শ্রীচরেণেষু দাদা: ছয়


মুক্তিযুদ্ধের সময় শুভ্র খুবই ছোট ছিল। ঠিকমতো দুপায়ের উপর ভর দিয়ে হাঁটতেও পারতো না। কোলে-পিঠে করেই তাকে নিয়ে পথ চলতে হতো।
দেশ ছাড়ার সেই ভয়াবহ, বিপদসংকুল অস্থির দিনগুলোর কোনো স্পষ্ট স্মৃতিই তার মনে নেই। মনে থাকার কথাও নয়। তবে, যখন ধীরে ধীরে বুঝতে শিখল, তখন বাবার মুখে, মায়ের চোখে, আর পরিবারের বড়দের কাছ থেকে শোনা কথাতেই সে জেনেছে দেশের জন্য বিসর্জিত সেই সময়ের ইতিহাস। যতোটুকু শুনেছে, ততটুকুই তার জানা। তবে ঢাকায় কলেজে পড়ার সময় বড় দাদা অরুণের কাছ থেকেই সীমান্তের ওপারের অনেক গল্প শুনেছে। একেবারে জীবন্ত গল্প। বড় দাদা অরুণের মুখে সে শুনেছে সীমান্তের ওপারের দুঃসহ স্মৃতি, মাটির গন্ধ মাখা শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তের বিবরণ। কখনো গল্পে ফুটে উঠেছে ভয়াল বিভীষিকার চিত্র, কখনো আবার বুকের গভীরে জমে থাকা ব্যথা অশ্রুর ধারা হয়ে ঝরে পড়েছে। দাদা যখন একনাগাড়ে বলত মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোর কথা, তখন মনে হত যেন সীমান্তের ওপারে বসে রয়েছে শুভ্র, নিজের চোখেই দেখছে সবকিছু।
সেই সব যেন শুধু নিছক গল্পই ছিল না। কখনো কখনো শুভ্রের কাছে মনে হতো এ যেন বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করা একেকটা হৃদয় বিদারক অধ্যায়। কখনো দুঃখে ভারাক্রান্ত মনে বুকের ভেতর চাপা কান্না জমে উঠত, আবার কখনো চোখের কোণ বেয়ে নীরবে ঝরে পড়ত জল। শুভ্র অনুভব করত, মুক্তিযুদ্ধ শুধু যুদ্ধ ছিল না, ছিল মানুষের অধিকার, সম্মান আর ভালোবাসার জন্য চরম আত্মত্যাগের এক অমরগাথা।
এক সময় অরুণেরা সীমান্ত পারি দিয়ে ভারতের সীমানায় এসে পোঁছে। এ যেন এক অনিশ্চিত যাত্রাপথ। চারপাশে হাজারো মানুষের ভিড়। সবার মুখে ক্লান্তি, ভয়ে ছাওয়া চোখ, আর একটা নিরাশার ছায়া। নিজেদেরকেও বেশ ক্লান্তি মনে হচ্ছিলো। শরীর যেন আর চলছিলো ন। তবু এই অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে সামনে রেখেই এগুতে থাকলো। তারা বুঝতে পারছিল না, সামনে কী অপেক্ষা করছে।
ত্রিপুরা সীমান্তে ভারতীয় সেনারা এক এক করে শরণার্থীদের তল্লাশি করছিল। তাদের কাছে যা কিছু সামান্য ছিল—একটা মাটির ভাঁড়, কয়েকটা ছেঁড়া শাড়ি বা লুঙ্গি, মায়ের বিয়ের সময় পাওয়া পুরনো সোনার চুড়ি—সবকিছু চুলচেরা পরীক্ষা করানো হচ্ছিল। অনেককেই নিজেদের সামান্য মূল্যবান জিনিসপত্র ফেলে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল।
যখন সীমান্তের ওপারে পা দিল, অরুণ মনে মনে ভাবলো, “এখন আমরা বাঁচতে পারব, এখানকার মানুষ আমাদের আপন করে নেবে।” কিন্তু সে ভুল খুব তাড়াতাড়িই ভেঙ্গে যায়। বুঝতে পারলো ভারতীয় মাটিতে তারা ‘শরণার্থী’ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
তাদের প্রথম যাত্রা উদয়পুর। সীমান্ত থেকে উদয়পুর পর্যন্ত পথ ছিল যেন এক দীর্ঘ দুঃস্বপ্ন। অরুণদের পরিবার একটি লরিতে করে রওনা দিল। বহু অনুরোধ আর কান্নাকাটির পর লরি ড্রাইভারকে রাজি করানো হলো। পুরো লরিটা ছিল শরণার্থীতে ঠাসা। পায়ে পা লেগে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছিল। কারও কোলে শিশু, কেউ বৃদ্ধ মায়ের হাত ধরে বসে ছিল। লরির এক কোনায় মা বিকাশ আর শুভ্রকে বুকে চেপে বসে ছিলেন। সঞ্জয় আর সুবীর বাবার দুপাশে বাবাকে জড়িয়ে কোনভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো। বাবা দু`ছেলেকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেও তার চোখে সব সময় ছিলো সতর্কতার ছাপ। যেন কোনো ভয়ানক বিপদ তাদের আক্রমণ করবে।
রাস্তায় প্রতিটি জায়গায় থেমে থেমে সেনাবাহিনী আর স্থানীয় লোকেরা লরির উপর নজর রাখছিল। কারও কারও মুখে কটু কথা, “এরা এসে আমাদের খাবার নিয়ে যাবে”, কেউ কেউ আবার তীর্যকভাবে বলছে-“শরনার্থীদের জন্যই আমাদের দুর্দশা বাড়বে।” কয়েকজন স্থানীয় মানুষ আবার খাবার নিয়ে এসে তাদের দিকে এগিয়ে দিয়েছিল। শুকনো রুটি আর সামান্য গুঁড় দেওয়া হয়েছিল লরিতে থাকা শিশু আর বৃদ্ধদের জন্য। মা সেদিন সেই রুটি ভাগ করে বিকাশ আর শুভ্রের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। নিজে কিছুই খাননি।
পথের ধারে জায়গায় জায়গায় কিছু মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেল। কিছু মানুষ হয়তো খাদ্যের অভাবে মরে গেছে, আবার কিছু হয়তো অসুখে। মাঝে মাঝে গা ছমছমে নীরবতা ছিন্ন করে দূর থেকে ভেসে আসত কারও কান্না। এই দৃশ্য দেখে অরুণের মনের ভিতর জেগে উঠছিল এক প্রশ্ন: “আমাদের কি কখনো ঘরে ফেরার দিন আসবে?”
ক্যাম্পে পৌঁছানোর আগেই তাদের পরিচয় হয়ে গেল ‘ভারতীয় শরণার্থী’ হিসেবে। ক্যাম্পে ঢুকেই অরুণ অনুভব করল, তারা এক নতুন দেশে এলেও, এই দেশ তাদের নয়। কিছু ভারতীয় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই এই শরণার্থীদের জন্য বিরক্ত হয়ে উঠছিল। “নিজেদের দেশে থাকতে পারলে ভালো হত,” এমন মন্তব্য প্রায়ই শোনা যেত।
উদয়পুর ক্যাম্পে ঢোকার সময় বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল ‘শরণার্থী শিবির’। ক্যাম্পের প্রথম নজরে পড়ে ছেঁড়া তাঁবু, পোকামাকড় ভরা জলাধার, আর মানুষের কান্না। অরুণের মা প্রথমবার সেই জায়গা দেখে ফিসফিস করে বলেছিলেন, “এই জায়গাটা আমাগো লাইগ্যা না। আমরা এই জায়গায় মরতে আইছি।”
তবুও এই ক্যাম্পে আসার অনুভূতিটা ছিল মিশ্র। একদিকে ছিল নিরাপত্তার স্বস্তি—পাক সেনারা এখানে আর তাদের তাড়া করবে না। অন্যদিকে, তাদের নিজের পরিচয় আর মর্যাদা হারানোর যন্ত্রণা। নতুন দেশে তারা কেবলই সংখ্যার হিসেব। সরকার থেকে দেওয়া সামান্য খাবার, চিকিৎসা আর কিছু বস্ত্র দিয়ে তাদের জীবন কাটাতে হচ্ছিল। তবুও ঠিক সময়ে ভারত সরকার পাশে এসে না দাঁড়ালে সীমান্তে পালিয়ে আসা এক কোটিরও বেশী বাংলাদেশী হিন্দুর আর কোন অস্থিত্বই হয়তো থাকতো না।
অরুণ মাঝেমধ্যে বাবার মুখের দিকে তাকাত। বাবা তখনও সেই দৃঢ় বিশ্বাসে ছিলেন যে একদিন তারা নিজের দেশে ফিরবে। কিন্তু ক্যাম্পের প্রতিটি দিন তাদের মন থেকে সেই বিশ্বাসকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করছিল।
এই দীর্ঘ যাত্রাপথে যে যন্ত্রণা, ক্ষুধা, আর আতঙ্ক তারা সয়েছিল, তা অরুণের মতো একজন কিশোরের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। নতুন দেশে তারা বাঁচার জন্য লড়াই করছিল ঠিকই, কিন্তু তাদের মনে তখনও একটি কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল: “এটা আমাদের দেশ নয়। আমরা এখানে সারা জীবন থাকতে পারব না। আমাদের নিজের মাটি, নিজের আকাশে ফিরতে হবে।”
এর মধ্যে শুভ্র বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ে। শরীরটা একেবারে নিস্তজ হয়ে পড়ে। দিনের পর দিন অপুষ্টি আর দুঃসহ পরিবেশের ধকল শরীর সহ্য করতে পারছিল না। একদিন ভোর থেকেই তার পেটের সমস্যা শুরু হয়। সকাল গড়াতেই কয়েকবার পাতলা পায়খানা হয়। শরীরটা একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ল, যেন তার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। মুখে শুকনো রঙ, চোখের কোণায় অবসন্নতার ছাপ স্পষ্ট।
ক্যাম্পের অবস্থাও এমন ছিল যে, সেখানে সুস্থ থাকার আশা করাই ছিল বিলাসিতা। বৃষ্টির দিনে কাদা-পানিতে মিশে যাওয়া রাস্তা আর চারপাশের নোংরা পরিবেশ রোগ-জীবাণুর উৎস হয়ে উঠেছিল। শৌচাগারগুলো ছিল আরও ভয়াবহ অবস্থায়। বাঁশ আর টিনের তড়িঘড়ি বানানো ঘরগুলোয় কোনো পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার বালাই ছিল না। দুর্গন্ধে সেখানে ঢোকা যায় না, আর ঢুকলেও নাকে হাত চাপা দিতে হতো। মাটি খুঁড়ে অগভীর গর্তে পায়খানা করা হত, যা পরদিনই বৃষ্টির পানিতে ছড়িয়ে পড়ত চারপাশে।
নারী, পুরুষ, শিশু—সবাইকে একই রকম কষ্ট ভোগ করতে হত। অনেক সময় শৌচাগার ব্যবহার করাই অসম্ভব হয়ে পড়ত। তখন পাশের ঝোপঝাড় বা নদীর ধারে যেতে হত। এই অসম্ভব নোংরা আর অনিরাপদ পরিবেশে রোগবালাই এমনভাবে ছড়াত যে কারো অসুস্থ হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল। শুভ্রের মায়ের চোখে ছিল গভীর উদ্বেগ। কীভাবে তাকে এই অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখা যায়, সেই চিন্তায় তিনি নিজের খাবারও ছেড়ে দিতেন, শুধু যেন শুভ্র একটু সুস্থ হতে পারে।
শুভ্রের মায়ের চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। শুভ্রের মুখে পানি ছিটানোর পরেও তার নিস্তেজ চোখ কিছুতেই খুলছিল না। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা মানুষের আর্তনাদ যেন শুভ্রের মা-বাবাকে ভীষনভাবে ভাবিয়ে তুলছিল। উদয়পুর শরণার্থী ক্যাম্প যেন হাজরো অসহায় শরনার্থীর ভিড়ে ঠাসা। এখানে সবাই বেঁচে আছে অথচ মৃতের মতো। জীবনের স্পন্দন যেন হারিয়ে গেছে এই ক্যাম্পের প্রতিটি কোণায়। আর সেই বিষাক্ত বাতাসের মধ্যে, শুভ্রের কাতর মুখে মায়ের আতঙ্ক যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠছিল।
“কিছু একটা করোনাগো। পোলাডাতো ভালা নাই। পোলাডারে বাঁচাইতে পাইরবোতো?” মা বাবার দিকে তাকিয়ে করুণ স্বরে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন। বাবা তখন নিশ্চুপ। এই কয়েক দিনে তার দেহের শক্তিটুকু যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। মুখে কথা বলারও শক্তি নেই। শরনার্থী শিবিরের তাবুর চারপাশে বসে থাকা অন্য শরণার্থীরা তখন তাদের নিজেদের কষ্ট ভুলে শিশুটির দিকে তাকিয়ে ছিল।
“শ্যামদা, এখানে ওষুধ পাইব কোথায়? চিকিৎসকও নেই ঠিকমতো। আর এত্তো মানুষ ডাক্তার-নার্স করবেটা কি?” পাশের এক ভদ্রলোক অসহায়ের মতো বলে উঠলেন। শরণার্থী শিবিরের চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল, প্রাথমিক ওষুধের জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হত। আর লাইন পেরোলেই মিলত একটুখানি ওষুধ। তাও সকলের জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। বাবা দেরি না করে দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন।
মিনিট কয়েক পরেই তিনি ফিরে এলেন হাতে একটা পাত্র নিয়ে। সেটাতে ছিল আধমরা গাছপাতা দিয়ে বানানো একধরনের বাটা। পাশের তাঁবুর কেউ একজন নিজের চিকিৎসার জন্য বানিয়েছিল, আর বাবাকে দেখে তিনি একটু দিয়ে দিয়েছেন। বাবা পাত্রটা নিয়ে শুভ্রের ঠোঁটের কাছে ধরলেন। মা অনুরোধ করলেন, “শুভ্র, একটু খা, বাবা। একটু খা। তুই না খাইলে আমরা কেউ বাঁচতাম না।” মায়ের কথা শুইনা শুভ্র সামান্য চোখ খুলল, কিন্তু তারপরেই আবার বুজে ফেলল।
এদিকে চারপাশের পরিবেশ ছিল আরও ভয়াবহ। ক্যাম্পে প্রতিদিনই কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে। সকালে যে মানুষগুলো জীবিত ছিল, সন্ধ্যায় তাদের মৃতদেহ শিবিরের এক কোণে ফেলে রাখা হত। শরীরের উপর দিয়ে মাছি উড়ে বেড়াত। দুর্গন্ধে আশপাশে যাওয়া যায় না। বেশিরভাগ মৃত্যু হতো ডায়রিয়া ও পানিশূন্যতায়। অরুণ এমন কিছু দৃশ্য দেখেছে যা তার জীবনে কল্পনাও করেনি।
একদিন সকালে, পাশের তাঁবুর এক বৃদ্ধ মারা গেলেন। তার এক মেয়ে, বয়স ১০-১১, বৃদ্ধার দেহ আঁকড়ে ধরে কাঁদছিল। কেউ এগিয়ে এসে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিল না। কেউ যেন এমন মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে চোখ ফেরাতে পারছিল না। কিছুক্ষণ পর, শরণার্থীদের জন্য নিয়োজিত এক স্থানীয় কর্মচারী এসে মৃতদেহ সরিয়ে নিয়ে গেল।
অরুণ সেই মেয়েটিকে দেখে নিজের বোন মীনাক্ষীর কথা ভাবছিল। যদি মীনাক্ষী এখানে থাকত, তবে কি এরকম এক মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে পড়ে যেত? এই ভেবে তার ভেতরে এক চাপা যন্ত্রণা কাজ করছিল।
তাঁবুর বাইরে হঠাৎ শোনা গেল কারো চিৎকার। “এই জায়গাটা বিষের মতো! কেউ বাঁচবে না এখানে! আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে!” এক মহিলা, তার সন্তানকে বুকে চেপে ধরে, পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল। চারপাশের লোকজন তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেও সে কিছুতেই থামছিল না।
সেই যাত্রায় শুভ্র বেঁচে যায়। অরুণই তার জন্য ডাক্তারের কাছে গিয়ে ঔষধ নিয়ে এসেছিলো।
সঞ্জয় একদিন অরুণের মার হাত ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, “মা, আমরা কি এহান থেইক্যা আমাগো গ্রামে একদিন ফিরতি পাইরব? আমাদের গ্রাম, আমাদের বাড়িডা কি সয়তান পাকিস্থানীরা ভাইঙ্গা ফালাইবো?” মা সঞ্জয়ের কথার কোনো উত্তর দিতে পারলো না। তার চোখে কেবল হতাশা আর বিষণ্ণতা।
এইভাবে কেটে গেলো দুটি মাস। দুই মাস পর অরুণরা জানতে পারলো ওদেরকে আসামের একটি শরনার্থী ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে। এই খবরে উদয়পুর ক্যাম্পের অনেকেই ভয় পেয়ে গল। অনেকে ভীষন চিন্তিত হয়ে পড়লো। অনেকে আবার না যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলো। গুজব রটে গলো যে কার্গো বিমানে করে শরনার্থীদেরকে সমুদ্রের ওপর থেকে ফেলে দেওয়া হবে!” এ কথা শুনে অনেকের মধ্যেই ভয় ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু অরুণের পরিবার এসবে কান দিলেন না। যা হবার হইব। এখানে থাইকলে এইমনিই মরবো।“-অরুণের মাকে বাবা সান্তনা দিয়ে বলেছিলেন।
একদিন সত্যি সত্যি একটি বিশেষ কার্গো বিমানে তাদের আসামে নেওয়া হল। নিয়ে আসা হলো এক বিশাল ক্যাম্পে। এইটাই নাকি সেইসময় আসামের সবচেয়ে বড়ো শরনার্থী শিবির। বিশ হাজারেরও বেশী শরনার্থীর থাকার ব্যবস্থা করা হয় এই শিবরটিতে। আসামের এই ক্যাম্পে কিছুটা উন্নত ব্যবস্থা ছিল। সেখানে চিকিৎসকরা ছিলেন, ছিল পরিমাণে কম হলেও পরিষ্কার খাবার। তবুও ক্যাম্পের কঠিন জীবন থেকে মুক্তি মেলেনি। মা প্রায় প্রতিদিনই ভাবতেন, “কবে আমরা আমাদের গ্রামে ফিরে যাব?” কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর কারও কাছেই ছিল না।
অরুণের কাছে শরণার্থী শিবিরের দিনগুলো ছিল যেন জীবনের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। শুভ্র তখন খুবই ছোট, প্রায় কিছুই বোঝে না, তবু সে যেন প্রতিটি দুঃখ অনুভব করত মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। উদয়পুরের মতো এখানেও একদিন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল শুভ্র। ডায়রিয়ায় এমন কাহিল হয়ে গেল যে তার মুখে এক ফোঁটা জল দেওয়ারও সাহস ছিল না কারও। মা সারাদিন তার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছিলেন, কিন্তু নিজের চোখের পানি আটকাতে পারছিলেন না।
একদিন সে মায়ের কাছে অনেক অনুরোধ করে একটু ডাল-ভাত খেতে চায়। সেদিন পাতলা করে খিচুরি রান্না করা হয়েছিল। মা অগত্যা তাকে একটু খিচুরি নিজের হাতে খাইয়ে দেন। বড় ভাই অরুণ তখন পাশেই ছিল। খাবার খাচ্ছিলো। এ দৃশ্য দেখে তার ভেতর যেন আগুন জ্বলে ওঠে। “তুমি কি শুভ্রকে মেরে ফালাইবা নাকি? খিচুরি দিতাছ কা?” মা চুপ করে ছিলো। কিছু বলার যেন সাহস নেই।
এক সময় অরুণ রাগে, দুঃখে, এবং অভিমানে শুভ্রের সামনে থেকে খাবারের মাটির প্লেটটা এনে ধাপাস করে ফেলে দিয়ে ভাঙ্গা চৌকি থেকে উঠে দাঁড়ায়। বিশ্রী একটা গালি দিয়ে হন হন করে তাবু থেকে বেড়িয়ে যায়। নিজের খাবারটাও শেষ করেনি।
শুভ্রের মা একেবারে হতভম্ব। সে রাতে অরুণ আর ফিরে আসেনি। মা রাতভর ছেলের অপেক্ষায় বসে ছিলেন। আশে পাশের প্রতিটি শব্দে চমকে উঠছিলেন। কোনো আওয়াজে মা বার বার ভাবতেন এই বুঝি ছেলে ফিরে এসেছে। খবরটা পরে বাবা জানতে পারেন। তিনি খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। সুবীরকে নিয়ে এখানে-সেখানে খোঁজাখুজি করেন। শিবিরের এ পাশ থেকে অন্য পাশে হন্যে হয়ে ছুটে বেড়ান। কিন্তু কোথ্যাও অরুণের হদিস মেললো না।
এভাবে দুঃশ্চিন্তা আর উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটছিলো পুরো পরিবারটির। এক মাস পর একদিন হঠাৎ করেই অরুণ ফিরে আসে। এতদিন কোথায় ছিল, কীভাবে বেঁচে ছিল, এসবের সে কিছুই জানায়নি। তার চেহারায় ছিল গভীর এক দুঃখের ছাপ, চোখে কোনো অভিযোগ নেই, শুধু অসীম ক্লান্তি। মা তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেননি, শুধু জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শিবিরে থাকা মানুষগুলোও বুঝতে পারল, এই হারিয়ে যাওয়া শুধু অরুণের ছিল না, এ ছিল এক গোটা প্রজন্মের।
আঁখি মুছে অরুণ মাকে নরম গলায় জিজ্ঞেস করে-“শুভ্র কই মা? ওর কিচ্ছু অয় নাইত? আমাকে মাপ কইরা দিও তোমাগকে কষ্ট দেওয়ার জন্য।“ “শুভ্র ভাল আছে। ঘুমাইতাছে এহন। আমি জানি তুই ওরে নিয়া খুব চিন্তা করিস, নারে? তোর ভাই-বোনদের লাইগ্যা তোর খুব মায়া অয়, তাই নারে?”-মা অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে।
আসলে তাই। ভাই-বোনদের প্রতি অরুণের মমতা তার নিজের চেয়েও অনেক বেশী। ওরাই অরুণের জান-প্রান।
দুঃখ-কষ্ট আর এক অনিশ্চিত ভবিতব্যকে বুকে চাপা দিয়ে দিন কাটছিল অরুণদের। পুরো ক্যাম্পটিই যেন পরিনত হয়েছে এক ভয়ানক মৃত্যুপুরীতে। ডাইরিয়া আর আমাশার প্রকোপে পুরো ক্যাম্প যেন সয়লাব। ক্যাম্পে পানিশূন্যতার কারণে প্রতিদিন কেউ না কেউ মারা যেত। কোনো কোনো দিন মৃতদেহ সৎকার করার মতো লোকও থাকত না। এই মৃত্যুর মিছিল দেখে সবাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু অভ্যস্ত হয়নি মন। শিবিরের বাতাসেই যেন এক অদৃশ্য কান্না মিশে থাকত। “হরি বোল, বোল হরি” ধ্বনীর সাথে মরা লাশগুলি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নদীর পারে খোলা শ্মশানে। একের পর এক পোরানো হচ্ছে মৃত দেহগুলি।
এর মধ্যেই ঘটে গেল আরেকটি ঘটনা। শিবিরে একদিন দুপুরে ছোট্ট সঞ্জয় হারিয়ে যায়। সকালের দিকে সে খেলতে বের হয়েছিল, কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ মেলে না। সবাই মিলে খুঁজতে বের হয়, শিবিরের আশপাশের এলাকা তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়। কোথাও খোঁজে পাওয়া যায়নি সঞ্জয়কে। এই ঘটনায় অরুণ যেন উন্মাদ প্রায়। পরদিন সকালে, শিবির থেকে কিছুটা দূরে নদীর ধারে শ্মশানঘাটে সঞ্জয়কে পাওয়া যায়। অরুণই দেখতে পায়। সে একা বসে ছিল, চোখে অদ্ভুত এক শূন্যতা।
সঞ্জয়ের গলায় কথা আসছিল না। পরে সে জানায়, কেউ একজন তাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। কে, তা সে বলতে পারেনি। শ্মশানঘাটের সেই দৃশ্য ভয়ানক। চারপাশে পোড়া কাঠের গন্ধ, পচা দেহের ভয়াবহ অবস্থা। সঞ্জয় কীভাবে সেখানে টিকে ছিল, কেউ জানে না। কিন্তু তার এই নিঃশব্দ যাত্রা শিবিরের মানুষগুলোর মনে চিরস্থায়ী আতঙ্ক হয়ে রয়ে গেল।
দেখতে দেখতে প্রায় ছয়টি মাস তারা শিবিরে কাটিয়েছিল। এই যেন এক দুঃস্বপ্নের সময়। কিন্তু একদিন কেমন করেই যেন দুঃস্বপ্নের আধার ভেদ করে সোনালী সূর্য উঁকি মাড়লো। বিজয়ের সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো পুরো শরনার্থী শিবিরে। অরুণই দৌড়ে এসে খবরটি তার বাব-মাকে দেয়।
অরুণ ও তার পরিবার যখন প্রথম শুনল যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সেদিন ক্যাম্পের বাতাসে যেন এক অসম্ভব পরিবর্তন ঘটে গেল। ১৬ই ডিসেম্বর, বিজয়ের দিন। দুঃখ-যন্ত্রণা আর নির্ভীক প্রতীক্ষার দীর্ঘ সময় যেন হঠাৎ করেই এক উজ্জ্বল আলোর ঝলকানিতে মিলিয়ে গেল।
খবরটা আসার সাথে সাথেই ক্যাম্পজুড়ে দোলা দিল এক অভূতপূর্ব অনুভূতি। "বাংলাদেশ স্বাধীন! আমরা স্বাধীন!" - এই ঘোষণা যেন প্রতিটি হৃদয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিল। অরুণের মা সেদিন বহুদিন পর মুক্ত কণ্ঠে কাঁদলেন, যেন চোখের জলই তাঁর সমস্ত দুঃখ ধুয়ে নিচ্ছে। বাবার মুখে এক গভীর তৃপ্তির হাসি, যেন এতদিনের সমস্ত লড়াইয়ের মানে তিনি খুঁজে পেয়েছেন।
অরুণ ছুটে গিয়ে ছোট ভাই-বোনদের বলল, "শোনো, আমরা স্বাধীন হয়েছি! আর কোনো ভয় নেই, আর কোনো লুকোচুরি নেই।" সবাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরল। চারপাশে শুরু হলো "জয় বাংলা! জয় বঙ্গবন্ধু!" ধ্বনির সুর।
অন্ধকারে তিরমিরে প্রদীপের মতো যে স্বপ্ন এতদিন তাঁদের বুকের ভেতর জ্বলছিল, সেদিন সেই স্বপ্ন আলোর সাগরে পরিণত হলো। সেদিনের আকাশটা যেন আরেকটু নীল ছিল, বাতাসটা যেন আরেকটু প্রাণবন্ত। ক্যাম্পের সবাই একসাথে কেঁদে, হেসে, গান গেয়ে ঘোষণা করল, “এই আমাদের দেশ। বাংলাদেশ। আমাদের বিজয়!”
চলবে—পর্ব ৬)
ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট