শ্রীচরেণেষু দাদা: সাত


মীনাক্ষীর কাকার পরিবার যেখানে বসবাস করতো তা চট্টগ্রাম শহরের ডিসি হীলের ঠিক পাশেই। নন্দনকানন। নামটির মধ্যে কেমন একটা খান্দানি ভাব, এক রাজকীয় মাধুর্যের আভা, মনটা ভালো ভালো লাগার ভাব। যেন কোনো সুখস্মৃতি বা এক হারানো স্বপ্নের আহ্বান। নন্দনকানন নামটি উচ্চারণ করার সাথে সাথেই কেমন জানি এক আনন্দ-উল্লাসের হালকা বাতাসের স্রোত মগজের কোষে কোষে বয়ে যায়, হৃদয়ে এক প্রশান্তির ছোঁয়া লাগে। শুভ্রের একটি প্রয় নাম। ছোটকালে অনেকবার পরিবারের সাথে নন্দনকাননে গিয়েছে। তবে সেই সময়টা ছিল অন্যরকম। প্রায় ছয় যুগ আগের নন্দনকাননের চেহারা আজ চেনাই যায় ন। সেই সময় এই এলাকার বাতাসে সবসময় এক রকম উৎসবের মাদকতা থাকত। আবার সেই উৎসবই যেন এক অচেনা চিরন্তন বিষণ্ণতার সাথে মিলিয়ে থাকত। বাড়ির পেছন দিয়ে চলে গেছে `দ` আকৃতির সরু রাস্তাটি যেন কোনো প্রাচীন রূপকথার সরল রেখা। একটা রিক্সা কোন ভাবে চলতে পারতো। বড় কোন যানবাহন এই পথে চলত না। রিক্সার চাকা আর টুংটাং শব্দই যেন নন্দনকাননের নিত্যসঙ্গী। তবে মানুষের কোলাহল ছিল বেশ তাই পথটি কখনো নিস্তব্ধ ছিল না। সকালের সোনালি আলো ফুটতেই মায়েদের হাত ধরে স্কুলের দিকে ছুটে যায় ছোট্ট শিশুদের এক নির্ঝর কোলাহল। মীনাক্ষী প্রতিদিন সেই দৃশ্য দেখে আর তার বুকের ভেতর জমা হওয়া এক তিক্ত বেদনাকে আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করত।
এতো ছোট বয়সেও মীনাক্ষীর মনে হতো ওর জীবনটাই যেন একটা দীর্ঘ ছায়া, অমবশ্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার, যেখানে কখনো আলো ঢুকতে পারে না। তার জীবন যেন এক দীর্ঘশ্বাসের ধূসর মরুভূমি এক বদ্ধ জগত। যে বয়সটাতে এই ছোট্ট শিশুটির বই নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল, পাড়ার শিশু-কিশোরদের সাথে খেলা ধূলায়, নাচ-গান আর হৈ হুল্লোড়ে মশগুল থাকার কথা ছিল, সেখানে সে বন্দী এক বদ্ধ ঘরে। যেখানে কোনো আলো নেই, নেই কোনো মুক্তির বাতাস। তার শৈশব কি এমন ছিল? কখনোই না। গ্রামে তার শৈশব ছিল যেন রূপকথার এক চিত্রকল্প, যেখানে প্রতিটি দিন ছিল এক আনন্দময় অধ্যায়।
গরীব ছিল বটে। জন্ম হওয়ার পর থেকেই দরিদ্রতার অভিশাপকে বুকে ধারণ করে চলতে হয়েছে পুরো পরিবারটিকে। কিন্তু তার পরেও মীনাক্ষীর ছোটবেলাটা ছিল অনেকটা রূপকথার মতোই। গাছ-গাছালী ঘেরা গ্রামটা ছিল মীনাক্ষীর বড়ো আদরের। বাড়ির দুই পাশে ছিল দুইটি বিশাল পুকুর। পুকুরপাড়ে বসে দাদা অরুণের সঙ্গে রোদ পোহানো, মায়ের কোলে মাথা রেখে রাতের আকাশে চাঁদ দেখা—এসব ছিল তার জীবনের গহীন শান্তি। পাশের বাড়ির শেফালী আর মলিনার সাথে "এলাটিন-বেলা-টিন" খেলার দিনগুলো যেন এখনো তার স্মৃতির মুকুটে উজ্জ্বল হয়ে আছে। মায়ের মধুর কণ্ঠে ঘুমপাড়ানিয়া গান শুনতে শুনতে তার শৈশব কেটেছে এক রূপকথার গল্পের মতো। কিন্তু সময়ের অদ্ভুত খেয়ালে সেই দিনগুলো যেন এক মুহূর্তেই বিলীন হয়ে গেল। আজ যেন সবকিছু বদলে গেছে মীনাক্ষীর জীবনে। এতো অল্প বয়সেও যে তাকে দীর্ঘশ্বাসর ঝুলি নিয়ে চলতে হবে তা কি কেউ ভেবেছিলো। একদিন কেমন করে যেন সব কিছু ওলোট-পালট হয়ে গেল এই ছোট্ট শিশুটির জীবন।
হঠাৎ একদিন কাকা এসে তাকে শহরে নিয়ে গেলেন। মীনাক্ষীর মনে আশা ছিল—নতুন জায়গা, নতুন জীবন। কিন্তু কে জানত, তার কপালে লেখা ছিল এক অনন্ত দীর্ঘশ্বাসের আখ্যান। শহরের এই নতুন পরিবেশটা ছিল তার জন্য এক জটিল ধাঁধার মতো। নন্দনকাননের সেই গৌরব-মাখা রাস্তা, কোলাহল-মুখর সকাল, পাখি ডাকা ভোর—সবই যেন তার কাছে বিষাদময় এক স্মৃতির প্রতিচ্ছবি। তার বুকের গভীরে যেন জমাট বাঁধা দুঃখের ঢেউ। তার ছোট্ট মন কি কখনো ভাবতে পেরেছিল, এতো অল্প বয়সেই তাকে জীবন নামক এতো বড় লড়াইয়ের বোঝা বইতে হবে? স্বয়ং ভগবানই কি এমন নিয়তি লিখে রেখেছিলেন এই দরিদ্র শিশুটির জন্য? জীবনের কোনো এক অদৃশ্য ঝড়ে কেমন করে যেন সব কিছু ওলোট-পালট হয়ে গেল। নন্দনকানন, যেখানে মনোরম প্রকৃতি আর মানুষের সরল জীবনের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ, সেখানে মীনাক্ষীর জীবন যেন হয়ে উঠে এক দীর্ঘ অন্ধকারের গল্প। তবুও, তার মনে এক ক্ষীণ আশা—শহরের এ শূন্যতার মধ্যেও কোনো এক দিন আবার সুখের আলোকছটা ফুটে উঠবে। স্বপ্নের তারারা জীবনের আকাশে একে একে মিট মিট করে জ্বলে উঠবে। নন্দনকাননের বাতাসে মিশে থাকা আনন্দের গান একদিন হয়তো তার জীবনের কান্নাকে শান্তির সুরে মিশিয়ে দেবে।
শুভ্র তার দিদির জীবনের গল্পগুলো সবসময় দিদির মুখ থেকেই শুনেছে। দিদির পাশে বসার সুযোগ পেলেই, সে অতীতের দিনগুলোর গল্প শুনতে চাইত। দিদি ধীরে ধীরে স্মৃতির জাল খুলে বলতেন সেই দিনগুলোর কথা—সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার মিশেলে একেকটি গল্প যেন জীবন্ত হয়ে উঠত। শুভ্র মুগ্ধ হয়ে শুনত, আর দিদির চোখে স্মৃতির ভারে জমে থাকা জল গোপনে উঁকি দিত। মাঝে মধ্যে কান্নার জড়তায় নীরব হয়ে যেতেন। ঠোঁট দুটি বিষাদের বেদনায় কেঁপে উঠত। পুরনো দিনের সেই স্মৃতিগুলো মনে করতে করতে যেন দিদির কণ্ঠে একধরনের নস্টালজিয়া ভেসে উঠত, যা শুভ্রর হৃদয়কেও গভীরভাবে ছুঁয়ে যেত।
যেদিন প্রথম কাকার বাড়িতে পা দেয় মীনাক্ষী সেই দিন থেকেই কাকী মা স্পষ্ট করে দিলেন, এ বাড়ির জন্য মীনাক্ষী একটা বাড়তি বোঝা। তাই পড়াশুনা নয় বরং বাড়ীতে গা-গোতরে কাজ করতে পারলেই এখানে তার ঠাঁই হবে। মীনাক্ষীর কাকী মা যেন গল্পের বই থেকে উঠে আসা এক অসাধারণ ভয়ানক চরিত্র। শ্যামবর্ণা তাঁর ত্বক যেন মহিষাসুর-মর্দিনীর মূর্তির মতো গাঢ় মায়াময়। দীর্ঘদেহী এবং সুঠাম গড়নের অধিকারিণী, তাঁর উপস্থিতি এক ধরনের কর্তৃত্ব আর ভয় মিশ্রিত সম্ভ্রম জাগায়। তাঁর চুল সবসময় উঁচু করে বাঁধা, যেন রাজকীয় কোনো মুকুট। চোখ দুটো ভয়ানক প্রখর—যেন অন্তরাত্মা পর্যন্ত ভেদ করে দিতে পারে। রাগলে তাঁর চোখ বড় হয়ে উঠে এমন ভয়ানক রূপ নেয় যে, কেউ আর সামনে দাঁড়ানোর সাহস পায় না। তাঁর কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তা, চলার ভঙ্গিমা, এবং অভিব্যক্তি একসঙ্গে তাঁকে যেন দারোগা দারোগা মনে হয়। কাকীমার ভয়ে কাকা দিনের বেশীরভাগ সময়ই ঘরের বাইরে কাটাতেন। পানের গদিতে খাতুন-গঞ্জ বাজারে বসে থাকতেন। রাত আটটার সময় গদি বন্ধ হলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে ঠিক দশটায় বাড়ীতে ঢুকতেন। কাকীমাকে দেখলেই বোঝা যায়, তিনি এমন একজন নারী যিনি নিজের উপস্থিতি দিয়েই অন্যকে কাঁপিয়ে দিতে পারেন। তবুও, তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে কোথাও এক ধরনের রহস্য লুকিয়ে আছে, যা মানুষকে মুগ্ধ করে বটে কিন্তু একধরনের দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য করে।
মীনাক্ষী ধীরে ধীরে কাজ করতে শিখল, মুখ বুজে অপমান সইতে শিখল। একসময় সে বুঝতে পারল, এ ছাড়া তার আর কোনো পথ নেই। দারিদ্র্য, অবহেলা, আর সীমাহীন কষ্ট যেন তার জীবনের একমাত্র সত্য। আশার আলো যতটুকু ছিল, তাও ধীরে ধীরে নিভে গেল। যেন বিধাতা তার ভাগ্যে সুখের কোনো অধ্যায়ই লেখেননি। গরিব শিশুটির জন্য কোনো দরজা খোলা রইল না, কোনো হাত বাড়িয়ে দিল না তাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য। একা, নিঃসঙ্গ, আর অবহেলিত মীনাক্ষী বুঝে গেল—এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে তার কান্নার কোনো মূল্য নেই।
কাকীর মেঝো ছেলেটা ছিল ভয়ানক পাঁজি। সবসময় মীনাক্ষীর ক্ষতি করার ছল খুঁজত। একদিন দুপুরে, সবাই যখন খাওয়ার টেবিলে বসে, তখন মেঝো ছেলেটা একটা গ্লাস ফেলে ভেঙে দিল। কাকী মা ঘুরে দাঁড়িয়ে মীনাক্ষীর দিকে চিৎকার করে বললেন, "তোর সাহস কত্ত! বাড়ির জিনিসপত্র নষ্ট করছস? তর শাস্তি পাওয়া দরকার।" মীনাক্ষী ভয় আর অপমান মিশিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, "আমি কিছু করিনাই, কাকী মা।" কিন্তু কেউ তার কথা শুনল না। সেই দিন দুপুরে তাকে খেতে দেওয়া হয়নি। সারাটা দুপুর রান্না ঘরের এক কোনে কুন্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে থাকলো। ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদলো।
এমন ভাবেই কাটতে লাগলো ছোট্ট মীনাক্ষীর জীবন। অসীম দুঃখ আর ক্লান্তির বোঝা যেন তার ছোট্ট শরীরটাকে ধীরে ধীরে গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল। বুক ভরা ব্যথা, আর হৃদয়ের অসহ্য যন্তনার ভার যেন সইতে পারছিল না। কখনো কখনো মনে হতো এতো দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলেছে। প্রতিদিন ভোর চারটার সময় তার উঠতে হতো। আর সবার শেষে রাত্রে ঘুমোতে যেতো। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজটা তার জন্য বরাদ্দ। ঘুমোতেও পারত না ঠিক মতো। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে রান্না ঘরের এক কোনায় তেল চিটচিটে লেপ আর বালিশে কোন রকমে হাঁটু মোড়ে শুয়ে থাকত। কিন্তু সেই শোয়া কি আর শোয়া? ঘুমাতে চেষ্টা করলেই যেন চারপাশের সব যন্ত্রণারা একসঙ্গে এসে হাজির হতো। তার ওপর ছোট ছোট ইঁদুর আর মশার দল যেন প্রতিজ্ঞা করেছিল তার শান্তি ছিনিয়ে নেওয়ার। আর মাঝে মাঝে লাল পিঁপড়েরা তার পায়ে এসে হুল ফোটাত। কামড়ের যন্ত্রণায় ওফ, ওফ শব্দ করে উঠলেও, সেই অসহ্য কষ্টের শব্দ রান্না ঘরের দেয়াল পেরিয়ে আর কারও কানে পৌঁছাত না।
তার জীবনের রাতগুলো যেন যন্ত্রণার এক অন্তহীন অধ্যায় হয়ে উঠেছিল। প্রতিটি মুহূর্তে মনে হতো, পৃথিবী তার জন্য শুধু যন্ত্রণা আর দুঃখের পসরা সাজিয়ে বসেছে। রান্নাঘরের সেই আঁধারে, মশার গুনগুন আর ইঁদুরের ছুটোছুটির মধ্যে, মীনাক্ষীর ঘুমের চেষ্টাটা যেন একটা ব্যর্থ স্বপ্ন। জীবনের প্রতি তার কোনো অভিযোগ ছিল না, কিন্তু তার কচি সরল মন বারবার প্রশ্ন করতো—এই কি তবে তার জীবনের নিয়তি?
তারপর এলো সেই ঘটনা, যেটা সে জীবনে ভুলতে পারবে না। পুরনো একটা বইয়ের আলমারি ছিল কাকীমাদের ঘরে। সেখান থেকে একটা ছোট আদর্শলিপির বই একদিন বের করেছিল মীনাক্ষী। বইটা ছিল দাদা অরুণর দেওয়া। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মোমবাতির আলোতে সে বইটা মাঝে মাঝে পড়ত। সেই বই যেন তার একমাত্র সান্ত্বনা। কিন্তু একদিন কাকী মা তাকে হাতে-নাতে ধরে ফেললেন। বই দেখে তার চোখ রাগে লাল হয়ে গেল। "তুই চুরি করছস? আমাদের জিনিস। তোর সাহস কি করে হয়?" মীনাক্ষী কাঁদতে কাঁদতে বলল, "এটা আমার বই কাকী মা। দাদা আমাকে দিছে।" কিন্তু কাকী মা তার কথা শুনলেন না। বইটা তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে চুলায় ফেলে দিলেন। মীনাক্ষী ছুটে গিয়ে বইটা বাঁচানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তার হাত পুড়ে গেল। সেই রাতটা সে চোখের জলে ভিজিয়ে কাঁটাল। তার দাদার দেওয়া শেষ স্মৃতিটুকুও আগুনে ঝলসে গেল।
এমন নানা যন্ত্রণার মাঝেই কাটতে লাগলো মীনাক্ষীর দিন-রাত্রি।
একদিন সকালে, জল আনতে গিয়েছিল মীনাক্ষী। ভোরের আলো তখনো ভালো করে ফোটেনি। চারিদিকে ছিল এক শান্ত, নিস্তব্ধ পরিবেশ। দূরে পাখিরা অল্পস্বরে ডাকতে শুরু করেছে। পাশের মসজিদ থেকে ভোরের আযানের শব্দ ভেসে আসছে। রাস্তার ধারে লালমাটির পথ, তার পাশেই গাছগাছালির ঘন ছায়া। হালকা কুয়াশায় চারপাশ ঢাকা, আর ঠাণ্ডা বাতাসে হাত-পা জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। দু-একজন পথচারী এগিয়ে চলছে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় মীনাক্ষীর হাত-পা কাঁপছিল। কোলে একটি মাটির কলস। হাতে বড় একটি প্লাস্টিকের পাত্র। গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলছে।
কলের কাছে পৌঁছেই মীনাক্ষী দেখে, সেখানে লম্বা লাইন পড়ে গেছে। প্রতিটা মানুষই ঠাণ্ডায় গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিল। একে অপরের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলছে। কেউ বলছে, "আজ পানি তুলাইতে বেয়া টাইম লাগতাছে," আবার কেউ বলতাছে, "কাল রাইত্তে থাইকা পানি খুব কম আইতাছে।"
অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর মীনাক্ষী লাইনের সামনে এসে পৌঁছায়। কিন্তু এক মহিলা তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে বললেন, " তুই এখানে দাঁইড়াইছ কেন? তওয়ার জাগা এট্টা না।" মীনাক্ষী কিছু বলার সাহস পেল না। সে একপাশে দাঁড়িয়ে আবার লাইনের শেষে ঢুকে পড়ল।
ঠাণ্ডায় তার হাত-পা কাঁপছে, আর দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হাঁটু ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। সময় ধীরে ধীরে কাটছিল। সামনের দিকে একজন বৃদ্ধা চিৎকার করে বললেন, "আরে আর কতক্ষণ? পানি লইয়া ফিরন লাগব রান্ধনের আগত”।
চারপাশের ঠাণ্ডা হাওয়া আর সকালের কুয়াশা যেন তার মনের ভেতরের অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। এই ভাবেই রোজ ভোরে কলসি ভরে মীনাক্ষী জল নিয়ে আসতো। বাসন পত্র মাঝত। রান্নাঘর পরিষ্কার করতো। সকাল আটটা বাজলেই অন্যরা ঘুম থেকে উঠতো।
একদিন বিকেলে বাড়ির পুরনো মাটির কলসিটি ভেঙে পড়ে মেঝেতে। শব্দটা এমন জোরে হয় যে রান্নাঘরে থাকা মীনাক্ষী চমকে ওঠে। কাকীমা তৎক্ষণাৎ দৌড়ে আসে, রাগে তার মুখ লাল।
" ইডা কি করলি তুই? তোরে কতবার কইছি সাবধানে কামডা করবি!" কাকী মা গর্জে উঠলেন।
মীনাক্ষীর গলা কাঁপতে থাকে। চোখ থেকে ঝরঝর করে জল পড়ে। সে কেঁদে বলে, "আমি কিছু করিনাই, কাকিমা। সত্যি কইতাছি। আমি তো রান্নাঘরে আছিলাম।"
কাকী মা ভ্রু কুঁচকে বলল, "মিথ্যা কথাডা কইতে তোর লজ্জা করে না? তোকে আমি চিনি না মনে করছস? আইজ তোকে শাস্তি পাইতেই হইব!”
মীনাক্ষী কাঁদতে কাঁদতে বলল, "কাকী মা, বিশ্বাস করো। আমি কিছু করি নাই। আমার দোষ নেই। আমারে তুমি বইক না। আমার খুব কষ্ট হয়"
কিন্তু কাকী মা তার কানেই নিলেন না। তিনি মীনাক্ষীর হাত শক্ত করে ধরে বারান্দায় টেনে নিয়ে গেলেন। চুলের মুঠি ধরে একটা হ্যাঁচকা টানে মাটিতে ফেলে দিলেন "এখন থেকে কাজ করাটাই তোর শাস্তি।" একটা পুরনো ঝাঁটা এনে মীনাক্ষীর সামনে ধপাস ফেলে দিলেন।
"এই বাড়িডা ঝাড়ু দে। পুরা বাড়ি ঝকঝকা না অইলে উঠবি না কইলাম।"
মীনাক্ষী ফ্যাল ফ্যাল করে অসহায়ের মতো কাকীমার দিকে একটু তাকালো। হাতের উপর ভর দিয়ে দুর্বল শরীরটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ঝুঁকে ঝুঁকে কাজ করতে শুরু করল। সন্ধ্যা নামে। তার হাত কাঁপছে, পিঠ ব্যথায় অবশ হয়ে যাচ্ছে শরীরের পিছনটা। মাঝে মাঝে সে থেমে জিরোতে চায়, কিন্তু ভয়ে থামতে পারে না। চোখের জলে মেঝে ভিজে যায়। তবুও কেউ তাকে দেখে না, কেউ তার কষ্ট শোনে না।
সন্ধ্যার শেষ আলোটুকু মুছে গেলে, মীনাক্ষী ঘাড় নিচু করে কাকীমার সামনে এসে দাঁড়াল। সে আর কিছু বলতে পারল না, শুধু চোখের জল গাল বেয়ে পড়তে লাগল।
মীনাক্ষীকে তার কাকাতো ভাই বোনেরা কখনোই পছন্দ করত না। একদিন, কাজিনদের মধ্যে সবচেয়ে মেঝোটা যার নাম, মধু, সুযোগ বুঝে তার মায়ের বিছানায় তেলের বোতল উল্টে দেয়। বোতল থেকে তেল ধীরে ধীরে গিয়ে বিছানায় ছড়িয়ে পড়ে।
রাত হলে, কাকী মা ঘরে এসে দেখে বিছানায় বড় বড় তেলের দাগ। চোখ ছানাবড়া করে তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন, "এইডা কি করলি তুই?"
মীনাক্ষী বিভ্রান্ত হয়ে বলে, "আমি কিছুই করিনাই, কাকী মা! সত্যি বলছি।"
ঠিক সেই সময় মধু ঘরের কোণ থেকে এসে মিষ্টি গলায় বলে, "মা, আমি দেখছিলাম, মীনাক্ষী তেলের বোতল নিয়ে খেলতাছিল। আমি মানা করছিলাম, কিন্তু ও শুনল না।"
মীনাক্ষীর চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়। সে চিৎকার করে বলতে চায়, "এটা মিথ্যা!" কিন্তু তার গলা থেকে কোনো শব্দ বের হয় না। ভাই-বোনদের কেউ তার পক্ষে কথা বলে না।
কাকী মা রাগে ফুঁসে উঠে মীনাক্ষীর হাত ধরে মুচড়ে দিয়ে বলেন, "তর এই দুষ্টুমি আর সহ্য করা যাবে না। আজ রাতের খাবার তর লাইগ্যা বন্ধ। শিখবি, শাস্তি কারে বলে!"
মীনাক্ষী চোখের জল আটকে রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। তার ছোটো শরীরটা অপরাধী নয়, তবু সে শাস্তি পায়। মধু এক কোণে দাঁড়িয়ে তৃপ্তির হাসি হাসে। মীনাক্ষী মনে মনে ভাবে, "এই বাড়িতে কি কেউ আমাকে ভালোবাসে না?"
এক রাতে মীনাক্ষী ঠিক করল, আর না। সে পালাবে। বাড়ির এক কোণে লুকিয়ে রাখা একটা পুরনো বাক্স থেকে জমানো কয়েকটা টাকা আর একটা পুরনো কাপড় নিয়ে একদিন ভোরে জল আনার সময় সে বেরিয়ে পড়ল। শহরের অন্ধকার গলির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে লাগল। গলির সামনে আসতেই হঠাৎ পেছন থেকে পায়ের শব্দ শুনতে পেল। ঘুরে দেখে মধু দাদা তার পিছু নিয়েছে। "তুই পালাবি? তোর সাহস কত বড়!" সে মীনাক্ষীকে টেনে বাড়িতে নিয়ে গেল। জোড়ে জোড়ে সবাইকে ডাকাডাকি শুরু করলো। সবাই জেগে উঠল। কাকী মা রাগে ফেটে পড়লেন। "তুই কি করে ভাবলি, এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি? তোর শাস্তি আজ দেখবি।"
মীনাক্ষী সেই রাতটা ফ্যানের নিচে ঝুলন্ত অবস্থায় পার করে। পাঁজি মধু দাদা তাকে ফ্যানের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখে, যেন কোনো খেলনা। কষ্ট আর অপমানে শরীর অবশ হয়ে আসে। অনেক পরে কাকা এসে তাকে ফ্যান থেকে নামায়। শরীর তখন সম্পূর্ণ শক্তিহীন, কিন্তু মনের ছটফটানি থামে না। তার চোখের সামনে বারবার ভেসে ওঠে মায়ের মমতাময় মুখ। মনে পড়ে গ্রামের সেই পুরনো আমগাছ, যেখানে সে শৈশবে খেলা করত। পুকুরপাড়ের ছোট্ট বাড়িটার কথা মনে হয়, যেখানে তার হাসিখুশি দিনগুলো কেটেছিল। এখন তার সেই শৈশব, সেই নির্ভেজাল সুখ, সবকিছু যেন হাজার মাইল দূরের কোনো স্বপ্ন। মীনাক্ষীর চোখে জল ভরে আসে, কিন্তু সেই কান্নার মধ্যেও কোনো মুক্তি নেই। এই নিষ্ঠুর পরিস্থিতি যেন তাকে ক্রমাগত তার নিজের অসহায়ত্ব আর নিঃসঙ্গতার মুখোমুখি করিয়ে দিচ্ছে।
তার পিঠে ব্যথা, চোখ জ্বলছে, কিন্তু তার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত শক্তি জন্ম নিচ্ছে। সে জানে, এই অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে হলে তাকে নিজেই পথ খুঁজতে হবে। হয়তো একদিন, সে সেই আলোর পথে হাঁটবে, যেখানে কেউ তাকে থামাতে পারবে না। এখনো সেই দিন আসেনি, কিন্তু তার আশা এখনো মরেনি।
মীনাক্ষীর জীবন যেন একটা দীর্ঘ কুয়াশাচ্ছন্ন পথ। এই পথের প্রতিটি বাঁকে কেবলই বেদনা, অপমান আর অন্ধকার। মীনাক্ষী ফুফিয়ে কেঁদে উঠে। তার চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। সে জানে না, এই অন্ধকার থেকে মুক্তি আসবে কিনা। তবুও তার মন বলে, একদিন হয়তো সূর্যোদয় হবে। একদিন সে মুক্তি পাবে এই শৃঙ্খল থেকে।
চলবে—পর্ব ৬)
ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট