শ্রীচরণেষু দাদা: ১৩

Bangla Post Desk
ড. পল্টু দত্ত
প্রকাশিত:২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৫৭ পিএম
শ্রীচরণেষু দাদা: ১৩

এইভাবেই কেটে গেলো টানা তিনটি সপ্তাহ। বুঝতেও পারেনি অরুণ। 

সময়টা যেনো কেমন করে হঠাৎ করেই উড়ে গেলো অদৃশ্য ডানায় ভর করে। প্রথম কয়েকদিনের দ্বিধা, সংকোচ আর অচেনা অঙ্গুলির মতো বেখাপ্পা অনুভূতি আজ যেন মিলিয়ে গেছে ছায়ায়। অরুণ এখন অভ্যস্ত, আত্মবিশ্বাসী। গলায় ঝুলানো পান-বিড়ি-সিগারেটের বাক্সটাই যেন তার নিত্য সঙ্গী। তার জীবন যেন এখন চেনা ছন্দে চলে—একটা নিখুঁত তালমেলে। হকারি আর তার মধ্যে গড়ে উঠেছে এক অদ্ভুত সখ্য, এক অন্তরঙ্গ বোঝাপড়া। দিন বদলের পালায় অরুণের পথচলা।

প্রথমদিকে একটু খারাপ লাগতো। লজ্জা আর সংকোচ তার বুকের মধ্যে দলা পাকিয়ে থাকতো। তবে  এখন আর তা নেই। সবই অভ্যাস। হকারদের রং ঢং কথা-বার্তা, হাঁটা-চলা, মুখের প্রবচন সবই রপ্ত করেছে অরুণ। একেবারে কাট-পিস। অরুণ এখন ক্রেতাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলে অরুণ। মুখ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হাসির মোড়কে মিষ্টি করে কথা বলে। দরদাম, ঠাট্টা-মশকরা, ক্রেতার মনের খুঁটিনাটি বুঝে পণ্য সাজানো—সবই যেন তার নখদর্পণে এখন। আশ্চর্য হলেও সত্যি, দিনে দিনে তার আয় বেড়েই চলেছে। রীতিমতো চমকে যাওয়ার মতো। ভালো অফিসের চাকরিও এমন রোজগারের নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। অনেক দিনই ২৫ থেকে ৩০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এর অর্ধেকের বেশি মুনাফা। খরচাপাতি বাদ দিয়েও ইতোমধ্যে তার হাতে জমেছে পুরো দুইশ আশি টাকা—না, এটা নিছক টাকা নয়। এটা তার সংগ্রাম, তার ঘামে ভেজা প্রতিটি দুপুরের প্রতিদান।

প্রতিদিন সকালে তিন বন্ধু—অরুণ, আসলাম আর তমাল—নেমে পড়ে শহরের রাস্তায়। পুরনো ঢাকার বিশাল শরীরকে ভাগ করে নেয় তারা তিনজন। কেউ যায় নিউমার্কেটের দিক, কেউ বা গুলিস্তান, আর কেউ পল্টনের ফুটপাত ধরে এগিয়ে যায় নতুন দিনের খোঁজে। অরুণ তার ঝুলিতে এনেছে একটু বৈচিত্র্য—পান, বিড়ি আর সিগারেটের সাথে সাথে কয়েকটা রঙিন প্লাস্টিকের খেলনা, সস্তা চশমা, ললিপপ আর মেয়েদের হেয়ার ক্লিপ। ছোট ছোট জিনিস, কিন্তু মানুষের প্রয়োজনেই তো জীবন চলে। এইসব সামান্য পণ্যে লুকিয়ে থাকে তার দিনের খাবার, রাতের ঘুম, আর সপ্তাহান্তে আনন্দের ঝংকার।

সারাদিন রোদের তাপে ঝলসে যাওয়া ফুটপাত, ঘামে ভেজা শার্ট আর পায়ের নিচে থরথর করে কাঁপতে থাকা পিচ-ঢালা রাস্তাই হয়ে উঠেছে অরুণ, আসলাম আর তমালের জীবনের কর্মভূমি। গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম,রেল স্টেশন, নবাবপুর, পল্টনের মোড়—এসব এখন অরুণদের দ্বিতীয় ঠিকানা। সন্ধ্যে হলে, শরীরটাকে কাঁধে করে তারা ফিরিয়ে আনে তাদের ছোট্ট গৃহে, সঙ্গে নিয়ে আসে দিনের অর্জন—টাকাপয়সা তো বটেই, তার চেয়েও বড়—একটি ছোট্ট বিজয়ের হাসি।

আর রবিবার? সেটাই যেন তাদের পুজো আর ঈদের দিন। কাজের ক্লান্তি ঝেড়ে তিনজন মিলে বেরিয়ে পড়ে ঢাকা শহরের মনটা ছুঁয়ে দেখতে। কোনো দিন বুড়িগঙ্গার পাড়ে বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তাকিয়ে দেখে নদীর বুক চিরে চলা লঞ্চ আর নৌকা, মানুষের আনাগোনা, জীবনের অবিরাম গতি। কোনো দিন সদরঘাটের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে—লোক দেখার নাম করে জীবনের গল্পগুলো দেখে ফেলে। কখনো বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসে, খবরের কাগজে প্যাঁচানো ঝালমুড়ির ঠোঙা হাতে নিয়ে, তিনজনে ভাগ করে নেয় সুখ-দুঃখের টুকরো স্মৃতি। হাসে, কখনো চুপ করে থাকে, আবার হঠাৎ বিষণ্ণ গলায় বলে ফেলে, "জীবনটা কতটা দ্রুত বদলায়, নারে দোস্ত?"

তাদের গল্প এখন ঢাকার বাতাসে ভাসে। আর অরুণ? সে তো এখন এক নতুন অরুণ—হতাশা থেকে উঠে আসা এক ক্ষুদ্র সাহসী যোদ্ধা।

তারা তিনজন একদিন সিদ্ধান্ত নিলো—এইভাবে চলা যাবে না। জীবনটাকে ঠকতে দেওয়া যায় না। এই ছন্নছাড়া ঘরহীন জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। চাই একটা নিজের ঠিকানা, একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই—যেখানে রাত্রে একটু নিশ্চিন্ত ঘুম আসে, ভোরে উঠে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা যায়। এখনতো আয়-রোজগার ভালোই হচ্ছে। তিন বন্ধু মিলে এক বস্তির প্রান্ত-ঘেঁষে, নবাবপুরের এক কোণায় ত্রিশ টাকা ভাড়ায় একটি ছোট্ট ঘর ভাড়া নেয়। জায়গাটি বস্তি নয় ঠিক, তবে নিম্নআয়ের ভদ্রলোকদের এলাকা—চুপচাপ, নীরব, ঘামে ভেজা পরিশ্রমের গন্ধে ভরা। সেই ঘরটি ছিল যেন তাদের তিনজনের প্রথম স্বপ্নের পদচিহ্ন।

সেই সময়, নবাবপুর যেন কোনো এক হলুদের আলোয় মোড়া পুরনো ছবির ফ্রেম—জীবনের ক্যানভাসে আঁকা বাস্তবতা, যেখানে প্রতিটি ঘ্রাণ, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি স্পর্শ হয়ে উঠত সাহিত্যের শিরা-উপশিরায় বয়ে চলা গোপন নদী। আর সেই ছবির মধ্যে ফুটে ওঠে তিন যুবকের সাহসী যাত্রা—অরুণ, আসলাম আর তমাল। নতুন স্বাধীন দেশের বুক জুড়ে তখনও রয়ে গেছে যুদ্ধের ক্লান্ত ছায়া, ক্ষুধা আর বেকারত্বের হাহাকার। কিন্তু বন্ধুত্বের আলোয় ঝলমলে অরুণের চোখে ছিল এক অন্যরকম আশাবাদ। আসলামের কণ্ঠে ছিল নরম অথচ দৃঢ় উচ্চারণ, আর তমালের চুপচাপ চোখ দুটো যেন সব কিছু দেখে, গিলে নেয়, হৃদয়ে জমা রাখে।

তিন বন্ধুর জন্য টিনের ছাদের ঘরটি মন্দ নয়। বেশ ছিমছাম।

তবে টিনের ছাদের ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ত বৃষ্টির ফোঁটা, যেন বেদনার সংগীত। ঘরের এক কোণায় একখানা ছোট চৌকি—যেখানে রাতের গভীরতা ভাগ করে নিত অরুণ, অন্যদিকে স্যাত স্যাতে মাটিতে পাত পেতে ঘুমাত আসলাম আর তমাল। রান্না হতো সস্তা স্টোভে, ঘরের মধ্যেই। একদিন একজন রাঁধে, আর সবাই মিলে বাজার করে। টিউবওয়েলের জল ভোরে না ধরলে পিছুটান—সাতটার পরে জলের দেখা নেই।

একটা মগ, তিন-চারটি চায়ের কাপ, কিছু পরনের পুরনো জামা-প্যান্ট, লুঙ্গি আর কিছু প্লেট—তাদের সংসার, তাদের জগত, তাদের লড়াই। ঘরটি নেওয়ার পর কিছু লেপ-তোষক আর বালিশ কিনেছে। গুলিস্তানের ফুটপাত থেকে।

সেই সময় পুরনো শহরের ব্যস্ততম এলাকা ছিল নবাবপুর। লোকে লোকারণ্য। টুং টাং করে রিক্সাগুলো রাস্তায় চষে বেড়াত। ঘোড়ার গাড়ীগুলো ঠক ঠক আওয়াজ করে ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে নবাবপুর হয়ে গুলিস্তানে আসা যাওয়া করত। ভোর না হতেই কোলাহল শুরু। ঠেলাগাড়ির ঘর্ঘর শব্দ, দোকান খোলার টিনের আওয়াজ, আর হকারদের ডাক—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত রিদম। ছোট ছোট যন্ত্রপাতির দোকান, টিনের ঝাঁপ, ধুলোমাখা ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অগণিত মানুষ—সবাই যেন যুদ্ধ করছে নিজ নিজ অস্তিত্বের জন্য। সেই সময়টা নবাবপুর ছিল আত্মসম্মানের প্রতিচ্ছবি।

সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই দোকানপাট একে একে বন্ধ হয়ে যেত, শহরের কোলাহল যেন একটু শান্ত হতো। কিন্তু তখনই প্রাণ ফিরে পেত পাড়ার পানের দোকান আর চায়ের দোকানে। সেখানে জমে উঠত আড্ডা—দেশ নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা, জীবনের চড়াই-উতরাই নিয়ে দীর্ঘশ্বাস, কিংবা প্রেমে প্রতারিত কোনো বন্ধুর দুঃখের কথায় হালকা হাসির ঢেউ।

এই আড্ডায় ‘দেবদাস’ নিয়েও চলত বিস্তর তর্জমা। দিলীপ কুমার আর সুচিত্রা সেনের সেই কালজয়ী অভিনয়ের কথা উঠে আসত বারবার। কারো মতে, শরৎচন্দ্রের ব্যথাটা সবচেয়ে ভালো ফুটিয়ে তুলছিলেন দিলীপ সাহেব; আবার কেউ বলতেন, সুচিত্রার পার্বতী যেন সত্যিই বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছেন।

তখন পুরনো ঢাকার সিনেমা হলগুলো—মিতালী, সোনালী, প্রিন্স, আজাদ বা রাজমহল—ছিল একেকটা সময়ের সাক্ষী। ‘দেবদাস’ যখন ওই হলগুলোর পর্দায় নামত, মানুষ পাঁজি দেখে দেখে দিন গুনতো। নতুন জামা পরে পরিবার-পরিজন নিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়াটা ছিল এক উৎসব। ছেলেমেয়েরা আগেভাগেই লাইন দিয়ে টিকিট কাটতো, আর সিনেমা শেষে ফেরার পথে কেউ কেউ আবার ঢুকে পড়ত সেই চায়ের দোকানের আলো-আধারিতে, আলোচনার দ্বিতীয় পর্বে।

এইভাবে সিনেমা, আড্ডা আর জীবনের টুকরো গল্পে জেগে থাকত একটা সময়—যেখানে মানুষ সিনেমার পর্দায় যেমন গল্প খুঁজত, তেমনি নিজেকেও খুঁজত আশেপাশের মুখগুলোর ভেতর।

সে সময়ে এই শহরে, এই নবাবপুরে, রাতের ঘোরে ঘুরে বেড়াতো গল্পের মতো কিছু মানুষ—যাদের চোখে ছিল না ঘুম, ছিল শুধু স্বপ্ন।

অরুণ, আসলাম আর তমাল—তারা ছিল সেই স্বপ্নের শরিক। নবাবপুর তখন শুধু একটা এলাকা ছিল না, ছিল এক জীবন্ত উপন্যাসের পৃষ্ঠা, যেখানে তারা তিনজন লিখছিল নিজস্ব গল্প। কষ্ট ছিল, অভাব ছিল, তবু সেই ঘর, সেই রান্না, সেই চায়ের কাপ—সবকিছু মিলে এক রঙিন, সাহসী, হৃদয়গ্রাহী ছবি হয়ে উঠেছিল।

আর সেই ছবির পেছনে জ্বলজ্বল করে লেখা—

"জীবন থেমে থাকে না। ঘরের ভাঙা ছাদ থেকেও দেখা যায় নীল আকাশ।"

প্রথম দুয়েক সপ্তাহ গ্রামের কথা তেমনভাবে মনে আসতো না অরুণের। গ্রামের মেঠো-পথ, কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া সকালে হাঁসেদের ডাক, কিংবা উঠোনে মায়ের শাড়ি শুকোনোর দৃশ্য—সব যেন স্মৃতির আড়ালে হারিয়ে গিয়েছিল।

আর পরিবার?

মনে আসতো না খুব একটা। সে যেন নিজেকে ভুলে থাকার কঠিন এক সাধনায় নিয়োজিত ছিলো। তবে ইদানীং রাতের নীরবতায়, যখন শহরের কোলাহল নিস্তব্ধ হয়ে আসে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে মায়ের মুখ। সেই মুখ, যেটায় দুশ্চিন্তা আর আশীর্বাদের এক অপূর্ব মিশ্রণ ছিল। আর মনে পড়ত বাবার সেই দৃশ্য—পায়ের নিচে ধুলো ধরেছিলেন যেদিন, যেন সেই ধুলোই আশীর্বাদের মাটি। অরুণ সেদিন বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল। আর সেই সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল এক সংসারের হাসি।

তারপর থেকে বাড়িটা আর আগের মতো নেই। সময়ের ঘড়ি থেমে গেছে যেন সেখানে। মা দিন গোনেন আকাশের দিকে তাকিয়ে—যেন মেঘের ফাঁকে খুঁজে পান ছেলের মুখ। রান্নাঘরে আগুন জ্বলে বটে, কিন্তু যেন আগুনের তাপে ভালোবাসার তপ্ততা নেই।

হাঁড়িতে আটার জল ফুটলেও তার স্বাদ কাঁচা থাকে—মা শুধু রান্না করেন, খাওয়ার লোক নেই। প্রতিদিন বিকেলে বারান্দায় বসে থাকেন মা, চোখে সেই দৃষ্টির দীপ্তি, যা সময়ের অপেক্ষাকেও অতিক্রম করতে পারে। তিনি তাকিয়ে থাকেন দূরে—যেন প্রতিটি শব্দে শুনতে চান ছেলের পায়ের শব্দ।

বাবা চুপ হয়ে গেছেন।

যিনি আগে কথা বলতেন, প্রতিবাদ করতেন, এখন শুধু হুঁকোর ধোঁয়ার ভিতরে গুম হয়ে থাকেন। অরুণের বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে দেখেছেন, যেখানে যাওয়া সম্ভব, সবখানে গিয়েছেন। ফিরে এসেছেন একরাশ হাহাকার নিয়ে। দিন যায়, বাবার কাজের মনোযোগ কমে যায়, তবু সংসার টানতে হয়—ঘর তো শূন্য, তাই কাজে যেতে হয়।সন্ধ্যায় হুঁকো টানতে টানতে শুধু বলেন—

“ছেলেটা কি ঠিক আছে?”

তারপর আর কোনো শব্দ নেই। শুধু একটা দীর্ঘ, গাঢ় নীরবতা, যেটা প্রতিধ্বনির চেয়েও বেশি শব্দ করে।

পাড়া-প্রতিবেশীদের মুখে উঠে আসে নানা মন্তব্য—

“ছেলে নষ্ট হয়ে গেছে…”

“শহরে টাকা কামাই করতে গেছে…”

“জানেন, বন্দরে নাকি হকারি করে…”

কারও চোখে কৌতূহল, কারও চোখে করুণা।

কিন্তু এই দৃষ্টি মায়ের চোখ ছুঁতে পারে না। তার চোখে আছে শুধু এক চুপ থাকা কান্না, আর বাবার চোখে আছে হেরে যাওয়া আশার ছায়া।

একদিন খুব ভোরে, যখন ভোরের আলো জানালায় মুখ রাখেনি এখনও, মা নিঃশব্দে বাবাকে বলেছিলেন—

“যদি একদিন পোলাডা ফিইরা আইয়ে … আমি তারে কিছু কইতাম না। রাগ-টাগ কইরাম না, কিচ্ছু জিজ্ঞাস করতাম না “তুই কই ছিলি এতদিন?” শুধু পোলাডারে ভালা কইরা বুকটার মধ্য চাইপ্যা ধইরাম। আমার এই বুকটা পোলাডার লাইগ্যাই খালি পইরা আছে।“-এই বলেই মা শাড়ীর আচলে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

অরুণের জীবনে এখন একটু স্থিরতা এসেছে। অবশেষে তার একটি ঠিকানা হয়েছে—নিজের পরিচয়ের মতোই ক্ষীণ, তবু ঠিকানা। খোঁজে পাওয়া গেছে রোজগারের পথও।

এই নতুন ঠিকানা হওয়ার পর থেকেই অরুণের মন পড়ে থাকে সেই দূরের বাড়িতে, পুরনো উঠোন, মায়ের মুখ, বাবার চিন্তিত চোখ আর ভাইদের কচি কণ্ঠের ডাক তার বুকের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয় প্রতিদিন।
গুলিস্তানের পোস্ট অফিস থেকে সে একশো চল্লিশ টাকা পাঠায় বাড়িতে—তার প্রথম উপার্জন। শুধু টাকা নয়, সঙ্গে পাঠায় একটি চিঠিও। সেই চিঠিতে থাকে নতুন ঠিকানার খবর, আর হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা মিশিয়ে লেখা কিছু কথা।

মাকে লেখা অরুণের প্রথম চিঠি-

“মা,

শুভেচ্ছা নিও। জানি না এই চিঠি যখন তোমার হাতে পৌঁছাবে, তখন তুমি কোথায় বসে থাকবে। বারান্দায় নাকি উঠোনে? চুলে রুপোর রেখা আরও গাঢ় হয়েছে কি না, তোমার শাড়ির কোণ দিয়ে অশ্রু মুছে ফেলবে কি না—কিন্তু জানো মা, আমার বুকের ভেতর প্রতিটি নিশ্বাসে তুমি আছো, তোমরা আছো।

তোমার অরুণ এখন আর গৃহহীন নয়। এখন আমার একটা ঠিকানা আছে, যেটা গুলিস্তানের কংক্রিটের ভিড়ের মাঝেও আমার নিজের বলতে পারি। একটা ছোট ঘর, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মিলে নিয়েছি। ঘরটা বড় নয়, ছাদের ফুটো দিয়ে মাঝে মাঝে বৃষ্টি পড়ে, আকাশের চাদেরও দেখা মেলে। কিন্তু জানো মা—এই ঘরটার প্রতিটি কোণে আমি তোমার মুখটা কল্পনা করি।

তোমার ছেলে এখন রোজগার করে। খুব বেশি নয়, কিন্তু দু'মুঠো ভাত জোটে। এই মাসে ১৪০ টাকা পাঠালাম—বাড়ির জন্য। জানি, এটা তোমাদের কষ্টকে ঘোচাতে পারবে না। কিন্তু বিশ্বাস করো মা, এই টাকাগুলোর সঙ্গে আমার ঘামের গন্ধ মিশে আছে, মাটির টান মিশে আছে, তোমার জন্য অসীম টান মিশে আছে।

চিঠি লিখতে লিখতে হাত কাঁপে মা, চোখে ঝাপসা হয়ে আসে। তবু লিখছি, কারণ না লিখলে কষ্টটা সহ্য হয় না।

মা, পালিয়ে আসা ছাড়া আর কোন পথ ছিল না আমার।

তখন চারদিকে অন্ধকার—বাড়ির খুপরি ঘরে বসে আমি শুধু ভেবেছি—কীভাবে তোমাদের জন্য কিছু করবো! সে রাতে কোনো বিদায় ছিল না, কেবল কান্না চেপে রেখে চলে এসেছিলাম। এই অপরাধ ক্ষমা করে দিও মা। আমি জানি, তোমার চোখ আজও প্রতিদিন সন্ধ্যায় চৌকাঠে তাকিয়ে থাকে, সেই হারিয়ে যাওয়া ছেলেটার অপেক্ষায়।

বাবাকে বলো, যেন মন খারাপ না করে। আমার হাত এখন একটু একটু করে শক্ত হচ্ছে। ওনার জন্য একটা নতুন ধুতি আর পাঞ্জাবী কিনে ফেলো—পুরনো ছেঁড়া জামাটা যেন আর না পরে। বাবার পায়ের আওয়াজে যেন আত্মসম্মান ফিরে আসে।

তুমি নিজের জন্য একটা শাড়ি নিও, মা। সেই পুরনো হালকা নীল শাড়িটার বদলে কিছু উজ্জ্বল রঙের শাড়ি পরো, যেন তোমার মুখে আবার আলো ফোটে। তোমার মুখের সেই কাঁটার মতো ক্লান্তির রেখাটা আমি ভাঙতে চাই মা, এই দূরত্ব থেকেও।

সুবীর, সঞ্জয় আর বিকাশকে বলো যেন পড়াশোনা ঠিকমতো করে। শুভ্রকে আদর দিও। মীনাক্ষী বাড়ীতে এসেছে কি? আমার ছোট বোনটাকে আদর দিও।আমার ছোট ভাই বোনগুলো যেন অন্ধকারে না হারিয়ে যায়। আমার ঘামে তাদের আলোর পথ গড়ে উঠুক।

টাকা-পয়সার জন্য চিন্তা করো না।

তোমার ছেলে এখন রোজ পায়ে রক্ত ফেলে, কিন্তু মাথা উঁচু করে চলে। প্রতিমাসেই টাকা পাঠাবো, কথা দিচ্ছি মা।

শুধু তুমি ভেঙে পড়ো না। শক্ত থেকো, আমার জন্য। একদিন আমি ফিরে আসবো—চোখে আলো, হাতে উপহার, আর বুকভরা গর্ব নিয়ে। তখন তোমার কোলে মাথা রাখবো, বলবো—“এইবার আমি ফিরেছি, মা।”

অপেক্ষায় থাকো, মা। কাঁদো না। আমি ভালো আছি—এই কথা ধরে রেখো হৃদয়ে।

ইতি,

তোমার অনুতপ্ত, হতভাগ্য

অরুণ।“

প্রথম উপার্জনের টাকা দেশে পাঠাতে পেরে অরুণের বুকের ভেতর এক অদ্ভুত আবেগের ঢেউ উঠে আসে—এক ধরনের নিঃশব্দ উল্লাস, এক নিবিড় আনন্দ, যেন শত দুঃখের মধ্যেও ফুটে ওঠা প্রথম বসন্ত-ফুল। তার জীবন যেন পেল এক নতুন দিগন্ত—ভাঙা ইটের দেয়ালে ভেসে ওঠা অদৃশ্য রঙের রেখায়, টিনের ছাদের নিচে বৃষ্টির ফোঁটার মতো গোপন স্বপ্নের শব্দে, আর অচেনা শহরের কোলাহলে জন্ম নেওয়া এক ক্ষুদ্র অথচ অদম্য সাহসের ছাপচিত্রে। সেই সাহস, যেটা একদিন জন্ম নেয় বুকের গভীরে জমে থাকা কান্নার সমুদ্র পেরিয়ে, পেছনে ফেলে আসা প্রতিটি বিকেলের আলো-ছায়া, প্রতিটি হাহাকার-মাখা বিদায়ের সাক্ষী রেখে।

আজকের অরুণ সেই নিঃশব্দ পালানো ছেলেটি নয়—সে এক নির্মিত প্রাণ, যার হাতে এখন ঘামের গন্ধ মেশানো মুদ্রা, যার চোখে ঘরে ফেরার অসমাপ্ত অঙ্গীকার। ছোট্ট ঘরের কুঁজো আলোয়, তিন বন্ধুর শেয়ার করা ভাতের থালায়, আর পরণের ছেঁড়া জামায় লুকিয়ে থাকে যে ঐশ্বর্য। তা কোনো ধনসম্পদের কাঁপা কণ্ঠ নয়, বরং নিঃস্বতার মধ্যেও অপরাজেয় এক আত্মমর্যাদার সুর।

আর দূরের সেই ধুলো-ঢাকা গ্রাম—সন্ধ্যার হালকা কুয়াশায় চৌকাঠে বসে থাকা মায়ের উদাস দৃষ্টি, বাবার হুঁকোর ধোঁয়ায় মিলিয়ে যাওয়া হারানোর দীর্ঘশ্বাস—সেখানেও পৌঁছে যায় অরুণের হাতের লেখা চিঠির শব্দ। নিছক সংবাদ নয়, সেই চিঠি যেন মাতৃহৃদয়ের রক্তাক্ত দুপুরে ছুঁয়ে আসা এক আশার হাওয়া। এই গল্প তাই শুধু এক তরুণের হকার হয়ে ওঠার বৃত্তান্ত নয়—এ এক নিভৃত আত্মত্যাগের অনুপম মহাকাব্য, যেখানে প্রত্যেক হাঁটা পথ, প্রতিটি নিঃশ্বাস, হয়ে ওঠে ভালোবাসার অব্যক্ত ভাষা।

আর একদিন—সময়ের কঠিন সিঁড়ি বেয়ে, জীবনের সব চোরাবালি মাড়িয়ে—অরুণ ঠিক ফিরবে। 

হয়তো একটু দেরিতে, হয়তো একটু ক্লান্ত হয়ে, তবু মায়ের কোলে মাথা রেখে, ভেজা চোখে একটিমাত্র কথা বলবে—

"আমি ফিরেছি, মা।"

আর তখন তার চিঠির শেষ সেই নির্ভুল উচ্চারণ সত্যি হয়ে উঠবে—

“জীবন থেমে থাকে না। ঘরের ভাঙা ছাদ থেকেও দেখা যায় নীল আকাশ।”

চলবে—

ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট