শ্রীচরেণেষু দাদা: আট

Bangla Post Desk
ড. পল্টু দত্ত
প্রকাশিত:০৫ মার্চ ২০২৫, ০২:৪৬ পিএম
শ্রীচরেণেষু দাদা: আট

চারিদিক ঘন কুয়াশায় ঢাকা জানুয়ারির মাঝামাঝি এই সময়টায় প্রকৃতি যেন গুটি শুটি মেরে নিজকে লুকিয়ে রেখেছে। লাইব্রেরির দেয়ালের ঠিক মাঝখানটায় ঝোলানো ক্যালেন্ডারে ১৫ তারিখটা বেশ স্পষ্ট। আর কয়েকদিন পরই শুভ্র দেশে যাবে। সময় যেন দ্রুত এগিয়ে চলছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে জীবনটাও এগুচ্ছে।  কিন্তু শুভ্রর মনে আজ সময়টা যেন হঠাৎ করেই থমকে গেছে। 

বেশ দিব্যি নিয়ে শীত যেন ঝাঁকিয়ে বসেছে পুরো লন্ডন শহরে। কনকনে ঠাণ্ডায় প্রকৃতি স্তব্ধ, নিঃসঙ্গ, যেন মৌনতার গভীর ধ্যানে নিমগ্ন। শুভ্রদের বসবাসের এলাকা যেন নিস্তব্ধতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন। চারপাশে সবুজের আবরণ, গাছগাছালির স্নিগ্ধ ছায়া, প্রকৃতি যেন আপন মহিমায় সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে। গ্রাম্য পরিবেশের মতোই প্রশান্ত, নীরবতা এখানে রাজত্ব করে। মাঝরাতে যখন চারপাশ গভীর নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন, তখন হঠাৎ করেই খেঁকশিয়ালের কর্কশ চিৎকার সেই নীরবতা চিরে দেয়, যেন অদৃশ্য কোনো অশরীরী সত্তা নিদ্রার বাঁধ ভেঙে ডাক দেয় অজানা এক জগতে। 

প্রতিদিনের মতো খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠে শুভ্র। সতেজ বাতাসে এক গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে জানালার দিকে তাকায়। আকাশটা আজ ভারী, যেন এক অদৃশ্য মেঘের চাদরে ঢাকা। চারপাশে এক ধরনের শূন্যতা ছড়িয়ে আছে, কোথাও কোনো পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে না। জানালার কাচে জমে থাকা শিশিরবিন্দুগুলো ধীরে ধীরে গলে পড়ছে, কিন্তু শীতের তীক্ষ্ণ কামড়ে প্রকৃতি যেন স্থবির হয়ে আছে। কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থাকার পর শুভ্র নিজের দৈনন্দিন কাজগুলো সেরে নেয়। সকালে ঘাম ঝরিয়ে শরীরচর্চা করে, তারপর স্নান সেরে আসে। টয়লেট, হাত-মুখ ধোয়া, দাঁত মাজার পর সে নিজেকে বেশ সতেজ অনুভব করে। এরপর নিচে নেমে আসে, এক অজানা অনুভূতিতে মন ভরে ওঠে, যেন প্রকৃতির নিস্তব্ধতার মাঝেও এক রহস্য লুকিয়ে আছে।

নিয়মমতো সকালের খাবারটা সেরে নিয়ে শুভ্র এক কাপ গরম চা হাতে নিয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকে চেয়ারটা টেনে  জানালার পাশে এসে বসে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলো বাইরের দিকে। শুন শান রাস্তা। পথচারী নাই বললেই চলে। শীতের সকালটা ছিল অন্য দিনের মতোই। তবু কেন জানি সেই দিনের সেই সকালটা একটু অন্যরকমই লাগছিল শুভ্রের কাছে। বুকের ভেতর কোথাও যেন একটা অজানা শঙ্কা কাজ করছিল। তখনও শুভ্র জানত না, এই দিনটা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে।

ভোরের দিকে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিল শুভ্র। স্বপ্নটা এতটাই স্পষ্ট ছিল যে, যেন সে সত্যিই সেটার মধ্যে ডুবে ছিল অনেকক্ষণ। স্বপ্নের মধ্যেও তার মনে হচ্ছিল, কিছু একটা অশুভ অপেক্ষা করছে। কতদিন স্বপ্নের ঘোরে সে চিৎকার করে উঠে ঘুম ভেঙেছে, পাশে শুয়ে থাকা সুতপা তখন উদ্বিগ্ন হয়ে হাত দিয়ে ডাকত। কিন্তু আজ? সেই স্বপ্নের গভীরে তলিয়ে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ পর সুতপার ডাকে ঘুম ভাঙ্গে।

সে নিজেকে এক বিশাল পিঁপড়ের পাহাড়ে আবিষ্কার করল। পাহাড় নয়, যেন এক জীবন্ত দানব! অজস্র পিঁপড়ে তার চারপাশে সরসর করে ছুটে বেড়াচ্ছে। কালো, লালচে রঙের পিঁপড়ের দল যেন জেগে উঠেছে কোনো ভয়ংকর অভিশাপের মতো। তার শরীর জুড়ে হাজার হাজার পিঁপড়ে উঠে আসছে, গা বেয়ে নামছে, তাকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলছে।

শুভ্র স্বপ্নের মধ্যেই শিউরে উঠল। এই পিঁপড়েগুলো সাধারণ পিঁপড়ে নয়, এদের গায়ে ভয়ংকর দংশনের ক্ষমতা। কিছু পিঁপড়ে এতটাই বিষাক্ত ছিল যে, এক কামড়েই তীব্র জ্বালা ধরে যায়, যেন কেউ তপ্ত আগুনের ছোঁয়া দিয়েছে। ব্রাজিলের "বুলেট অ্যান্ট" বা বিষাক্ত লাল পিঁপড়ের কথা মনে পড়ল তার, যাদের কামড় এমন ভয়ংকর যে, মানুষের স্নায়ু অবশ হয়ে যায়। পাগলের মতো হাত-পা ছুঁড়তে লাগল শুভ্র, জোড়ে জোড়ে চীৎকার করতে লাগল। কিন্তু তার ভয়ানক চীৎকার যেন কেউ শুনছে না। পিঁপড়ের দল সড়ে পরছে না বরং আরো গতিতে শুভ্রের নাকে কানে, ঠেঁটি চোখের পাশে অতি আনন্দে কামড়ে দিচ্ছে।

তার শরীর জুড়ে বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা ব্যথা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। চামড়ার নিচে যেন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে! সে আরো জোড়ে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। মনে হলো, পিঁপড়েগুলো শুধু কামড়াচ্ছে না, বরং তার দেহের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে গিলে ফেলছে তাকে!

শুভ্র শ্বাস নিতে পারছিল না। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। তার মুখের ভেতরেও ঢুকে পড়ছে কিছু পিঁপড়ে! গলা দিয়ে সরসর করে নামছে, ফুসফুসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ প্রবল এক ধাক্কায় শুভ্রর ঘুম ভেঙে গেল। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, বুক ধড়ফড় করছে। তার পাশে সুতপা উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে।

"শুভ্র! কি হলো তোমার? দুঃস্বপ্ন বুঝি?"

শুভ্র হাঁপাতে হাঁপাতে চারপাশ দেখল। পিঁপড়ের পাহাড় নেই, শরীরের ওপর কোনো পিঁপড়েও নেই। কিন্তু বুকের ভেতর সেই দুঃস্বপ্নের আতঙ্ক এখনো জীবন্ত, তার হাত-পা এখনো কাঁপছে।

সুতপা তার কাঁধে হাত রাখল, "স্বপ্ন দেখেছ, তাই তো?"

শুভ্র কিছু বলল না। মনে হচ্ছিল, এই স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন ছিল না। এটা ছিল এক অশুভ ইঙ্গিত… যেন কিছু একটা খুব খারাপ ঘটতে চলেছে।

শীতের স্নিগ্ধ সকালে অভ্যাসমতো গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে শুভ্র লাইব্রেরির নরম আলোয় কাজ করছিল। জানালার বাইরে কুয়াশার আবরণ ধীরে ধীরে সরছে, আর ভেতরে বইয়ের পাতায় জড়িয়ে থাকা শব্দেরা যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। ইউটিউবে বাজছিল নজরুলগীতি—তার চিরচেনা প্রিয় সুর, যা মনে এনে দেয় এক অনাবিল প্রশান্তি। সকালবেলার এই নির্জন, কাব্যময় মুহূর্তটাই শুভ্রর সবচেয়ে প্রিয়। এ সময়টায় কলমের সঙ্গেই তার সবচেয়ে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। শব্দেরা আপন ইচ্ছায় এসে লিপিবদ্ধ হয় ল্যাপটপের স্ক্রিনের উপর। চিন্তার জগতে ছড়িয়ে পড়ে এক গভীর সৃজনশীল স্পন্দন। ডান হাতে ঠক ঠক করে অভ্র মাউসে বাংলা অক্ষরের উপর ক্লিক করতে করতে অক্ষরে, শব্দ আর বাক্যের পর বাক্য সাজিয়ে ভাবনাগুলো প্রকাশ করতে থাকে। মনে হয়, এই সময়টা শুধু তার জন্যই এসেছে—একটা মনস্তাত্ত্বিক আনন্দ আর সৌন্দর্যের ছোঁয়ায় দেহ-মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দিতে।

জীবন চলছিল তার নিজস্ব সুরে, একেবারে শুভ্র যেমনটা চেয়েছিল—নিয়মের ছন্দে বাঁধা, কিন্তু মনের গভীরে এক অসীম স্বাধীনতা নিয়ে।

হঠাৎ নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে রান্নাঘর থেকে ভেসে এলো এক করুণ কান্নার শব্দ। যেন অচেনা, যেন চিরপরিচিত! শুভ্র থমকে গেল। কান পেতে ভালো করে শোনার চেষ্টা করল। গলা চেনা লাগছে… সুতপা!
তার হৃৎস্পন্দন যেন মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। কিছু একটা ঘটে গেছে! শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার, যেন দম নিতে পারছে না ঠিকমতো। মুহূর্তের মধ্যে চেয়ার ঠেলে উঠে ছুটে গেল রান্নাঘরের দিকে।
সুতপা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নিচু, এলোমেলো চুল তার কপালের ওপর ঝুলে পড়েছে। কাঁধ কাঁপছে কান্নার দমকে। নিঃশব্দ ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। চারপাশের পরিবেশ আরও ভারী হয়ে উঠছে তার কান্নার চাপা শব্দে।

শুভ্র এগিয়ে গেল। তার গলা শুকিয়ে কাঠ। ঠোঁট কাঁপছে, তবু কেমন যেন রোবটের মতো প্রশ্ন করল
"সুতপা, কি হয়েছে?"

সুতপা মুখ তুলল না। শুধু কাঁপতে থাকা শরীর নিয়ে আরও জোরে কাঁদতে লাগল। শুভ্র এবার তার কাঁধে হাত রাখল, স্নিগ্ধ অথচ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল—

"সুতপা, বলো… তুমি কাঁদছো কেন? কি হয়েছে?"

এবার সুতপা যেন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। হঠাৎ করেই তার কান্নার শক্তি আরও বেড়ে গেল। শ্বাস নিতে না পেরে কেঁপে উঠল তার শরীর। এক ঝটকায় ঘুরে শুভ্রের বুকের কাছে মুখ গুঁজে দিল। শুভ্র হতবাক! তার শীতল হাত দুটো ধীরে ধীরে সুতপার কাঁধ আঁকড়ে ধরল, যেন তার ভেতরকার ঝড়টা একটু হলেও সামলাতে পারে।

"দাদা… আর নেই…"

সুতপার ফিসফিস করে বলা এই দুটি শব্দ যেন বজ্রপাতের মতো আঘাত করল শুভ্রর বুকের মধ্যে। শরীরটা জমে গেল তার। চোখের সামনে সবকিছু কেমন যেন আবছা হয়ে এলো। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল যন্ত্রণা।

"কি বলছ তুমি? না… না, এটা সত্যি না। কে বলল তোমাকে?" শুভ্র চিন্তিত স্বরে এক সাথে প্রশ্নগুলি করলো, কিন্তু তার গলা কাঁপছিল।

সুতপা কোনো কথা বলল না, শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলল শুভ্রের বুকের ভেতর মাথা গুঁজে। কান্নার প্রতিটি শব্দ যেন চারপাশের নীরবতাকে আরও ভারী করে তুলছে।

শুভ্রের হাত দুটো ধীরে ধীরে কাঁপতে লাগল। তার চোখের কোণে অজান্তেই জমে উঠল জল। বির বির করতে লাগলো-“এভাবে তো হঠাৎ করে কেউ চলে যেতে পারে না… এভাবে তো দাদা তাদের ছেড়ে যেতে পারে না!”

সারাটি বাড়ি যেন মুহূর্তেই শূন্য হয়ে গেল। বুকের ভেতর এক নিঃশব্দ চিৎকার জন্ম নিল, যা বাইরে বের হলো না—শুধু কান্নার ঢেউয়ে একে অপরকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল দুজন, নিঃসীম শূন্যতার মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে…

"দাদা… নেই?"

বিশ্বাস করতে পারছিল না শুভ্র। সেই অরুণদা, যে তার শৈশবের ছায়া, তার পথপ্রদর্শক, যার হাত ধরে প্রথম হাঁটতে শিখেছিল, যার কাঁধে চড়ে প্রথম আকাশ দেখতে শিখেছিল, সেই দাদা আর নেই? এ কেমন অন্যায়!

ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়লো শুভ্র। বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে এলো, যেন ভিতর থেকে সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। ওর কাঁপতে থাকা কাঁধ, শ্বাসকষ্টের মতো দমবন্ধ হাহাকার দেখে সুতপা থমকে গেল। কিছুক্ষণের জন্য বোঝার চেষ্টা করল, কি বলবে? কীভাবে এই যন্ত্রণা থেকে শুভ্রকে একটু স্বস্তি দেবে?

দ্রুত এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো সুতপা। বুকের কাছে টেনে নিল শক্ত করে, যেন এই মুহূর্তে একটু হলেও ওর কষ্ট ভাগ করে নিতে পারে।

শুভ্র ফিসফিস করে বলল, "এভাবে চলে গেল? 

সুতপা ওর চুলে হাত বুলিয়ে বলল, "সবাইকে একদিন যেতে হয়, শুভ্র… কিন্তু আমি জানি, তুমি এটা মানতে পারছ না।"

শুভ্র ফুঁপিয়ে উঠল, "কিন্তু কেন এখন? এত তাড়াতাড়ি? ভাবতেই পারছি না, এবার দেশে গিয়ে দাদাকে দেখতে পাবো না…।"

শব্দগুলো যেন ওর গলা চেপে ধরছে। গত চল্লিশ বছরে যতবার দেশে গেছে, প্রতিবারই দাদা এয়ারপোর্টে এসেছে। তার জন্য অপেক্ষা করেছে। ফিরে যাওয়ার দিনও দাদা ছলছল চোখে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়েছে। এইবার? এইবার কে আসবে? কে অপেক্ষা করবে?

শুভ্রর শূন্য দৃষ্টি স্থির হয়ে রইল দূরে, অতীতের কোনো এক আঙিনায়।

সুতপা ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, "তুমি তো জানো, দূরে থেকেও দাদা তোমার সঙ্গে ছিল, এখনও আছে… তোমার মনে, তোমার প্রতিটা স্মৃতিতে।"

শুভ্র মাথা নাড়ল, গলায় আর কোনো শব্দ বের হলো না।

সুতপা ওকে শক্ত করে ধরে বলল, "এভাবে ভেঙ্গে পড়ো না। ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করো… উঠে একবার বাড়িতে ফোন দাও। রুপার সাথে একটু কথা বলো।"

সুতপার চোখও ভিজে এল, কিন্তু নিজেকে শক্ত রাখল। শুভ্রর কাঁধে হাত রাখল আলতো করে, যেন ওর সব কান্না নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত পাশে থাকবে… নিঃশব্দে, নীরবে।

এই নির্মম সত্যিটা মেনে নিতে পারছে না শুভ্র। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে উঠছে পুরনো দিনের রঙিন স্মৃতিগুলো—দাদার হাত ধরে প্রথম স্কুলে যাওয়ার সেই দিন, বর্ষার দুপুরে দাদার সঙ্গে ভেজার আনন্দ, শীতের সকালে একসঙ্গে কম্বল গায়ে চাপিয়ে গল্পের বই পড়া, সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে আকাশ দেখা। ঢাকয় কলেজে ভর্তি হওয়া থেকে বিদেশে পড়াশুনার জন্য চলে আসার মুহূর্তগুলোতে দাদার উদ্বিগ্নতার সব স্মৃতি, সব ভালোবাসা যেন মুহূর্তের মধ্যে ধুলোয় মিশে যাচ্ছে।

কয়েকদিন পরেই তো দেশে ফেরার কথা ছিল। দাদার সঙ্গে দেখা হবে, অনেক গল্প হবে, “শ্রীচরণেষু দাদা“কে নিয়ে অনেক কথা শুনবে, জীবন সংগ্রামে লড়ে যাওয়ার গল্প, পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ হবে—কিন্তু বিধাতা কি চায়নি সেই পুনর্মিলন? শুভ্রর বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রণা, শূন্যতা, হাহাকার! কি ভয়ানক নিষ্ঠুর এই জীবন!

মাঝে মাঝে মনে হয়, এই পৃথিবীর সব কিছুই যেন পূর্বনির্ধারিত, যেন কোনো অদৃশ্য বিধাতা আগেই লিখে রেখেছেন সমস্ত সুখ-দুঃখের চিত্রনাট্য। আজকের সকাল শুভ্রর কাছে এক অভিশাপ, এক ভয়ংকর শূন্যতার সকাল। এক মুহূর্তেই সবকিছু যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, সমস্ত সম্পর্ক সময়ের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেল। আজ থেকে তার জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো—এক দুঃসহ, নির্দয় অধ্যায়, যেখানে শুধুই হারানোর কষ্ট, শুধুই অতীতের ছায়া, শুধুই এক বুক বেদনার ভার। তবুও তাকে এগিয়ে যেতে হবে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে স্মৃতির ভার বয়ে, প্রতিটি মুহূর্তে এক অদৃশ্য ভালোবাসার আশ্রয়ে বেঁচে থাকতে হবে।

কিন্তু মানুষ কি সত্যিই হারিয়ে যায়? নাকি সে রয়ে যায় বুকের গহীনে, এক অস্ফুট ভালোবাসায়, এক নিঃশব্দ স্মৃতিতে? শুভ্রর চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুগুলো নীরবে গড়িয়ে পড়ল—এক নিঃশব্দ কান্না, এক দগ্ধ আর্তনাদ, যা কেউ শুনতে পায় না, কিন্তু হৃদয়ের প্রতিটি কোণে প্রতিধ্বনিত হয়।

শুভ্র ফাঁকা চোখে তাকিয়ে রইল... কয়েকদিন আগেও সে বড়দার সঙ্গে কথা বলেছিল। বড়দা তখন দুর্বল গলায় কিছু একটা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু শব্দ গলাতেই আটকে গিয়েছিল। শেষের দিকে রুপাই ভিডিও কলের ব্যবস্থা করত, যাতে অন্তত ভিডিওতে দেখে কথা বলা যায়। পাশে ছিল রুপাও। শুভ্র বুঝতে পারছিল না বড়দা কি বলতে চাইছে।

সে অসহায়ভাবে আবার জিজ্ঞেস করল, আর তখনই রুপা ফিসফিস করে বলল, "বাবা বলছেন, আপনি কবে আসবেন দেশে?"

শুভ্র তখনো নিশ্চিন্ত ছিল। এক মাস পরই তো দেশে যাবে। তাই সহজ গলায় বলেছিল, "আর এক মাস পরেই আসছি।"

বড়দা তখন মাথা নেড়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কথাগুলো ঠিকমতো উচ্চারিত হয়নি। শুভ্র আরেকবার জানতে চাইলে রুপা বলল—

"বাবা বলেছেন, এবার এলে যেন অনেক গল্প করেন, যেন এখানে ক'দিন থাকেন…"

শুভ্রর বুকটা হঠাৎ কেমন ধক করে উঠল। 

শুভ্র স্থির তাকিয়ে রইল… শূন্য, নিঃসঙ্গ, অপার বিষাদে মোড়ানো এই ভাঙাচোরা পৃথিবীর দিকে।

অরুণ দাদার শেষ মুহূর্তের কথা ভাবতেই শুভ্রর চারপাশটা অন্ধকার হয়ে এল। সে জানত, বড়দার শরীর খারাপ ছিল, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি—এত নিঃশব্দে যে চলে যাবে, তা কোনোদিন কল্পনাও করেনি।

শ্রীচরণেষু দাদা”—উপন্যাসটি যেন শুভ্রের বড় দাদার জীবনের একখণ্ড গল্প। খুব ইচ্ছে ছিল প্রথম কপিটি দাদার হাতে তুলে দেবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে গেল। যেসব কথা দাদাকে জীবনে কখনও বলতে পারেনি, সেসব মনের কথা, অনুভূতি আর কৃতজ্ঞতা এই বইয়ের প্রতিটি খণ্ডে, প্রতিটি পাতায়, বাক্যে, শব্দে যেন জড়িয়ে রয়েছে। শুভ্র মনে মনে ভাবে যদি দাদা নিজে পড়ে যেতে পারতেন, হয়তো তাঁর চোখের কোণে জল এসে যেত, হয়তো একটু তৃপ্তি পেতেন। হঠাৎ করেই শুভ্র বির বির করে বলতে লাগলো-

"তোমার মতো দাদা পাওয়া ছিল জীবনের পরম সৌভাগ্য। তোমার স্মৃতি আমার কলমে বেঁচে থাকবে চিরকাল।"
 
“দূর নক্ষত্রের পথে যদি তোমার দেখা মেলে একদিন
তোমার পা ছুঁতে চাই, মুছে নিতে জীবনের ঋণ
যেখানেই থাকো ভালো থেকো মুক্ত আকাশের আলোয়,
তোমার শান্তি যেন মেলে প্রকৃতির অনন্ত কালোয়।“

এক সময় শুভ্র রুপাকে ফোন দেয়।--------

শেষের দিনগুলো বাসায়ই রাখা হয় শুভ্রের দাদাকে। দুটো নার্স দেখাশুনার দায়িত্ব ছিলো। শেষ দিনটায় নিজের রুমে বিছানায় নিঃসঙ্গ শুয়ে ছিল অরুণ দাদা। তার শ্বাস ভারী হয়ে আসছিল, চোখের পাতাগুলো যেন ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছিল ক্লান্ত সূর্যের মতো। পাশে বসে ছিল তার ছোট মেয়ে, রুপা। বাবার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিল সে—এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়েনি। যেন এই হাতটা যদি একবার ছাড়া হয়ে যায়, তবে পুরো পৃথিবীটাই খালি হয়ে যাবে।

"বাবা, তুমি কথা বলছ না কেন?" রুপার কণ্ঠ কেঁপে উঠল, চোখ টলমল করছিল জলভরা মেঘের মতো।

অরুণ ক্লান্ত চোখে মেয়ের দিকে তাকাল। ঠোঁটের কোণে হালকা এক টুকরো হাসি খেলে গেল, যেন বলতে চাইছে—কিছুই তো বদলায়নি, আমি আছি… আমি আছি তোমাদের মাঝেই।

কিন্তু সে জানত, সময় তার অপেক্ষায় নেই। ধীরে ধীরে এক অদৃশ্য আঁধারে ডুবে যাচ্ছিল সে। তবু শেষ শক্তি দিয়ে ফিসফিস করে বলল,

"আমি আছি মা… তোমাদের মাঝেই থাকব।"

রুপা মাথা নাড়ল, কেঁদে উঠল, যেন বাবার এই কথাগুলোকে মেনে নিতে চাইছিল না।

"না বাবা! তুমি ভালো হয়ে যাবে! ডাক্তার বলেছে, আর কয়েকটা দিন… কয়েকটা দিন পরেই তুমি ঠিক হয়ে যাবে!"

অরুণ হালকা শ্বাস ফেলল। সে জানত, তার কাছে ‘আর কয়েকটা দিন’ বলে কিছু নেই। সময় তার গলা চেপে ধরেছে, তাকে ডেকে নিচ্ছে চিরতরে।

রুপা বাবার হাত শক্ত করে ধরে বলল, "বাবা, ছোট কাকা আসবে। কাকা বলেছে, আর কিছুদিন পরেই দেশে আসবে…"

অরুণের ম্লান চোখজোড়া সামান্য উজ্জ্বল হলো। শুভ্র… ছোটভাই। ওকে শেষবারের মতো দেখতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এই মুহূর্তে সে বুঝতে পারছিল, অপেক্ষা করার সময় তার নেই। তবু শেষবারের মতো হাসল, অতি দুর্বল কণ্ঠে বলল,

"শুভ্র তো সবসময় দেরি করে… ও এলে বলিস, আমার দোষ ছিল না। সময়… কারও জন্য অপেক্ষা করে না…"

রুপা বাবার কথা শুনে ব্যাকুল হয়ে উঠল। সে যেন হাল ছাড়তে রাজি নয়। তাড়াতাড়ি মোবাইলটা পাশ থেকে নিয়ে কাকাকে কল দিতে চাইল। ঠিক তখনই রুপার হাতটি চেপে ধরলো রুপার বাবা। রুপা তাকাতেই বুকের হৃদপিণ্ডটা হঠাৎ কেঁপে উঠলো। কি অদ্ভুতভাবে বাবা ফ্যাল ফ্যাল করে মেয়ে রুপার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। তারপর কয়েক সেকেন্ড…… তখনই তার হাতের ভেতর বাবার হাতটা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে এল। ঠাণ্ডা, প্রাণহীন হয়ে গেল আঙুলগুলো।

এক মুহূর্ত… তারপর আরেকটি… তারপর…

হৃৎস্পন্দন থেমে গেল।

"বাবা!"

রুপার দিশেহারা চিৎকারে বাসার শূন্যতা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সময় থেমে গেল, বাতাস থেমে গেল, সবকিছু যেন স্তব্ধ হয়ে গেল এই এক নিমেষে। নার্সরা ছুটে এল, রান্না ঘর থেকে কাজের দিদি ছুটে এলো কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।

রুপার মুখে দাদার শেষ সময়টির কথা শুনে শুভ্রর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল।

সে জানত না, বড়দা শেষ সময়ে তার কথা বলেছিল। জানলে কি সে দেরি করত?

জানলে কি এক মুহূর্তও অপেক্ষা করত?

বুকের ভেতর কেমন শূন্যতা বাজল। যেন সমস্ত পৃথিবীটা হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেছে, এক নিঃসঙ্গ সন্ধ্যার মতো।

বড়দার সেই শেষ হাসি, সেই শেষ কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হতে লাগল কানে—

"সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না…"

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শুভ্র দূরে তাকিয়ে রইল। সকালের নরম আলো ম্লান হয়ে আসছিল, আকাশের গায়ে মেঘের কালো আভা ছড়িয়ে পড়ছিল ধীরে ধীরে। শূন্য দৃষ্টি নিয়ে সে তাকিয়ে রইল দূর আকাশের দিকে, যেন কোথাও খুঁজে পেতে চাইল বড়দার অস্তিত্ব, তার শেষ স্মৃতির কোনো চিহ্ন।
সুতপা ধীরে ধীরে তার কাছে এসে দাঁড়াল। 

"সব ঠিক হয়ে যাবে, শুভ্র।" সুতপার কণ্ঠে ছিল মায়াভরা আশ্বাস, কিন্তু তাতেও যেন কোনো ওজন ছিল না।

শুভ্র নীরব। চোখের কোণে জমে থাকা জল সে আটকে রেখেছে, যেন একবার বেরিয়ে এলে আর কিছুই তাকে ধরে রাখতে পারবে না।

"তুমি বড়দার কাছে যেতে পারনি, কিন্তু ওনার স্মৃতির কাছে তো আছো। ওনি তো তোমার মনের ভেতরেই বেঁচে থাকবে, ঠিক যেমন ছিল। এবার দেরি করো না, তাড়াতাড়ি ফ্লাইটটা চেঞ্জ করে নাও।"
শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

বাইরে সূর্য মধ্য আকাশে। মেঘের ফাঁকে সোনালি আলোর লুকোচুরি যেন দিনের মধ্য প্রহরের বিষাদের শেষ নিঃশ্বাস ফেলছে পৃথিবী।

আজ সূর্য অন্ত গেলে বড়দা আর কোনো ভোর দেখবে না…

আর কোনো নতুন দিন তার জীবনে আসবে না…

কিন্তু স্মৃতির আলো কি কখনো নিভে যায়? শুভ্র জানে, বড়দার অস্তিত্ব এখনো আছে—তার কথায়, তার হাসিতে, তার ফেলে যাওয়া গল্পগুলোর ভাঁজে।

তারপরও জীবন থেমে থাকে না। সূর্য অন্ত গেলেও পরের দিন আবার উঠে আসে।

শুভ্র জানে, তাকেও এগিয়ে যেতে হবে… বড়দার স্মৃতি বুকে নিয়ে, ভালোবাসার ছায়ায় বেঁচে থেকে… নতুন ভোরের অপেক্ষায়।

চলবে—পর্ব ৬)

ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট