতে চাঁদ, চোখে মুখে আছড়িয়ে পড়ে। সেই ছোট্ট ভাঙ্গা-চূড়া ঘরটিতেই তিনজন তরুণ ভাগ করে নেয় জীবনের পরিশিষ্ট আলো।
ঘরে ঢুকতেই তমাল চোখের কোণে একটু ভাঁজ ফেলে বলে ওঠে,
— “আজ এত্তো দেরি অইল ক্যা, অরুণ দা? কেনা-বেচা ভালা গ্যাছে নাকি আজ?”-তমালের সুরে মিশে থাকে একটা দুষ্টুমিও, সন্দেহও।
অরুণ কিছু বলে না। গলার ঝোলানো বাক্সটা নামিয়ে একটা কোণে রাখে। তারপর আস্তে করে উঠে গিয়ে বসে পড়ে আসলামের পাশে। চোখে একরাশ অদ্ভুত প্রশান্তি। ঠোঁটে একটানা স্থির হাসি, যেন সে কিছু খুঁজে পেয়েছে—ভালো কিছু, নরম কিছু।
— “বিক্রি ভালা অইছে মনে অয়?” আসলাম জিজ্ঞেস করে।
— “হ, হইছে কিছুটা,” অরুণ বলল। “তয় টাকাটা আজ শুধু পকেটেই ঢুকে না রে ভাই, আজ মনের মধ্যেও ঢুকছে... বুঝছস?”
তার চোখে যেন একটু হালকা আলো খেলে যায়।
আসলাম চুপচাপ তাকিয়ে থাকে তার দিকে। কিছুক্ষণ পরে হেসে বলে,
— “কিতা অইছে, অরুণ দা? তোমারে আজকা অতো খুশি খুশি লাগতাছে ক্যা। কোন মাইয়া মানুষের পাল্লায় পড়নাইতো? তাইলে কিন্তু বিপদ আছে, কইতাছি।”-চোখ টিপে হেসে ফেলে সে।
অরুণ জোড়ে হেসে ওঠে, মৃদু হাওয়া যেন ঘরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেলো হঠাৎ করেই।
— “আসলাম ভাই, কিতা কইলেন! আমি অইরকম মানুষ নাকি। আমাকে দেইখ্যা আপনাগো বুঝি এইডাই মনে অয়?”-এই বলেই সে পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে আস্তে করে বাড়িয়ে দেয় আসলামের দিকে।
— “কাল মিটফোর্ডে যামু। মনে অয় একটা চাকরি হইব। একটা ঠিকানা পাইছি।”
“এইডা কিসব ইংরেজিতে লেখা। কিতা লেখা আছে এখানে। বুঝাইয়া কও দোস্ত।“-আসলামের প্রশ্ন
তমাল হঠাৎ সোজা হয়ে বসে পড়ে,
— “চাকরি! কিতা কইতাসছ? কোথায় অইব, কেমনে? একটু ভালা কইরা খুইল্যা কও না অরুণদা। মাথায় কিচ্ছু ঢুকতাছে না।”
অরুণ মাথা নিচু করে হাসে। তারপর ধীরে ধীরে বলে যায় দুপুর বেলার গল্পটা—
একজন অচেনা যুবক, একটা সিগারেট, কিছু কথাবার্তা, তারপর সেই কার্ড। যেন জীবনের মাঝপথে এক দরজা হঠাৎ খুলে গেছে।
অরুণ বলে, “জানিস,দোস্ত। নামটাও জানত না লোকটা আমার। কিন্তু ওর চোখে আমি যা দেখেছি, সেটা কেউ কোনোদিন দেখেনি। একটা ফেরেশতার মতো। জানিস, কতদিন পর মনে হইতাছে আমি কিছু একটা হতে পারি?”
ঘরের মধ্যে এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা নামে। পৃথিবীর সব শব্দ যেন বাইরে রেখে আসে বাতাস।
তমাল আস্তে করে বলে,
— “তুই পাইরবি দোস্ত। আমরা জানি। তোর বুদ্ধি-শুদ্ধি খুব ভালা”-এই বলেই মুখটা ফিরিয়ে নেয় অন্যদিকে।
আসলামের চোখে একটু জল চিকচিক করে ওঠে। সে কিছু বলে না। শুধু হাতটা বাড়িয়ে অরুণের কাঁধে রাখে।
ঘরে এক মুহূর্তের জন্য নীরবতা নামে।
তমাল হাত থেকে আধা খাওয়া পানের খিলি ফেলে দেয় পাশে। খুব নিচু গলায় বলে,
— “চাকরি পাইলে ত ভুলে যাইবা না, অরুণদা?”
তার গলায় ঝুলে আছে অনেক না বলা কথা। যেন সে জানে—এই যাওয়া মানেই একটা সময় পরে ‘তুমি’ আর ‘তোমরা’ থাকবে না, থাকবে শুধু ‘সে’।
অরুণ চমকে তাকায়।
তার চোখের কোনে হালকা জলের রেখা। ঠোঁট কাঁপে।
— “ভুলে যাব? তোমরা তো আমার জীবনরে ভাই। এই ফুটো টিনের ছাদ, এই তিনটা থালা, এই জানালার চাঁদ—সব মনে থাকবে। চাকরি হইলেও মন তো এখানেই থাইক্যা যাইব।”
আসলাম পেছন ফিরে দেয়ালে মাথা ঠেকায়। তারপর হালকা হাসে।
— “তয় স্যালুট পাইলি, আমাগো নাম কইস। কইস—আমরা তিনজন ভাগ করে খাইতাম এক থালা খিচুড়ি। ভাগ করে লইতাম একমুঠো স্বপ্ন।”
তমাল ততক্ষণে উঠে এসে একটা পুরনো ছবি বের করে দেয়।
তিনজনের এক সাথে তোলা ছবি। নবাবপুরের জোছনা ফটোগ্রাফি থেকে তুলে এনেছিল।
— “এইডা রাইখ, অরুণদা। নতুন দুনিয়ায় গেলে... দেইখ্য মাঝে মধ্যে। বুঝতে পাইরবা আমরা হগল সময় তোমার লগেই আছি।“
অরুণ ছবিটা বুকের কাছে চেপে ধরে।
তার গলা ভারি হয়ে আসে।
— “তোমরা থাকবা এই ঘরে, আর আমি থাকব—মনের ভিতরে। চাঁদের আলো যেমন জানালা দিয়া পড়ে, আমি তেমনি পড়ে থাকব তোমাগো কথার মধ্যে... রাত্রির নিঃশ্বাসে, মুগ্ধ নিরালায়।”
চুপচাপ সবাই।
একটা টিনের শব্দ হয় ছাদের ওপরে—কোনো পাখি যেন উড়ে গেলো।
আর সেই মুহূর্তে, একটা ছোট্ট আলো জ্বলে ওঠে অরুণের চোখে—
না ওটা শুধু চাকরির আলো না, ওটা একসাথে কাটানো রাতগুলোর, শেয়ার করা স্বপ্নগুলোর মৃদু দীপ্তি।
জীবনের রূপরেখা যেন বদলাতে শুরু করেছে। একটা নতুন পৃষ্ঠা খুলেছে, যেখানে লেখা থাকবে না শুধু হকারের গল্প, লেখা থাকবে ঘাম, স্বপ্ন আর ফিরে যাওয়ার সাহস। অরুণ চোখ বন্ধ করে, মনে মনে বলে ওঠে—
“মা, আমি আসছি...”
রাতের নিদ্রা যেন এক মুগ্ধতার তরঙ্গে অরুণকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আসলাম-তমালের সঙ্গে আলাপে আলাপে ক্লান্ত দেহ অবশেষে যখন বালিশে মাথা রাখে, তখনই যেন ঘুম এসে তাকে এক অদৃশ্য চাদরে মুড়ে দেয়। কখন পাখিরা ডেকে ওঠে, কখন গলির ভোরের কোলাহল জাগে—তার কিছুই সে টের পায় নাই।
সকালে চোখ খুলতেই দেখে, আটটা পেরিয়ে গেছে। আসলাম তখনও নিঃশ্বাসে স্বপ্ন বুনে চলেছে। তমাল এমনিতেই রাতভর টিপটিপ ঘুমোয়, কিন্তু সকাল হলেই যেন ঘরের মধ্যে একখানা ডিজেল ইঞ্জিন চালু হয়ে যায়—ঘরঘর করে নাক ডাকে, যেন ঘুম না, মর্নিং শো শুরু হয়েছে।
তবু আজকের সকালটা যেন অন্য সব সকাল থেকে একটু আলাদা। অদ্ভুত এক শান্তি মিশে আছে হাওয়ার চলনে, আলোয়, শব্দে।
টিনের ছাদের ফাঁক দিয়ে যে রোজকার রৌদ্ররেখা ঘরে ঢুকে পড়ে—আজ সে আলো যেন নতুন। আজ তা যেন অরুণের নাম ধরে ডাকছে, বহুদিন ধরে জমানো প্রতীক্ষার আবেগ নিয়ে। যেন সেই আলো শুধু তার জন্যই রয়ে গিয়েছিল। জমে থাকা সব জ্যোতি এক নিমিষে ঢেলে দিচ্ছে তার জীবনে।
এই সকাল নয়, শুধুই আরেকটা নতুন দিন—এ যেন এক আলোড়ন, এক জাগরণ। এক নিমগ্ন, গভীর উপলব্ধি—জীবন বদলাতে চলেছে।
এক সময় খাটের নিচ থেকে ধুলোর স্তরে ঢাকা সেই পুরনো ব্যাগটা টেনে বের করে অরুণ। কতদিন খুলে দেখা হয়নি—তবু তার ভেতরে ছিলো অরুণের যত্নে ভাঁজ করে রাখা সাদা শার্টটা। গ্রামে থাকতে জামাইবাবু পলিটেকনিকে ভর্তি হওয়ার সময় কিনে দিয়েছিলো। তেমন দামি কিছু না, কিন্তু অরুণের কাছে ছিলো যেন ধনকুবেরের উপহার—কারণ, জীবনে একবারই তো এমন জামা জুটেছিলো।
জামাটা পুরনো, রঙ তার মলিন হয়ে গেছে, কাপড়টাও পাতলা হয়ে এসেছে, তবু অরুণ যত্ন করে রেখে দিয়েছে এতদিন। কেননা, আর তো কিছু ছিল না তার। নতুন শার্ট কেনার কথা ভাবাটাও যেন অপমান হতো বাস্তবতার প্রতি।
যাদের ঘরে সাতদিনে একবেলা খাবার জোটে না, সেখানে শার্ট কেনা এক বিলাসিতা নয়, এক নিষ্ঠুর কৌতুক।
অরুণের বাবা এখনো সকাল বেলা বাজার করতে যান ছেঁড়া ধুতি পড়ে, তালি দেওয়া জায়গাগুলো দিনের আলোয় ফুটে ওঠে, কিন্তু তিনি গা করেন না। কারণ অপমানের অভ্যাস অনেকটা অভুক্ত থাকার মতো—একবার মানিয়ে নিলে আর কষ্ট লাগে না।
সঙ্গে ছিলো একমাত্র কালো প্যান্টটা—পকেটের সেলাই খুলে গেছে, এক পাশে সুতো ঝুলছে। তবু আজ সেটাই অরুণের ‘ভালো জামা। কারণ এর বাইরে আর কিছু নেই, কিছু ছিলও না কোনোদিন।
এই জামা-প্যান্টেই সে যাবে মিটফোর্ডে। যেন যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার আগে নিজের ভাঙাচোরা অস্ত্র গায়ে তুলে নিচ্ছে—দরিদ্র জীবনের শ্রান্ত সৈনিক।
জামাটা গায়ে তোলে ধীরে ধীরে, যেন স্মৃতিগুলোকে গায়ে মেখে নিচ্ছে। তারপর মুঠোভরা জল তুলে মুখে ছিটিয়ে নেয়। আয়নার মতো টিনের এক চকচকে পাত, যেটা দেওয়ালের এক কোণে হেলান দিয়ে রাখা—সেদিকেই তাকায়।
চোখে চোখ পড়ে নিজের। এক মুহূর্ত থমকে যায়। কেমন অচেনা লাগছে নিজেকে। এই কি সেই অরুণ, যে প্রতিদিন রোদ বৃষ্টিতে গলায় বাক্স ঝুলিয়ে পান-বিড়ি-সিগারেট বিক্রি করে গুলিস্তানের অলিতে-গলিতে। রাস্তার মাথায় চা খায়, পড়ন্ত বিকেলে তিন বন্ধু মিলে সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখে সময় কাটায়?
না, আজ সে কেবল একজন হকার নয়।
আজ সে একজন শ্রমিক, এক নতুন যুদ্ধের আগে দাঁড়িয়ে থাকা এক যাত্রী।
ঠিক তখনি পাশে আসলাম উঠে বসে হাই তুলে বলে,
— "তুই আজ তাইলে যাইতাছ দোস্ত?"
অরুণ শুধু মাথা নাড়ে, কিছু বলতে পারে না। গলায় কেমন একটা দলা পাকানো শব্দ আটকে থাকে।
তমাল কিছু বলে না। ঘুম জড়ানো চোখে উঠে, বাইরে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফিরে আসে। হাতে তিন কাপ চা আর কিছু বিস্কিট।
চুপচাপ বসে পড়ে তিনজন। কারো মুখে কোনো কথা নেই। চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে, কিন্তু সে ধোঁয়া যেন চোখের জলে মিলেমিশে যায়। শেষ চা—তিন বন্ধুর ভাগ করে খাওয়ার। তাদের ছোট্ট ঘরের শেষ সকালের ঘ্রাণ।
কেউ কিছু না বললেও, জানে—এই মুহূর্তটা আর কখনো ফিরে আসবে না।
তমাল হঠাৎ নিচু গলায় বলে,
— "তোরে আইজ খুব সুন্দর লাইগতাছে। তয় তুই যেহানে থাকিস ভালো থাকিস… হ? পারলে মাঝে মধ্য আমাগরে দেখতে আইস"
অস্ফুট হাসে অরুণ।
সে জানে, এই হাসি তার কান্নারই আরেক রূপ। দরজার বাইরে রোদের রেখা পড়ে আছে। সেই রেখা পেরিয়ে যেতে হবে আজ।
জীবনের আরেক প্রান্তে।
চোখের কোণে জমে থাকা ভেজা অনুভব নিয়েই অরুণ বিদায় নেয়—না বলা অনেক কথা ঠোঁট পর্যন্ত এসেও ফেরত যায়। মুখে আর্দ্রতা, পায়ে এক অদৃশ্য ভার—তবু হাঁটা থামে না।
রাস্তায় পা ফেলে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে সে, যেন প্রতিটি ধাপেই ফেলে আসছে একটা পরিচিত জীবন। নবাবপুর রোড পেরিয়ে ইংলিশ রোডের সরু গলির দিকে মোড় নেয়, শহরের পুরোনো পল্টনের পায়ের নিচের ইটের কোলাজে কেমন যেন আত্মজ প্রশ্নের ছায়া পড়ে থাকে। চারপাশে তখন শহরের কোলাহল জেগে উঠেছে, সকাল আর কোমল নেই—তাপ বাড়ছে, শব্দ ঘন হচ্ছে, বাতাসে মিশছে মানুষের ধোঁয়া আর ক্লান্তি।
অবশেষে পৌঁছায় মিটফোর্ডের রাস্তায়—চেনা-অচেনার এক সীমান্তরেখা।
এগিয়ে যায় বুড়িগঙ্গার পাড় ধরে। নদীর ঘোলাটে জলে তখনো রোদ্দুরের ঝলক পড়ে, কিন্তু অরুণের চোখ সেদিকে তাকায় না। তার চোখ চলে যায় সামনে—যেখানে দাঁড়িয়ে আছে মিটফোর্ড কেমিক্যাল ওয়ার্কস।
এক বিশাল গেটের সামনে থামে সে। লাল ইটের উঁচু দেওয়াল ঘিরে রেখেছে এই কর্মযজ্ঞের রাজ্যকে। ফটকে শাদা রঙের রং ধুয়ে গেছে কিছুটা, তবু সেটার মধ্যেও আছে এক ধরনের দম্ভ, এক ঘোরলাগা ব্যস্ততা। কপাটের ওপারে অচেনা এক জগৎ, যেখানে পরিচয় নয়, প্রয়োজন কথা বলে।
অরুণ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
তার বুকের ভেতর যেন শব্দ করে উঠছে ভবিষ্যতের এক চাপা ডাকে—অজানা, কিন্তু অবধারিত।
গেটের কাছে আসতই কাঠের চেয়ারে বসে থাকা দারোয়ানটা সন্দেহভরা চোখে তাকায়,— “কাকে চাই?”
অরুণ ধীরে বলে, “আমাকে কায়সার সাহেব আজ সকাল দশটায় আসতে বলেছিলেন।” বুকপকেট থেকে চেপে ধরা সেই কার্ডটা বের করে বাড়িয়ে দেয়। লোকটা তখন নিঃশব্দে মাথা নাড়ে। একটা টোকেন এগিয়ে দিয়ে বলে,— “এই পাশ টেনে ভেতরে ঢুকুন।”
অরুণ ধীরে ধীরে পা রাখে অচেনা এক জগতের চৌকাঠে।
কারখানার ভেতরে পা পড়তেই প্রথম যে শব্দটা কানে বাজে, তা যেন কোনো জগন্নাথযাত্রার শঙ্খধ্বনি নয়—তা এক দীর্ঘ, ঘষা ঘষা লোহার শব্দ। বোতলের শব্দ। ঘর ঘর করে মেশিন চলার শব্দ। যেন মাটির গভীর থেকে উঠে আসা এক কাঁপানো ডাক।
চারদিকে মেশিনের কান ফাটানো কর্কশতা, চিৎকার করে নির্দেশ দেওয়া শ্রমিক, আর বাতাসে মেশানো কেমিক্যালের এমন ঝাঁঝালো গন্ধ—যেন চোখেও ব্যথা লাগে। তবু অরুণ ভয় পায় না। না, একটুও না। তার মনে হয়, বহু বছর ধরে এই শব্দ, এই গন্ধ, এই রুক্ষ দেয়ালের মধ্যেই সে তার ভবিষ্যৎকে খুঁজে ফিরেছে।
গুদামের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন কায়সার সাহেব।
অরুণকে দেখে একটা আন্তরিক হাসি ছুঁড়ে দেন।
— “আমি জানতাম তুমি আসবে। শুরুটা কষ্টকর। কিন্তু একদিন তুমি ঠিক দাঁড়িয়ে যাবে। এখানে সবাই নিচু থেকে শুরু করে, কেউ কেউ ওপরে উঠে যায়।”
অরুণ শুধু মাথা নাড়ে। কথা বেরোয় না। তার চোখে ভেসে ওঠে মায়ের মুখ। সেই দূর গ্রামের কাঠের জানালার পাশে বসে থাকা শীর্ণ শরীরের নারী—যার চোখ এখনো পথ চেয়ে থাকে, যেন জানেন আজ তার ছেলে ঠিক কোথাও দাঁড়িয়েছে।
গুদামের কাজ কঠিন। পিঠে বোঝা ওঠে, খাতায় হিসাব লিখতে গিয়ে হাত কাঁপে, গায়ে ঘাম ঝরে এমনভাবে যেন শরীরটা নিজের নয়—কেবল একটা মেশিন, চলতে হবে বলেই চলে। তবু অরুণের মনে হয়, এই ক্লান্তি ফুটপাথে ঘুরে বেড়ানো সেই অর্থহীন দৌড়ের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।
এখানে ঘামে শুধু গন্ধ নেই—আছে সম্ভাবনার উষ্ণতা।
কায়সার সাহেব বলেন
— “আপাতত মাসে ২১০ টাকা পাবে। আর হ্যাঁ, তোমার জন্য একটা ভালো খবর আছে—তুমি এখানেই থাকবে। আমাদের পাশেই একটা কোয়ার্টার আছে দারোয়ানদের জন্য। ওখানে একটা ছোট রুম তোমার হবে। থাকা ফ্রি। খরচ কম। চাইলে টাকাগুলো জমাতে পারো।”
অরুণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ২১০ টাকা। একটা নিজের শোবার ঘর? তার জীবনে কখনো এমন নিশ্চয়তা ছিল না।
যেখানে গায়ের জামা বেছে নিতে হত রাতের কাঁথার সঙ্গে মিলিয়ে, সেখানে একটা ঘর?
তার বুকের মধ্যে অজানা এক ঢেউ ওঠে—কিছুটা কৃতজ্ঞতা, কিছুটা বিস্ময়, আর অনেকখানি দায়।
মায়ের জন্য, নিজের জন্য, বন্ধুত্ব আর স্বপ্নের ঋণের জন্য—এই শহরের অজস্র ধুলোর মধ্যেও যেন আজ একটু জায়গা পাওয়া গেছে।
কায়সার সাহেব অরুণকে বোতলের কারখানাতে নিয়ে যান। সব বুঝিয়ে দেন। একজনকে ডেকে এনে অরুণকে পরিচয় করিয়ে দেয়। অরুণকে সব কিছু শিখিয়ে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন।
অরুণের চোখের সামনে তখন বিশাল গুদাম ঘর। লম্বা বেঞ্চির ওপর সারি সারি শিশি, কেউ ঘষে মেজে পরিষ্কার করছে, কেউ ভরছে, কেউ গুনছে। কেউ কিছু বলে না, কেবল কাজ করে যাচ্ছে নিরন্তর ছন্দে।
অরুণ নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে।
তার ভেতর একটা নতুন কিছু জন্ম নিচ্ছে—একধরনের নীরব শপথ, যেন এই ময়লা বোতল মুছে ফেলার মতো, নিজের ভেতরের পুরনো হেরে যাওয়া মানুষটাকেও সে আজ থেকে ধুয়ে ফেলবে। সে ভাবে—“জীবনে কোনোদিন কিছু মুছে ফেলার সাহস করিনি। আজ বুঝি সেই দিন।” কোনো নির্দেশ না পেয়ে নিজেই একটা ঝুড়ি তুলে নেয়, হাত ভিজিয়ে ফেলে কেমিক্যালে, শিশি ঘষে।
জলের ঝাপটায় তার মুখে এসে পড়ে একফোঁটা। তবু সে পেছনে ফিরে তাকায় না। আজ থেকে পিছনে তাকানো মানে থেমে যাওয়া। আর থামলে তো সব শেষ।
রাত নামে ধীরে ধীরে, যেন শহরের মাথায় একটা নরম চাদর টেনে দেওয়া হয়েছে। মিটফোর্ডের কেমিক্যাল কারখানার ঠিক পাশের রাস্তা দিয়ে নদী বরাবর হেঁটে গেলেই হাতের ডান দিকে বিশাল একটা বাড়ী। তার ঠিক লাগোয়া ঘরটিতে থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে। সেই ছোট্ট ঘরটিতে আজ থেকে অরুণের নতুন ঠিকানা। অরুণের আজ প্রথম রাত। বাতাসের গায়ে লেগে থাকে ক্লান্তি, কিন্তু সেই ক্লান্তি আজ একটুও বোঝা নয়।
ছাদের টিনে একটানা টুপটাপ শব্দ—না, আজ বৃষ্টি নয়, তবে যেন হৃদয়ের কোথাও এক ধরনের নরম সোঁদা গন্ধ জমেছে। ঘরের জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যায় না, তবু মনে হয়, একফালি চাঁদ ঠিক তার জন্যই দাঁড়িয়ে আছে বাইরে—চুপচাপ। অরুণ খাল বিছানায় চুপ করে শুয়ে থাকে। চোখে ঘুম নেই, কিন্তু ক্লান্তির নেশা আছে।
তার মনে পড়ে যায় মায়ের শেষ দৃষ্টি। চুপচাপ, কিন্তু কাঁপা ঠোঁটের ভেতর লুকিয়ে থাকা আশীর্বাদের মতো। তমালের খিলি, আসলামের হাসি, নবাবপুরের সেই ছবি—সব একসাথে ভিড় করে আসে বুকের মধ্যে।
হঠাৎ তার মনে হয়, আজ রাতে সে আর আগের অরুণ নেই। সে শুধু নতুন একটা চাকরি পায়নি। সে নিজের জীবনের ছাঁদটাও যেন বদলে ফেলেছে। ফুটো ছাদ থেকে চাঁদ ঢুকবে না আর। তবে বুকের ভেতর একটুখানি আলো টিকটিক করে জ্বলবে—ভোর পর্যন্ত। সে চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলে ওঠে,
"এই ঘরটা আমার নয়, এই শহরটা এখনো নিজের না, কিন্তু এই মনটা—এখন প্রথমবারের মতো আমার নিজের হয়ে উঠেছে।"
দুর থেকে জানালার ছিদ্র দিয়ে যেন বুড়িগঙ্গার ঢেউয়ের একটুখানি গন্ধ ভেসে আসে। হালকা চাপ দেয় অরুণের চোখে-মুখে এক পরম মমতায়। অরুণ শুনতে পায়, শহর যেন নিঃশব্দে বলে ওঠে—
"তোমার যাত্রা শুরু হলো, অরুণ। এখান থেকে, এই রাত্রি থেকে।"
চলবে—
ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট