যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য সম্পর্কে ফাটল, নাকি উত্তেজনার ইঙ্গিত?
সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি ইস্যুর মধ্যেই দেশটির সরকার সাময়িকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কিছু গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় স্থগিত করেছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটির সরকার মার্কিন সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ক্যারিবীয় সাগরে নৌযানের ওপর প্রাণঘাতী হামলার বৈধতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এ পদক্ষেপ নিয়েছে। কেইর স্টারমার সরকারের এ সিদ্ধান্তকে দুই ঐতিহ্যগত মিত্র দেশের গোয়েন্দা সহযোগিতায় নজিরবিহীন এক ফাটল হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, তথ্য বিনিময় স্থগিতের সিদ্ধান্ত এক মাসেরও বেশি আগ থেকে কার্যকর রয়েছে।
লন্ডন মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের এসব হামলা অবৈধ এবং সে কারণে যুক্তরাজ্য এসব অভিযানে অংশ নিতে চায় না।
আর এই সিদ্ধান্ত মূলত যুক্তরাজ্যের ঘনিষ্ঠতম গোয়েন্দা সহযোগীর কাছ থেকে দূরত্ব তৈরির ইঙ্গিত দেয়। পাশাপাশি লাতিন আমেরিকায় মার্কিন সামরিক পদক্ষেপের বৈধতা নিয়ে বাড়তে থাকা সন্দেহকে জোরদার করে।
যুক্তরাজ্য দীর্ঘদিন ধরে ক্যারিবীয় অঞ্চলের কয়েকটি দ্বীপাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে আসছে এবং সেসব স্থানে গোয়েন্দা ঘাঁটিও পরিচালনা করছে। অতীতে লন্ডন ওই অঞ্চলে মাদকবাহী সন্দেহভাজন জাহাজ শনাক্ত করে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করত। এসব তথ্য সাধারণত ফ্লোরিডাভিত্তিক ‘জয়েন্ট ইন্টারএজেন্সি টাস্ক ফোর্স–সাউথ’-এ পাঠানো হতো। সেখানে একাধিক মার্কিন মিত্র দেশ যুক্ত রয়েছে। তাদের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল মাদক পাচারের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছু মাদকচক্রকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ ঘোষণা করে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, এই সামরিক অভিযানগুলো ‘যুদ্ধবিধি অনুযায়ী বৈধ’।
তবে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ব্যাখ্যা আইনি ভিত্তিহীন, কারণ মাদককারবারিরা বেসামরিক নাগরিক হিসেবে বিবেচিত এবং বিচার ছাড়া তাদের হত্যা করা ন্যায়বিচারের মৌলিক নীতির পরিপন্থি।
গত সেপ্টেম্বর থেকেই মার্কিন সামরিক বাহিনী সন্দেহভাজন নৌযানের ওপর প্রাণঘাতী হামলা শুরুর পর ব্রিটিশ কর্মকর্তারা এটা ভেবে উদ্বেগে রয়েছেন যে, লন্ডনের সরবরাহকৃত তথ্য এসব লক্ষ্যবস্তুতে হামলার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব অভিযানে অন্তত ৭৬ জন নিহত হয়েছেন। ব্রিটিশ কর্মকর্তারা মনে করেন, এটি আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
ফ্রান্সও এই হামলাগুলোর সমালোচনা করেছে। ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জঁ-নোয়েল ব্যারোট বলেছেন, ক্যারিবীয় অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে এবং সামরিক কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইন উপেক্ষা করছে।
এই ঘটনাপ্রবাহ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তথাকথিত ‘মাদকবিরোধী অভিযান’ বিষয়ে বিভাজনকে স্পষ্ট করেছে এবং ট্রাম্প প্রশাসনের একতরফা নীতি ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণকে আরও উন্মোচন করেছে। যদিও লন্ডন সবসময় ওয়াশিংটনের সঙ্গে সমন্বয় রাখতে চেষ্টা করেছে, তবুও ক্যারিবীয় সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের এসব অস্বাভাবিক সামরিক পদক্ষেপের কারণে যুক্তরাজ্য নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, যার ফলাফল হলো তথ্য বিনিময় স্থগিত।
আর এই তথ্য বিনিময় বন্ধ হওয়া দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনের ইঙ্গিত দেয় এবং তা গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক প্রভাব ফেলতে পারে। গোয়েন্দা সহযোগিতা যুক্তরাজ্য–আমেরিকা নিরাপত্তা সম্পর্কের অন্যতম স্তম্ভ; এ ক্ষেত্রে যেকোনো ব্যাঘাত পারস্পরিক আস্থা হ্রাস ও সন্ত্রাসবিরোধী বা সাইবার নিরাপত্তা ইস্যুতেও সমন্বয় দুর্বল করতে পারে।
সার্বিকভাবে এই ঘটনা যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে মার্কিন সামরিক কার্যক্রমের বৈধতা নিয়ে নতুন আইনি ও নৈতিক সংবেদনশীলতার প্রতিফলন। সঠিকভাবে সামাল না দিলে এটি আটলান্টিক পারের দুই মিত্রের মধ্যে সম্পর্কের উত্তেজনা আরও বাড়াতে পারে।
জাতিসংঘও যুক্তরাষ্ট্রের এসব হামলাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভল্কার টার্ক গত মাসে এই হামলাকে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ বলে বর্ণনা করেছেন। জানা গেছে, লন্ডনও এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত।
