শ্রীচরেণেষু দাদা: পাঁচ


রাতের গভীর অন্ধকার ভেদ করেই নৌকা এগিয়ে চলছে। নদী পার হতে পারলেই ভারতের সীমান্ত।
নৌকার ছলছল শব্দ আর শাড়ীর আচলে মুখ ঢেকে মায়ের হৃদয়বিদারক কান্নার মাঝেই অরুণের মন যেন এক বিস্তৃত প্রান্তরে হারিয়ে গেল। দুরে অনেক দুরে। একটি অসহায় মুখ ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বুকটা কেমন ছটফট করছে। মনে হচ্ছিল, তার হৃদয়টা একটা তপ্ত বালুর মরুভূমি। প্রচণ্ড বেদনার ঝড় উঠেছে যেন সেই মরুভূমিতে। কান্নায় বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে। সেই ঝড়ের রাতের ছিমছাম অন্ধকারের ভেতরেই অরুণের মনে হলো নৌকার এককোণে ময়লা জামা-কাপড় আর এবড়ো-থেবড়ো চুলে বিষন্ন চোখে দাঁড়িয়ে আছে তার ছোট বোন মীনাক্ষী। কি করুন অসহায় লাগছিলো মীনাক্ষীকে। ওর এমন অভাগিনী চেহারা অরুণ আগে কখনো দেখেনি। সে যেন অরুণের ভেতরের সমস্ত অস্থিরতা টের পাচ্ছিল। হঠাৎ শুভ্রের কান্নায় অরুণের যেন ভাবনায় ছেদ পড়লো।
সুবীর যেন মাকে কিছু বলছে-“মা আমার খিদা লাগছে। খানা দাও”।-সুবীরের কণ্ঠ খুব ক্ষীণ, কাতর আর ক্লান্ত মনে হচ্ছিল।
মা কোন উত্তর দিচ্ছে না। এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পাশেই বাবা।
-“সুবীর, বাবা, এইরকম কইর না। একটু চুপ কর। দেখনা চারিদিকে কেমন অন্ধকার। এখন কথা বলে না। আর একটু পরেই আমরা চইলা আইসব। লক্ষ্মী ছেলের মতো একটু চুপ কইরা বইস।
এবার সঞ্জয় একটু নড়া চড়া করে উঠলো। বাবার এপাশ থেকে মায়ের কাছে গিয়ে গা ঘেঁষে বসলো। মায়ের মুখে ডান হাত দিয়ে ধরলো। খুব আস্তে আস্তে বললো-“মা আমরা কই যাইতাছি?”
মা এবার সঞ্জয়ের দিকে খুব অসহায়ের মতো তাকিয়ে বললো-“আমরা অনেক দুরে যাইতাছি বাবা। অনেক দুরে। তুমি এখন একটু চুপ কইরা শুইয়া থাক। কথা বইল না।“
সুবীর-“মা আমি খাইতে চাই। আমারে একটু খাইতে দাও না।“
মা: (কোলের কাছে সুবীরকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে) "আর একটু অপেক্ষা কর বাবা। এখন একটু চুপ কইরা আমার কোলে শুইয়া পড়।“
সুবীর: (মায়ের হাতটা বুকের কাছে টেনে এনে খুব কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বিড়বিড় করে) "আমরা এতো গরীব কেন, মা? আমাগো কেন এতো কষ্ট। আমরা কই যাইতাছি মা। আমরা আর গ্রামে ফিইরা যাইতাম না?”
মা একেবারে পাথর নিস্তব্ধ। যেন এক ঝাঁক রক্তিম সূর্যাস্তের মতো নিঃসঙ্গ। তার মুখে কোন শব্দ নেই। মুখ ফোটে কিছুই বলতে পারলো না। ছেলের কষ্ট ভরা প্রশ্নগুলো তাকে যেন স্তব্ধ করে দিয়েছে।
এদিকে, নৌকা এগিয়ে চলছে নতুন জীবনের দিকে।
আর অন্যদিকে তার বোন হন্যে হয়ে এগিয়ে চলছে উল্টো পথে। কাকার সাথে গ্রামে ফেরার অভিযানে। কাকীমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাকাই জোড় করে মীনাক্ষীকে নিয়ে খুব ভোরে ঘর থেকে বেড়িয়ে যান। যে করেই হোক মীনাক্ষীকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতেই হবে। এই নিয়ে কাকা যেন এক অশান্তির মধ্যে আছেন। গ্রাম থেকেও কোন খবর আসছে না। মনটা খুব বিচলিত। শহরের অবস্থা তখনো অতো উত্তপ্ত হয়ে উঠেনি। লোকাল ট্রেন তখনো চলছিলো। তাই গ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত।
সময়টা খুবই অস্থির। চারিদিকে বেশ থমথমে ভাব। অনেকেই শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। বাক্স-পেটরার বহর দেখেই আন্দাজ করা যায় কি শঙ্কা নিয়ে মানুষ ছুটে চলছে। অস্থিরতার ছাপ সবার মধ্যে। আর সেই অস্থিরতার ছাপ স্পষ্ট ছিল ট্রেনের কামরাতেও। যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। কাকীমা বলছিলেন, “কি জানি, মীনাক্ষী, এভাবে যাওয়া ঠিক হবে কি না? না জানি পথেই কিছু হয়ে যায়।”
কিন্তু কাকা ছিলেন দৃঢ় সংকল্পে। "যা হোক। ওকে দাদার কাছে রেখে আসতে হবে। তাহলেই আমার চিন্তা দূর হবে। তুমি অমঙ্গলের মতো কথা বলো না। ফিরতি ট্রেনেই আমি চলে আসবো। যদি রাত হয়ে যায় কাল ভোরে রওনা দেবো“- বলেছিলেন একেবারে দৃঢ়তার সঙ্গে।
রিক্সা করেই স্টেশনে এসে নামলেন। স্টেশনটা ছিল গিজগিজে ভিড়ে ভর্তি। লোকজন একদিকে ছুটছে। অন্যদিকে ট্রেনের কামরাগুলো থেকে উঁকি মারছে উথাল-পাতাল মানুষের ভিড়। ভিড়ের মধ্যেই কোনভাবে মীনাক্ষী ও তার কাকা কামরায় প্রবেশ করে। ট্রেনের সিটগুলো একেবারে ভর্তি। সিটে বসা তো দূরের কথা, দাঁড়িয়ে থাকার জায়গাও বড়ই কম। মীনাক্ষীকে এক কোণে বসিয়ে দিয়ে কাকা পাশের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে পড়েন। আশেপাশের লোকেরাও দাঁড়িয়ে ছিল।
লোকেরা একে অপরকে ঠেলে দিচ্ছিল আর "দাড়াও, দাড়াও, এই জায়গায় জায়গা নেই!" —বলে চেঁচামেচি করছিলো।
কিছু লোক আবার গরমে পিপাসায় বিরক্ত হয়ে ছেঁচিয়ে উঠছিল-“শালার গরম!”
একজন পকেটমার সহ্যের শেষ সীমানা পার করে বলল, “কি ভাই, ইলেকট্রিক মিটার কেটে দিলো তো? খালি ভিড়, গরম আর শব্দ!”
আরেকজন, যিনি বসতে পারছিলেন না, গরমে অস্থির হয়ে বলেন, "এটা কি! একখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে শরীরটা পুড়ে যাচ্ছে, এতো মানুষ...পাকিস্তানী হারামজাদারা দেশটাকে শেষ কইরা দিল। তবে বুঝবে ঠেলা, বাঙালী কি জিনিষ।"
মীনাক্ষী এক কোণে বসে, চুপচাপ, নিজের চিন্তায় মগ্ন ছিল। কাকা সবার কথা অগ্রাহ্য করে তার পাশেই চুপ চাপ দাঁড়িয়ে আছেন। এক হাতে মীনাক্ষীর হাতটা ধরে রেখেছে এবং মীনাক্ষীকে আশ্বাস দিচ্ছে-
"মীনাক্ষী, ভয় নেই, এই যে, লাকসাম পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেই হলো। তারপর একটা বেবি ট্যাক্সি নিয়ে গ্রামের বাজারে পৌঁছাতে পারব। তুই কোন চিন্তা করিস না”।
কাকা মৃদুস্বরে ঠিকই কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন, যদিও তার চোখে ছিল আতঙ্কের ছায়া। মীনাক্ষী কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে কাকার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে, কাকা।”
প্রচণ্ড গরম, কোলাহল, উত্তেজিত মানুষের মুখভরা মন্তব্যের মাঝে মীনাক্ষী তার কাকার সাথে সিটের পাশে বসে বসে আবোল তাবোল ভাবছিল। তবে তার মনের এক কোণে খুশির জোয়ারও বয়ে যাচ্ছিল। কাকাদের বাড়িতে আসার পর এই প্রথমবার পরিবারের সবার সঙ্গে দেখা হবে। যুদ্ধের ভাবনা এখনো তার মনে প্রভাব ফেলেনি, কারণ সেই চিন্তা করার মতো বয়স তার হয়নি। তবে সে বুঝতে পারছে দেশে একটা অস্থির পরিস্থিতি চলছে। তাই মাঝে মাঝে তার মন ভারী হয়ে ওঠে, যদি গ্রামে যাওয়া আর না হয়।
হঠাৎ মীনাক্ষীর পেছনে একটা লোক ভিড়ের চাপে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। এক ঝটকা মেড়ে ইঞ্জিন স্টার্ট দেওয়ার সাথে সাথে ট্রেনটা চলতে শুরু করলো। সাথে সাথে আরও অনেকেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। আর কি! শুরু হলো হট্টগোল…
"আর দাঁড়া! এই মানুষগুলা একদম গাধার মতো গুঁতাগুঁতি করে কেন!"
একজন দাঁত কেলিয়ে মুখের ভেতর থেকে পানের পিক ছিটাতে ছিটাতে চেঁচিয়ে উঠল, "দ্যাখেন ভাই, টানাটানি কইরা পা কাইটটা দিলেন তো! এত ভাঁড়ি জুতা পইড়া গাড়িতে উঠেন কেন?"
সামনের দিক থেকে এক বৃদ্ধা আতঙ্কিত গলায় বজ্র-নিনাদের মতো বলে উঠলেন, "হামার মাইয়া পইড়া গেড়ে রে! এই ভিড় ঠ্যালা কেন ভাই? এই, ধাক্কা মারিস না! নইলে উলটাইয়া পড়বি।"
পাশ থেকে আরেকজন হতাশ গলায় বলে উঠল, "আরে ধুর! এই গ্যাঞ্জামের মধ্যে আসলামই বা কেন? এইটা কি গরুর গাড়ি নাকি? খালি ঠেলা আর ঠেলা!"
ট্রেনের ভেতর যেন এক বিশাল কোলাহলের মেলা। ধাক্কাধাক্কি, চিৎকার, কান্না—সব মিলিয়ে পরিবেশটা ছিল অস্থির। কেউ তাড়াহুড়ো করছে, কেউ আতঙ্কে চুপ হয়ে বসে আছে, আর কেউবা উচ্চস্বরে অভিযোগ জানাচ্ছে। ট্রেনটা যেন বিপদের বাহন হয়ে উঠেছে।
পাশের সিটে দাঁড়িয়ে থাকা একজন লোক ক্ষোভে চেঁচিয়ে উঠল, “বাড়ি যাওয়ার পথে এই ভিড়, গরম, কি যে অসহ্য! কেউ ঠিকভাবে দাঁড়াতে পারছে না। পকেট মারা, অপহরণ, যুদ্ধের ভয়—সব মাথা চাড়া দিচ্ছে। ঠেলা বুঝ এবার বাঙালী। ট্রেনে উঠলেই মনে হয়, জীবন নিয়ে নামতে পারব তো?”
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলা তার সায় দিয়ে বললেন, “বাবা, আমি তো ভয়েই শেষ। এই ট্রেনের মধ্যে এত লোক, একটু দাঁড়ানোর জায়গা নেই। যদি কোনও বিপদ হয়, তখন কি করব? এই যাত্রাটা শেষ হবে তো?”
একজন ভদ্রলোক তার কথায় শান্ত স্বরে যোগ করলেন, “দেখুন, ভয় পেলে চলবে না। এখন আমাদের একসাথে থাকতে হবে। সবার ভয় আছে, কিন্তু আমরা যদি ধৈর্য ধরে থাকি, তাহলে সবার পাশে থেকে সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারব।”
মীনাক্ষী তার কাকার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বলল, “কাকা, ভয় লাগছে। আমরা যেতে পারব তো?” কাকা তার কাঁধে হাত রেখে বললেন,“কোনও ভয় নেই মা। আমি তো আছি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা লাকসামে চলে যাব। তুমি শক্ত করে আমার পা ধরে বসে থাকো, কোনও চিন্তা করো না।” এই কথায় যেন মীনাক্ষী কিছুটা সাহস পেল। কিন্তু ট্রেনের গরম, ঘাম, আর সবার আতঙ্কে পরিবেশটা তখনও ভারী।
ট্রেনটি যখন ধীরে ধীরে গড়াতে শুরু করল, চারপাশের পরিবেশ এক অন্য রকম আবহে ভরে উঠল। ইঞ্জিনের আওয়াজ, চাকাগুলোর খটখট শব্দ আর ভিড়ের মাঝে মানুষের হাঁসফাঁস যেন একে এক জটিল সুরেলা সংগীতের মতো শোনাচ্ছিল। ধীরে ধীরে ট্রেনের ভেতরের উত্তেজনা আরও বাড়তে লাগল। কেউ জানালার পাশে হেলান দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল, কেউ বা আবার বসার জায়গা খুঁজে হা-হুতাশ করছিল। কারো চোখে আতঙ্ক, কারো মুখে ক্লান্তি—এমন এক অস্থিরতায় সবাই নিমগ্ন ছিল।
ট্রেনটা একটু গতি ধরতেই ঝাঁকুনির পরিমাণ বাড়ল। এক বৃদ্ধ তার থলেটা আঁকড়ে ধরে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার ছেলে দিকে দিকে তাকিয়ে বললেন, “বাবা, একটু সাবধানে রাখিস। আমাদের সমস্ত সঞ্চয় এই থলেতে। ছিনতাইয়ের ভয় পাই।” ছেলেটি মাথা নেড়ে নিশ্চয়তা দিল, কিন্তু তার মুখেও চিন্তার রেখা। এক কোণে দাঁড়ানো এক কিশোরী তার ছোট ভাইয়ের হাত ধরে চোখ বন্ধ করে ছিল। সে চোখ খুলে ফিসফিস করে বলল, “ভাইয়া, আমাদের গ্রামে গিয়ে কি আর শান্তি পাব? যুদ্ধ কি আমাদের বাড়ি পর্যন্ত চলে আসবে?” ছোট ভাই কিছু না বলে শক্ত করে তার হাত চেপে ধরল। ট্রেনের গরম পরিবেশ আরও অসহনীয় হয়ে উঠল। জানালা দিয়ে আসা হালকা বাতাসও যেন উষ্ণ আর ক্লান্তিকর। দূর থেকে শোনা গেল একটি শিশুর কান্না, আরেকটি পরিবারের মা তার ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। “চুপ কর বাছা, আর একটু সময়। আমরা খুব শিগগিরই বাড়ি পৌঁছে যাব। খোদা ভরসা।”
ট্রেনের দুলুনি আর তীব্র ভিড়ের মাঝে কেউ হালকা গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করল, “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।” গানের সুরে কিছু লোক মুখ তুলে তাকাল, কেউ কেউ সুরে সুর মেলাল। কিছুক্ষণ জন্য যেন পরিবেশ একটু শান্ত হল।
ট্রেনটা যখন বাঁক নিলো, সবাই একটু নড়ে চড়ে বসলো। কেউ চুপচাপ সৃষ্টিকর্তার নাম নিচ্ছিল, কেউবা তাদের প্রিয়জনের কথা ভাবছিল। ট্রেনের চাকা চলতে চলতে এক মৃদু সুর তুলছিল, আর সেই সুরের মধ্যে মিশে ছিল ভয়ের সঙ্গে সামনের দিকে এগিয়ে চলার অদম্য ইচ্ছা।
এক পর্যায়ে কিছুক্ষণের জন্য পুরো ট্রেনটা নিঃশব্দ হয়ে গেল। লোকজনের কথোপকথন থেমে গেল, যেন কেউই আর শব্দ করতে চায় না। মীনাক্ষী, কাকা, আর অন্যান্য যাত্রীরা নিজেদের ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেলেন। গরম আর ক্লান্তির মধ্যেও তারা যেন নিজেদের কল্পনায় এক শান্তির জায়গায় পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখলেন। যুদ্ধের গর্জন থেকে কিছু সময়ের জন্য হলেও যেন পালানোর চেষ্টা করল সবার মন।
একদিকে শোঁ শোঁ ঝিক ঝিক খড় খড় করে ট্রেন এগিয়ে চলছে। অন্যদিকে সীমান্তে পাড়ি দেয়া অরুণের ভাবনায় আবোল-তাবোল অশুভ চিন্তার পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে।
একটাই আকাশ ছিল তাদের মাথার ওপরে। কিন্তু আজ কোন এক অজানা ঝড়ে সেই আকাশটাও যেন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে। একদিকে অরুণের পরিবারের গ্রাম ছেড়ে চলে আসাটা ছিল যেন নদীর জলে ডুবে যাওয়া সূর্যের মতো—এক অন্ধকারের শুরু। আর অন্যদিকে তার বোনের গ্রামে ফেরা ছিল যেন দূরে ভেসে ওঠা এক নরম আলোর রেখা। এ যেন নিয়তির এক এক নিষ্ঠুর পরিহাস। খুব দুঃখজনক মিলন প্রত্যাশার শেষ দৃশ্যটি।
অরুণের কেন জানি মনে হতে লাগলো, তার বোন যেন গ্রামের রাস্তায় ছুটে আসা এক বৃষ্টির ফোঁটার মতো, যাকে এই নদীর স্রোত কোনোদিন ছুঁতে পারবে না। একদিকে বোনের গ্রামে ফেরা ছিল এক হারানো দিনের গন্ধ, আর অন্যদিকে তাদের নৌকার যাত্রা ছিল এক অনিশ্চিত অন্ধকারের দিকে পাড়ি।
অরুণের মনে হলো, এই মুহূর্তটি তাদের ভাগ্যের এক বিশাল শূন্যতা, যেখানে সমস্ত কান্না, যন্ত্রণা, আর স্মৃতিগুলো জমাট বেঁধে আছে।
কিছুক্ষণের জন্য অরুণ অতীতের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। মনে করার চেষ্টা করলো।
মীনাক্ষীর বয়স তখন মাত্র দশ। ছোট্ট একটি মেয়ে, ফ্রক পরে গাঁয়ের মেঠো পথে আনন্দে ঘুরে বেড়াত। তার চোখে ছিল স্বপ্নের জগৎ। বাবা-মা গরিব হলেও তাদের একটাই ইচ্ছে, মেয়ে যেন পড়াশোনা শিখে বড় মানুষ হতে পারে। যুদ্ধের আগে মীনাক্ষীকে পাঠানো হলো চট্টগ্রামে, ছোট কাকার কাছে। যাওয়ার সময় বাবা বলেছিলেন, "ওখানে গিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করবি। কোনো কষ্ট হবে না তোর। পেট পুরে দুবেলা খেতে পারবি। লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারবি। তোর ভবিষ্যৎ তুই নিজেই গড়ে নিতে পারবি।" মা একদিন মীনাক্ষীর মাথার চুল আচড়াতে আচড়াতে ফিসফিস করে বলেছিলেন, "তুই কান্দিসনা, মা। দেহস না আমরা কত অভাইগ্যা। আমাদের দিন চলে না, মা। তুই যা। কাকীর কথা হুনিস। তোর ভালোই হইব। এখানে থাকলে তোর পড়াশোনাডা অইব না। না খইয়া মইরা যাইবি, মা। ওখানে গেলে তোর বাবাডাও একটু শান্তি পাইব।" যেদিন ছোট কাকার সাথে মীনাক্ষী চলে গেল, সেদিন মা রান্নাঘরের এক কোণে মুখে আঁচল চেপে নিথর হয়ে বসে ছিলেন। মীনাক্ষী মায়ের আঁচল ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, "মা, মা, আমি যাইতাছি। আমার দিকে তাকাও।" কিন্তু সেদিন মা যেন পাথরের মূর্তি হয়ে গিয়েছিলেন। মুখ ফুটে একটাও কথা বলতে পারেননি। "আমি যাই বলতে নাই" বলার সাহসটুকুও হয়নি।
মীনাক্ষী প্রথমে অনেক খুশি ছিল। ভেবেছিল, নতুন স্কুল, নতুন বই, আর অনেক নতুন বন্ধু হবে। কিন্তু চট্টগ্রামে পৌঁছানোর পরই তার সব স্বপ্ন যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে লাগলো। ছোট কাকার পরিবারে পৌঁছানোর সাথে সাথে বুঝতে পারলো, এই বাড়িতে তার জায়গা অন্য কোথাও। স্কুলে যাওয়ার বদলে তার জীবন শুরু হলো রান্নাঘরের চারপাশে। ঘর মোছা, বাসন মাজা, রান্না করা—এটাই যেন তার নতুন কাজ হয়ে উঠল। প্রথম কয়েক দিন কাঁদতও খুব। রাতের বেলা যখন সবার ঘুমিয়ে পড়তো, মীনাক্ষী চুপচাপ জানালার পাশে বসে থাকত। জানালার বাইরে আকাশের তারাগুলো যেন তার দিকে তাকিয়ে থাকত, আর সে ভাবতো, "আমার স্কুল কই? আমার বইগুলো কই?" কিন্তু উত্তর পাওয়া যায়নি। রান্নাঘরের ধোঁয়া আর কড়া মশলার গন্ধের ভেতর হারিয়ে গিয়েছিল তার স্বপ্নগুলো।
দিনের পর দিন গড়িয়ে গেল। মীনাক্ষী ছোট কাকার সন্তানদের দেখত স্কুলের ইউনিফর্ম পরে বেরিয়ে যাচ্ছে, আর সে রান্নাঘরে চাল ধুতে বসে যেত বা এটা সেটা করতো। যে বইয়ের কথা ভেবে সে বাড়ি ছেড়েছিল, তা আর ছোঁয়া হলো না তার। কাকার বাড়িতে কেউ তাকে পড়াশুনার জন্য উৎসাহিত করলো না। বরং, তাকে ঘরের কাজকর্মে নিয়েই ব্যস্ত করে রাখল সবাই।
চিঠি লিখতে চেয়েছিল সে। বাবাকে জানাতে চেয়েছিল তার কষ্টের কথা। কিন্তু কাকিমা চোখ বড়ো বড়ো করে বলে দিলেন, “চিঠি লেখার সময় কোথায়? যা, আগে ভাতটা রাঁধ।”
কিছুদিন পর, মীনাক্ষী বুঝে গিয়েছিল তার এই জীবন আর কখনও বদলাবে না। রান্নাঘরই তার নতুন পাঠশালা হয়ে উঠল। হাতের ঘামের সাথে মিশে গেল তার ছোট্ট মনের স্বপ্নগুলো, আর মীনাক্ষী যেন তাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। কাকার ছিলো চার মেয়ে আর তিন ছেলে। তার মধ্যে দুই নম্বর ছেলে আর মেঝো দুইটি মেয়ে ছিলো সবচেয়ে পাঁজি। উঠতে বসতেই মীনাক্ষীকে খাটাতো আর শাসাতও। ষাঁড়ের মতো ধমকাতো। পড়ার কথা বললেই মেঝো ভাইটি মিষ্টি মিষ্টি সুরে তির্যক বুলি ছাড়ত-
দাদা: "ওই, এত বই পইড়া কি হবি রে? ঘরের কাম-কাইজ তো পারিস না, বই নিয়া বসে থাকবি নাকি?"
মীনাক্ষী: "দাদা আমি একটু পড়তে চাই। বই ধরা তো ভুলে গেছি।"
দাদা: "আরে, বই ধরি ধরি করলেই পেট ভরবো? যা, কাম কর। ইচ্ছে হলে রাত্তিরে ঘুমাইতে ঘুমাইতে বই পড়িস।"
আর বোনগুলির মধ্যে দুইটা ছিল খুব সয়তান। মীনাক্ষীকে দেখলেই হলো-
বোন ১: "ওই মিনা, শুনছস? আমার ইউনিফর্মডা ধুইয়া দিবি কইলাম। কাল স্কুলে যাবো।"
মীনাক্ষী: "আমি রান্নাঘরের কাম করতেছি। একটু পরে ধুইয়া দিবো।"
বোন ২: "পরে মানে? এখনি ধুইস। আমাদের স্কুলের কাম আগে, তোর এসব পরে।"
মীনাক্ষী: "তোমরা একটু করতেও তো পারো। সব কাম আমি করি কেন?"
বোন ১: "এখন দেখি জবাব দিতেছিস? যা, বেশি কথা কইস না। ধুইস, নইলে মারে কইয়া দিব।"
মীনাক্ষী: "তোমরা সবাই আমারে এত চাপ দাও কেন? আমি একটু পড়তে চাই।"
দাদা: "আরে! কথায় কথায় জবাব দাস দেখতাছি। পড়তে চাইলে তোর বাবার বাড়িতে যাইয়া পড়। এইডা তোর লাইগা স্কুল না।"
বোন ২: "ওই মাইয়া, আরেকটা কথা কই। পড়াশুনা ছাড়, রান্নাঘরে যা। নাইলে তোরে আমরাই বাইরে ছাইড়ি দিমু কইলাম।"
মীনাক্ষী: "আমারেও একটু শান্তিতে থাকতে দাও। এত চাপ কেন?"
বোন ১: "চাপ লাগতেছে? তোরে খাওয়াইতে চাপ লাগে না মনে করছস? যা, গিয়া ভাত রাঁধ।"-এই বইলাই একটা এসে মীনাক্ষীর চুল ধইরা টানতে টানতে রান্না ঘরে নিয়ে যায়।
এই সমস্ত কষ্টের মাঝেও মীনাক্ষী আশা করত, একদিন অরুণ দাদা এসে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। কখনো কখনো চুপচাপ বসে সে ভাবত, "দাদা কি জানে আমি এখানে কতটা একা? কতটা কষ্টে আছি?" মনের গভীরে এক গভীর শূন্যতা জমে উঠছিল, কিন্তু সেই শূন্যতা পূরণ করার মতো কেউ ছিল না, কেউ কোনো পথ দেখাতে পারছিল না।
অন্যদিকে, গ্রামের বাড়িতে শুভ্রের পরিবারও দুঃখের দিন পার করছিল। বাবা-মায়ের মন ভারাক্রান্ত থাকলেও তারা জানত, মীনাক্ষীর সেখানে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তারাও ভেবেছিল, মেয়েটি ভালো করে পড়াশোনা করবে, জীবনে বড় কিছু হয়ে উঠবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বপ্নগুলো যেন একে একে ভেঙে পড়ছিল।
একটি অন্ধকার সময়ে সবকিছু যেন থেমে গিয়েছিল—মীনাক্ষীর শৈশব, তার শিক্ষা, তার স্বপ্ন, সব। তবু, বুকভরা অভিমান আর অজস্র যন্ত্রণা নিয়ে প্রতিদিন নতুন করে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ত মীনাক্ষী। যেন সেই ধোঁয়ার ভেতর নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
আর বাবা-মা, তারা দূর থেকে শুধু ভাবত, "আমাদের মেয়েটা কি সত্যিই ভালো আছে?"
দিনের পর দিন পেরিয়ে গেল। মীনাক্ষীর ছোট্ট হাতগুলো যেখানে বইয়ের পাতা উল্টানোর কথা ছিল, সেখানে এখন রান্নাঘরের কাজকর্মে ব্যস্ত।
হঠাৎ কাকার ডাকে মীনাক্ষীর ভাবনার জগতে এক অশ্রুতপূর্ব ছেদ পড়লো। “কই রে মা, আমরা চইলা আইছি। এবার নামতে অইব।”
থ্যাক থ্যাক শব্দ তুলে ভাঙা-চোরা, মানুষে গিজগিজ করা বাসটি বরুড়ার পুরান বাজারে এসে থামলো। ট্রেন থেকে নেমেই পাওয়া গেছিল এই বাস। কন্ডাক্টরের কণ্ঠ তখনও বাজার ভরিয়ে তুলছে, “বরুড়া, বরুড়া! তাড়াতাড়ি আইয়েন। এখনই ছাইড়বো। দেরী কইরেন না। আইয়েন, আইয়েন—বরুড়া, বরুড়া…”
কিন্তু বাস থেকে নামতেই মীনাক্ষীর কাকার মন যেন কেমন করে উঠলো। খুব চেনা এই জায়গাটা এবার যেন কতটা অচেনা। বরুড়ার এই পুরোনো বাজারটা সবসময় গমগম করে, অথচ আজ যেন একেবারেই স্তব্ধ। বৈশাখের দুপুর হলেও বাজারটা প্রায় ফাঁকা। মানুষেরা নেই বললেই চলে। এ কি সম্ভব? আজ তো বাজারের দিন, ঠেলাঠেলি করে চলার মতো ভিড় থাকার কথা। অথচ আজ এত শূন্যতা?
মীনাক্ষীর বাঁ হাত শক্ত করে ধরে কাকা ধীরে হাঁটতে লাগলেন। বাজারের রাস্তা দিয়ে কিছুদূর এগোতেই এক ডাক থামিয়ে দিলো। ডানদিকে তাকাতেই বাবলা সিংকে দেখতে পেলেন। বাবলা হাত নেড়ে থামার ইশারা করলো। হনহন করে কাছে এসে বললো, “আরে মনু! তুই এহানে ক্যা? তোদের বাড়ী কেউ নাই। সবাই চইল্যা গেছে ভারতে। তুই খুব দেরী কইরা ফালাইসত।”
কাকার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। গলাটা যেন শুকিয়ে এলো। “কিতা হুনাইলা বাবলা ভাই?” কাকার কণ্ঠে অসহায়তার গভীর সুর।
আর মীনাক্ষী! তার মনে হলো, যেন সারা পৃথিবীটা তার উপর আছড়ে পড়লো। আকাশটা ধপাস করে মাথার উপর ভেঙে পড়লো। পায়ের নিচের মাটি যেন সরে গেল। আর দাঁড়াতে পারলো না। এক লহমায় বসে পড়লো মাটিতে। মুখ থেকে বের হলো এক অস্ফুট আর্তনাদ, যা বাতাসে মিশে গেলো—
“মা-বাবা, তোমরা আমাকে ফালাইয়া গেছ কেন? আমার খুব কষ্ট, মা। আমি আর বাঁচবো না দাদা। তোমরা কেন আমাকে নিয়ে যাও নি…”
মীনাক্ষীকে সেই অবস্থায় দেখে কাকা আর সহ্য করতে পারলেন না। কোনো কথা না বলে মীনাক্ষীকে দু’হাতে তুলে বুকে জড়িয়ে নিলেন। যেন নিজের বুকের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে আশ্রয় দিলেন।
আর দেরি না করে পরের বাস ধরেই তারা রওনা দিলেন। কিন্তু ততক্ষণে অরুণরা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের দিকে পৌঁছে গেছে।
চলবে- পর্ব ৫)
ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট