শ্রীচরেণেষু দাদা: ১১


অরুণ যেন ভাবনায় পড়ে গেলো। একটু ইতস্তত ইতস্তত ভাব। তার কাছে এই শহরটি সম্পূর্ণ নতুন । কুমিল্লায় পড়াকালীন সময় দু এক বার চট্টলায় গিয়েছিল বটে তবে রাজধানী শহরে আসার তেমন সুযোগ হয়নি কখনো। তাছাড়া সামর্থ্যও ছিল না। সংসারের আয়ে সপ্তাহে একবারও ভালো করে ভাত খাওয়ার সুযোগ হতো না অরুণদের।
কতো বড়ো এই রাজধানী ঢাকা শহর! শহরের ঠাট-ঠমক বোঝার সাধ্য তার নেই! গ্রামের ছেলে তো, তাই শহুরে মানুষের মতো চকচকে বুদ্ধি-শুদ্ধি মাথায় ঢোকেনি এখনো। চালাকির হিসেব কষে চলার অভ্যাসও নেই। এখানে কত রঙের মানুষ, কত রকমের চলাফেরা! এক পলকেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট, বিপদ যেন ওত পেতে থাকে গলির মোড়ে মোড়ে। গ্রামের সুরেনদার কাছে একবার শুনেছিলো এই শহরের গল্প। সুরেন-দা অরুণের কয়েক বছরের বড়ো। গ্রামের উত্তর পাড়ায় বাড়ী। দাদু ভগবান সিং। গ্রামের সবাই উনাকে রবি ঠাকুর বলতেন। দাঁড়িগুলো ছিল ঠিক রবি ঠাকুরর মতোই। সেই সময় গ্রামের মধ্যে এক মাত্র সুরেন-দাই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পায়। পুরো গ্রামের কাছে সুরেন-দা ছিলেন সোনার ছেলে, গ্রামের গর্ব। হোস্টেলে থেকে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে সুরেন-দা ফিলসফিতে পড়তেন। একদিন সুরেন-দা বলেছিলেন-
“ঢাকা এক জাদুকরী শহর। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠলেই মনে হয়—জীবন আর টাইমের সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। অফিস টাইমে রাস্তায় নামা মানে রীতিমতো যুদ্ধের ময়দানে নামা। রিকশা, বাস, বাইক, গাড়ি—সবাই যেন একে অপরের ঘাড়ের ওপর উঠে যাবে! ধোঁয়া-ধুলোয় চোখ মুখ চেনা দায়, কাশি দিতে দিতে সামনে এগোতে হয়!”
এই শহরে কারো কাঁধে বা পাছায় ধাক্কা লাগলেও কেউ পেছন ফিরে তাকানোর সময় পায় না, রাগও তেমন করে না তবে গুলিস্তান টু রামপুরার নাক উঁচা মুরির টিন বাসে মেয়েদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে অসৎ কুলাঙ্গারের দল ভিড় জমাত। মাঝে মধ্যে কন্ডাক্টর হাঁক দিত-"এই যে ভাই জায়গা ছাইড়া দেন----।“ কেউ যদি রাস্তার ধারে শুয়ে থাকে, দেখে ভাববে "নিজের সমস্যা সামলাতে পারছি না, ওকে দেখার টাইম কই?" এমনকি কেউ যদি রাস্তায় গড়াগড়ি খায়, লোকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। শহরের মানুষগুলো একেবারেই অন্যরকম। তাদের কেউ হয়তো সকালে বের হয়ে অফিসে ছুটছে, কেউ দুপুরে টিফিনের লাইনে দাঁড়িয়ে গলা ফাটাচ্ছে, আর কেউ বিকেলে ট্রাফিক জ্যামে বসে জীবনের মানে খুঁজছে! বাসের কন্ডাক্টর চিৎকার করছে, "মোহাম্মদপুর! উত্তরা! গুলিস্তান! ভাড়া দেন, ভাই!" আর যাত্রীরা ভাবছে, "ভাড়া বাড়ল কবে, জানতেই পারলাম না!"
হাসতে হাসতে সুরেন দা বলেছিলেন “ব্যস্ততার কারণে মালতীর সাথে শেষ পর্যন্ত প্রেমটা পর্যন্ত হলো না। ঢাকার মানুষ এত ব্যস্ত যে, প্রেম করতেও টাইম নেই! প্রেমিক প্রেমিকার হাতে হাত রাখবে কি, দেখা করারও টাইম নাই! "বেইলি রোডে আসো, কথা আছে" বললেই উত্তর আসে "বেইলি রোড তো দূর, যাওয়া যাবে না!" অনেকদিন পর এক বিকেলে ইউনিভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে গুলিস্তানের পথে দেখলাম কারো পাশে রিক্সায় বসে খিল খিল করে হাসতে হাসতে মালতী রমনা পার্কের দিকে যাচ্ছে। লজ্জায় মুখ লুকিয়ে অন্যদিকে চলে আসি। আর কোনদিন ওর সাথে দেখা করিনি।
আসলে এই শহরে সবাই দৌড়চ্ছে, বদলাচ্ছে মানুষের স্বভাব। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে, কেউ জানে না! একদিন যদি হঠাৎ করে শহর থেমে যায়, তাহলে সবাই হয়তো অবাক হয়ে বলবে, "এই ব্যস্ততা ছাড়া আসলেই কিছু করার আছে নাকি?"
জীবনে প্রথমবার ঢাকা শহরে পা রাখা। কাল রাতে স্টেশনে নামার পর থেকেই চারপাশের সবকিছু যেন সিনেমার ফ্রেম হয়ে চোখের সামনে ভাসতে লাগল অরুণের। কোথায় যাবে, কি করবে—একটু আন্দাজও নেই। তবে আসলাম আর তমালের দিকে তাকিয়ে বুঝল, আপাতত এদের সঙ্গে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
ছেলেগুলোর চেহারা-চরিত্রে খারাপের কোন ছাপ নেই। চোর-ডাকাত বা ছিনতাইবাজ হলে চোখেমুখে কেমন একটা ধুরন্ধর ছাপ থাকত। চালচলনে একটু কুটিলতা ফুটে উঠত—কিন্তু ওদের আচরণ বেশ স্বাভাবিক। অরুণ একটা দম নিয়ে নড়ে চড়ে দাঁড়াল। মনে মনে ভাবল “ শহরের পথচলা শুরু হচ্ছে, দেখাই যাক কপালে কি লেখা আছে!”
অরুণ একটু ধীরে ধীরে বলল, “থাকতে চাই… কিন্তু জানি না, পারব কিনা।”
তমাল হেসে বলল, “পাইরবা! তুমি ভাইব্বা না। সব ঠিক অইয়া যাইব।”
আসলাম মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক কইছস! আমরা কি একদিনে শিখছি? ধীরে ধীরে সব শিখবে।”
অরুণ একটু হেসে বলল, “কিন্তু শুরুটা কিভাবে করব?”
আসলাম চারপাশে একবার দেখে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আজ না হয় আমাগো লগে চইল। দেখাই দিব আমরা কিতা করি, কেমনে কাম চলে শহরে। একদিন দেখবা, দুইদিন দেখবা, তারপর নিজেই শিইখ্যা যাইবা।”
অরুণ একটু ভাবল। আসলাম আর তমালকে দেখে মনে হচ্ছে খারাপ কিছু করবে না। শহরে টিকতে হলে কিছু একটা করতে হবে, এ তো পরিষ্কার। একটু জোর গলায় বলল, “আসলাম ভাই, আমি তোমাগো লগে কাইল থেইক্যা আসি। আজ আমি নিজে একটু খুইজা দেখি, যদি কোন দোকান-বাজারে বা গ্যারাজে কাজ পাই! কিছু একটা ধরতে অইব।”
তমাল চট করে বলে উঠল, “ভাল কইছস! এইডা এক্কেবারে বুদ্ধির কাম! দোকান-টোকানে কাম পাইলে ভালোই অইব। আর না অইলে আমাগো মতো গলায় একটা বাক্স ঝুলাইয়া পান-বিড়ি বেইচবা। এক্কেবারে স্বাধীন কাম! কেউ কিচ্ছু কওয়ার নাই, নিজে নিজের মালিক।”
আসলামও মাথা নাড়ল, “হ, কাম কামই, হাল ছাইড়লি অইবো না। শহরে থাইকতে অইলে পইলা নিজেই নিজের জাইগা বানাইতে অইব!”
অরুণ খানিক চুপ করে রইল। ভোরের আবছা আলোতে শহরটা যেন একটু অন্যরকম লাগছে। কেমন একটা অচেনা রহস্যে মোড়া, আবার ভয় মেশানোও। খোলা জানালা দিয়ে আশে-পাশের এলাকাটা দেখা যায়। রেল স্টেশনটাও নজরে পড়লো। রাস্তায় জমে থাকা ময়লার আবর্জনা থেকে কেমন একটা বমিবমি ভাব হওয়া পচা বিশ্রী গন্ধ বাতাসে ভেসে আসছে। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে তখন হালকা ভিড়, কেউ ঘুম থেকে উঠে আলসেমি ভাঙছে, কেউ বা তাড়াহুড়োয় ব্যাগ গুছিয়ে ছুটছে কোথাও। পাশে ফুটপাতে রাত কাটানো মানুষেরা লেপ কম্বল গুটিয়ে নিচ্ছে।
এই সব দেখে অরুণ একটু আনমনা হয়ে গেল। হঠাৎ পাশ থেকে কারো ভাঙ্গা ভাঙ্গা কথা ভেসে এলো— কি রে মটু, কই যাইলি এত্তো সহাল সহাল।“
শব্দ শুনে অরুণ চোখ ঘোরালো। বস্তির মোড়ের চায়ের দোকানের মালিক, এক হাতে চায়ের ভাঁড়, অন্য হাতে আগুনে গরম করা বিস্কুট।
“হাইটতে গেলাম গো চাচা”-হাত নেড়ে হাঁটতে হাঁটতে মটু মুখ ঘুড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে বলে।
চাচা ভুরু কুঁচকে বলল, — হাঁটতে? হেহ হেহ! দ্যাখ গাঁয়ের মানুষও শহরে ঢুইক্কা বদলাইয়া যায়! মটু আবার হাইট্যা বেড়ায়।
ওদিকে গলির ধারে এক মহিলা ন্যাতানো শাড়ি গায়ে, চুল এলোমেলো করে গজগজ করতেছিল, — আরে কেডা রে এত সহাল চিল্যাইতাছ? গতরে মাল পড়ছে নাহি? এক্কেবারে শান্তি নাইকা!
চায়ের দোকানের পাশে খুপরির মতো একটা চালাঘর, ওখান থেকে একজন আধা চোখ খুলে বলল, — উফফ, ভোর হইলে মানুষগর মাতাডা খারাপ অইয়া যায়। হালাগ চেঁচামেচিতে আমার ঘুমটা মাটি হইয়া গেইলো।
এক পাশে আরেক চাচা বিড়বিড় করতে করতে গঙ্গাফড়িংয়ের মতো হাত নেড়ে বলল, — হেই মটু, তোরে কইলাম, জীবনে বড় অইতে হইলে ভোরবেলা বইসা শহর দেইখ্যা লাভ নাই! কাম কর, কাম! বুঝলি?
মটু না শোনার ভান করল। মিটিমিটি হেসে একটু সামনে গেল। রেল স্টেশনের হালকা কুয়াশার ভেতর দিয়ে লোকজনের আনাগোনা। একটা কাক এসে ফুটপাতে রাত কাটানো এক লোকের পাশে ঠুকরে ঠুকরে দেখছে কিছু পড়ে আছে কি না।
পাশেই রেল লাইন ঘেঁষা চায়ের দোকানে চাচা কেটলির মুখে কাপড় দিয়ে ফুঁ দিচ্ছে, ধোঁয়া উড়ছে। এক কোণায় দু'জন ছেলে চুপচাপ বিড়ির ধোঁয়া উড়াইতেছে।
— কিরে, কই যাস?
মটুর কথা আর শুনতে পেলো না। পাশ থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এলো।
রেললাইনের ওপার থেকে একটা পুরনো ইঞ্জিনের হুইসেল ভেসে এলো, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাশের গলির কুকুরগুলোও ঘেউ-ঘেউ করে উঠল। ক্ষুধার তাড়নায় তারা এদিক-সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে, ডাস্টবিনে নাক গলাচ্ছে। দূরে এক চায়ের দোকান থেকে এলোমেলো কথার আওয়াজ, কাঁচের গ্লাসে চামচ ঠোকাঠুকির টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে।
অরুণ চারপাশটা দেখল। শহরের সকালটা যেন ব্যস্ততার আগুনে ধীরে ধীরে জ্বলে উঠছে। এখানে কেউ থামে না, কেউ পেছন ফিরে তাকায় না। সে বুঝতে পারল, তার সামনেও শুধু একটাই রাস্তা খোলা—এগিয়ে যাওয়া।
সে গভীর শ্বাস নিলো। শরীরের প্রতিটা কোণা যেন নতুন এক শক্তি টের পেল। পিছু হটার সুযোগ নেই, কারণ শহরটা কাউকে অপেক্ষা করতে শেখায় না!
হঠাৎ আসলামের কণ্ঠে চমকে উঠল অরুণ—
“অরুণ দা, কিতা এত ভাবতাছ? চল চল। কাল মনে হয় তোমার পেটে কিচ্ছু পড়ে নাই। বিল্ডিংয়ের বাইরেই টিউবওয়েল আছে, হাত-মুখ ধুইয়া আইয়। আর পায়খানা-পিচ্ছাব বাইর থেইক্য কইরা আইস। বিল্ডিংয়ের ডানদিক্যা একটু হাইট্যা গেলেই একটা ভাঙ্গা-চোড়া পায়খানার ঘর দেইখবা। কল থেইক্যা পানি লইয়া যাইও।”
এই বলে ডান হাত দিয়ে একদিকে ইশারা করল আসলাম—
“ঐ দেইখ্য লও, ঐহানে ঘইট্যা আছে! তাড়াতাড়ি যাও, আমরা আজ তোমারে পরডা-ডাল খাওয়াইতাম।”
তমাল গলায় একটা আলস্যের টান এনে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভালই অইব। একসাথে খাইলে মজাই আলাদা! ফুটপাতের পাশে যে মহিলাডা বসে, আমাগো চাচি, সে ভালই পরডা বানায়। গরম গরম পরডার লগে মশলা দেওয়া ডাল—উফ! একবার খাইলে মনে হইব, লাইফটা উড়তে থাকে। লাইফটা এক্কেবারে খালাশ!”
তমালের কথা শুনে না হেসে পারল না অরুণ। এই দুটো ছেলে, যাদের সঙ্গে তার পরিচয় মোটে এই ভোরে, তাদের আন্তরিকতায় বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত কৃতজ্ঞতা জমে উঠল।
একবার ফ্যালফ্যাল করে ওদের দিকে তাকাল সে। শহরটা যেন এখন একটু কম অচেনা লাগছে। কিছুক্ষণ আগেও যে চারপাশটা তার জন্য শুধুই শূন্যতা ছিল, এখন সেখানে দুটো হাসিমুখ দেখা যাচ্ছে।
সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল পায়খানার দিকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, “চল, শহর! দেখি, তোকে কেমনে জয় করি!”
অরুণ হাত-মুখ ধুয়ে এসে দেখে, আসলাম আর তমাল আগেই চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে আছে। ফুটপাতের পাশে ছোট্ট একটা দোকান, আগুনের উনুনে চুলোয় গরম তাওয়া বসানো। একপাশে এক বয়স্ক মহিলা তেলে ভাজা পরোটা নামাচ্ছেন, আরেক পাশে ডাল ফুটছে, তার গন্ধে সকালটা যেন আরও বেশি মাখনের মতো নরম লাগছে।
তমাল: (গরম চায়ের কাপে ফুঁ দিতে দিতে) “এই শহরডাতে বইসা বইসা খাইতে চাইলে কপালে দুঃখ পাইবা। কাম কাইজত করতেই অইব।”
অরুণ: (পরোটার দিকে তাকিয়ে) “ঠিক। কিন্তু শুরুটা কেমনে করব ভাবতে পারতেছি না।”
আসলাম: (একটা পরোটা ছিঁড়ে ডালে চুবিয়ে মুখে দিতে দিতে) “কোন চিন্তা নাই। প্রথ্থমে কিছু একটা ধইরতে অইব। কাম তো অনেক আছে, দেখবা একটু খোঁজ কইরলেই কিছু একটা পাইবা। বাজারের দোকানে হেল্পারের দরকার পড়ে, গ্যারাজেও লোক নেয়, না হয় আমাগো মতো সিগারেট-পান বেচতে পারবা।”
তমাল: “হ, আমাগো লাইনে কষ্ট আছে, কিন্তু স্বাধীনতা বেশি। কারো গালমন্দ নাইক্যা, নিজের কাম নিজে কইরবা। !”
অরুণ: (একটু ভেবে) “দেইখি, আজ সারাদিন ঘুইরা কিছু পাই কিনা! তোমাগো মতো বাক্স ঝুলাইতে মন চায় না। তার চেয়ে যদি কোন দোকানে কাম পাই, তাইলে বুইঝা নিতাম কেমন যায়গা।”
আসলাম: (হাসতে হাসতে) “ঠিকই কইছস! আপাতত ঘুইরা দ্যাখ। সইন্ধ্যায় আমাগো লগে দেখা অইব। সইন্ধ্যা হইলে একসাথে বইসা খামু। ঠিক আছে দোস্ত? কাজ পাইলে তো আমাগরে আবার ভুইল্যা টুইল্যা যাইবা।”
সবাই হেসে উঠল। গরম গরম পরোটা আর ডাল শেষ করতে করতে শহরটা যেন একটু একটু করে আপন হয়ে উঠছিল অরুণের কাছে।
খাবার শেষ হতেই তিনজন যে যার পথে বেরিয়ে পড়ল। তমাল ব্যাগ কাঁধে ফেলে দোকানির কাছ থেকে পান-সিগারেটের বাক্স নিয়ে নিলো। আসলাম গেল স্টেশনের আশেপাশে খদ্দের ধরতে। আর অরুণ, সে ধীর পায়ে হাঁটতে লাগল নতুন একটা শুরু খুঁজতে…
শহরের কোলাহলে তারা এক সময় হারিয়ে যাবে।
হঠাৎ কারো গলার আওয়াজে অরুণ দাঁড়িয়ে পড়লো। ঘাড় ঘুড়িয়ে স্টেশনে চোখ পড়তেই একটা ময়লা লুঙ্গি পড়া আসলামকে চোখে পড়লো হাতে দু'একটা পান আর সিগারেটের প্যাকেট ধরে হাঁক দিচ্ছে,
— এই যে মিয়া ভাইরা একখানে মাল আছে, একদম খাসা! পান চাইলে রস দিয়া দিমু, সিগারেট লাগলে আগুন দিমু!
একজন লোক হালকা বিরক্ত মুখে তাকাতেই আসলাম হাসি হাসি মুখ করে বলল, — আরে নিয়া যান ভাই, সকাল সকাল ঠোঁটটা রঙিন হইয়া যাক! একবার খান, বারবার আইবেন। কইয়া দিলাম।
পাশে বসা রিকশাওয়ালা কাশি দিয়া বলল, — কেডা কইলো তোদের পান ভালো? গুড়া সুপুরি দিয়া বেইচ্চা দিছোস!
আসলাম হেসে বলল, — আরে চাচা, একবার খাইলেই টের পাইবেন, খাঁটি মাল! না খাইয়া কেমন কইলেন?
কোন এক যাত্রী তাড়া তাড়ি সিগারেট কিনতে চাইলে আসলাম তড়াক করে এক প্যাকেট বের করে বলল, — এই নেন, একদম দোকানের চাইতে কম দাম। চাইলে লাইটার দিয়া দিমু, এক্কেবারে ফাউ!
লোকটা টাকা বের করতে গিয়া একটু দেরি করতেই আসলাম মুখ বাঁকিয়ে বলল, — আহা, টেহাডা দিয়া দেন তাড়াতাড়ি, দেন ভাই, দেন।
একপাশে বসে থাকা কুলি হাত তুলে ডাক দিল, — এই পানভাই, দুইখান পান লাইগবে! খাঁটি সুপুরি দিয়া দিইবা কইছি!
আসলাম দৌড়াইয়া গিয়া বলল, — আরে চাচা, আপনের লাইগ্যা তো নিজের হাতে মসলা মিশাইয়া দিমু। বাবা জর্দা লাগাইয়া দিমু।
আসলামের দিকে বেশ কিছুক্ষন অরুণ হা করে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে-“আমার দ্বারা এইসব হইব না।“
শহরের গলিগুলো যেন বিশাল এক গোলকধাঁধা। ফুটপাতের ধুলো উড়ছে, রিকশা-ভ্যানের ঘণ্টা বাজছে, দূরে ট্রাফিক পুলিশের শিস শোনা যাচ্ছে। অরুণ কাজের খোঁজে এবার নিজের পথ ধরলো।
প্রথমে রেল ষ্টেশনের পাশে গুলিস্তানের একটা মার্কেটে ঢুকলো। কয়েকশ দোকানে ঠাঁসা মার্কেটটি। মার্কেটে ঢুকতেই এক পাশে চোখে পড়লো একটি মুদি দোকান। ছোটখাটো সেই মুদি দোকানে ঢুকল সে। ভেতরে একটা মোটা ভুঁড়িওয়ালা লোক, চোখে মোটা কাচের চশমা, হিসাবপত্র লিখছে।
অরুণ: “কাকা, একটা কাম খুঁজতেছি। আপনার এখানে কোন কাজ আছেনি?”
দোকানি: (উঁচু গলায়) “হালা, কাম লাগব ক্যান? টাকা চুরির ধান্দা নাকি? এইসব পোলাপানরে আমি চিনি। লবন কম দিয়া চাল বেশি লইয়া গরিবের পয়সা মারতে শিখছ নাকি?”
অরুণ থতমত খেয়ে গেল। কিছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে এলো। লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে গেলো। মার্কেটের আর কোন দোকানে ঢুকার সাহস করলো না। লোকটার কথা শুনে ওর কেমন শরম লাগছে।
সেখান থেকে সোজা বেড়িয়ে হাঁটতে লাগো কিছুদূর আসতেই রেল স্টেশনের উত্তর দিকে একটি মেকানিক গ্যারাজের সামনে এসে দাঁড়ালো।
ভেতরে চার-পাঁচজন লোক, কেউ রেঞ্জ ঘোরাচ্ছে, কেউ তেলের কৌটা হাতে নিয়ে গাড়ির নিচে ঢুকছে।
অরুণ: “ভাই, একটা কাজ চাই। যা খুশি করমু”
গ্যারাজ মালিক মধ্য বয়সী এক দীর্ঘকায় শ্যামবর্ণা একটি লোক একটা বিড়ি ধরিয়ে বলল, “কাজ করবি? তেল-মবিলের গন্ধ সহ্য করবি? হাতে কাটা লাগলে চুপচাপ থাকবি?”
অরুণ: “জী ভাই, কিছু একটা দরকার।”
মালিক একটা টুলে বসে বলল, “ঠিক আছে, পইলা এক লিটার চা আন, লগে দশটা বিড়ি। তাড়াতাড়ি কর।”
অরুণ একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। কিন্তু কিছু বলার আগেই পাশের এক মেকানিক ফিক করে হেসে বলল, “এই ভাই, চা আনতে আইছে না, কাম খুঁজতে আইছে।”
মালিক রেগে গিয়ে বলল, “তয় ঠিক আছে, কাম লাগব না। চল ফুইট্টা!”
অরুণ খুব অবাক হয়ে লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মনের ভেতরে এক চাপা আর্তনাদ। ভাবতে লাগলো-“মানুষ এতো খারাপ হয় কেমনে?”
নিজকে কেমন জানি খুব ক্লান্ত লাগছে। মাথার উপর রোদ বাড়তে লাগলো। রোদের মধ্যেই এদিক সেদিক ঘুরতে লাগলো। অনেকক্ষণ ঘুরাঘুরির পর একটা ছোট খাবারের দোকানে ঢুকল অরুণ। কাস্টমার কম, ভিতরে শুধু এক বুড়ো মালিক চেয়ারে বসে পান চিবোচ্ছে।
অরুণ: “চাচা, একটা কাজ দরকার। থালা বাসন মাজার কাম করমু, কিচ্ছু সমস্যা নাই।”
বুড়ো লোকটা তাকিয়ে বলল, “তুই নতুন? কই থিকা আইলি?”
অরুণ: “গ্রাম থেইকা আসছি।”
বুড়ো চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “গ্রামের পোলাপান বেশি দিন টিকতে পারে না। দুইদিন পর বাড়ী থাইক্যা খবর আইব, চইলা যাবি। তাইলে আমার কাম কেডা করব? যা, অন্য কোথাও যা!”
অরুণ মাথা নিচু করে বের হয়ে এলো।
ফুটপাতের পাশে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা ফলের দোকানে সামনে এলো। মালিক একটা আপেল ঘষতে ঘষতে বলল, “কাজ করবি? বেতন নাই, খাবার দিবো।”
অরুণ: “তাহলে থাক।”
মালিক: (হাসতে হাসতে) “বেটা, শর্ত শুইনা আইছস? তোর মতো হাজারটা পোলাপান আইসা কাম চাইয়া চইলা যায়!”
অরুণ হতাশ হয়ে পেছন ফিরে হাঁটতে লাগল।
সারাদিন গুলিস্তানের আশে-পাশের এলাকায় অনেক জায়গায়ই ঢু মেরেছে অরুণ। কিন্তু কপালে কিছুই ঝুটলোনা। শুধু অপমান আর ব্যর্থতার ভার নিয়েই শেষ পর্যন্ত সেই পুরনো জায়গায় ফিরে এলো যেখানে সকালে আসলাম আর তমালের সঙ্গে খেয়েছিল। সকালের পর পেটে আর কিছুই পড়েনি। ঘোরাঘোড়িতে শরীরটা বেশ দুর্বল লাগছে। দিনের দাবদাহের শেষ প্রান্তে সন্ধ্যার আবছা আলোয় এই ব্যস্ত শহরটাও যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার হুইসেল কানে বাজছে, ফুটপাতে আলো জ্বলছে। চায়ের দোকানে কাচের গ্লাসের ঠোকাঠুকি শোনা যাচ্ছে।
সেখানে তখন আসলাম আর তমাল সামনের ভাঙ্গা বেঞ্চটিতে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। অরুণকে দেখে তমাল ডাক দিল—
“এই অরুণ দা! কিতা অবস্থা? কাম পাইলা?”
অরুণ কাছে এসে চুপচাপ একটা ইটের উপর বসে পড়ল। চোখ-মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, দিনটা মোটেও ভালো কাটেনি।
আসলাম এবার গলাটা সামনে এনে আস্তে করে কিছুটা চিন্তিত স্বরে বলল, “কি অইলো? কথা কইতেছনা কা? কেউ কিছু কইছে?”
অরুণ এবার একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “শহরে কাম খোঁজা এতো কঠিন জানতাম না। আমার ভাগ্যটাই খারাপ। মানুষের মধ্যে দয়া-মায়া কিচ্ছু নাই, আসলাম ভাই। মানুষ খুব ইতর। কাজ দেয়া তো দুরের কথা ভালো ভাবেও কেউ কথা বলে না। কেউ অপমান করে, কেউ ধমক দেয়, কেউ ফালতু কামে লাগাইতে চায়। আবার কেউ কেউ বলে চুরি করার ধান্ধা নাকি আমার।”
তমাল ফিক করে হেসে বলল, “এইডাই শহর দাদা! এখানে কেউ তোমারে প্লেইটে ভাত দিয়া জামাই আদরে বরণ কইরা নিইবো না।”
আসলাম একটু গম্ভীর গলায় বলল, “হাল ছাড়লি অইব না অরুণ দা! সব হগলের জন্য না। খুঁজতে অইব। আজ অইল না, কাল অইব।”
তমাল যোগ দিল, “এখন বেশি ভাইব্ব না। চল, খাইতে যাই। সব দুঃখের অষুধ হইল এক প্লেট গরম গরম ডাল-পরোডা।”
অরুণ মুখে হাসি আনতে চাইল, কিন্তু পারল না। পকেটের কয়টা টাকা হাতে নিলো। আসলাম তার কাঁধে আবার একটা চাপ দিয়ে বলল,
“আরে ভাইব না! আমরা ভাই ভাই। চল, খাই, তারপর কাল আবার দেখা যাইব।”
তিনজন ধীর পায়ে ফুটপাতের খাবারের দোকানের দিকে হাঁটতে লাগল। শহরটা নিষ্ঠুর, কিন্তু কিছু মানুষ এখনও আস্থা রাখে বন্ধুত্বে।
চলবে—
ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট