একদিন অরুণের ফলাফল ঘোষণার দিনটি এলো: চার

Bangla Post Desk
ড. পল্টু দত্ত
প্রকাশিত:১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:১২ পিএম
একদিন অরুণের ফলাফল ঘোষণার দিনটি এলো: চার

সেটি ছিল এক বিস্ময়কর দিন দরিদ্র রাধেশ্যাম পরিবারের সকলের জন্য। অরুণখবরটি পেয়েই উত্তেজনায় দৌড়াতে দৌড়াতে গ্রামের পানের বরজে পৌঁছায়তাঁরবাবা তখন সেখানে কাজ করছিলেনবাবাকে দূর থেকে দেখেই সে আনন্দেচিৎকার করে বলে উঠলো, "বাবা, আমি পাস করেছি!" বাবা তখন ক্লান্ত শরীরেকাজ করছিলেনতার চোখে-মুখে দীর্ঘ পরিশ্রমের চিহ্নদূর থেকে অরুণেরআনন্দিত মুখ দেখে রাধেশ্যাম প্রথমে কিছু বুঝতে পারলেন নাঅরুণ কাঁপা কাঁপাকণ্ঠে আবারো বলল, "বাবা, আমি পাস করেছি।" বলতে বলতে অরুণ বাবারসামনে দাঁড়ালোজোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলকপালে ঘামের চিহ্নচোখে-মুখে এক অন্যরকম উচ্ছ্বাসকিন্তু হঠাকরেই যেন সেই উচ্ছ্বাসটা দমে গেলতারগলা যেন আটকে গেলবাবাকে দেখতে পেল বেশ ক্লান্ত। মাটির উপর ঘামে ভেজাকাপড় পরে কাজ করছিলেনঅরুণ কিছু না বলে বাবার হাতে ধরা কোদালটানামিয়ে রেখে বাবার পায়ের কাছে বসে পড়লোপায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেইরাধেশ্যামের শরীর কেঁপে উঠলঅরুণ বললো, "বাবা, তুমি আর এই কষ্ট করতেহবে না।"

এই কথাটি শুনে রাধেশ্যাম থমকে দাঁড়ালেনকিছু বলতে পারলেন নাচোখেরসামনে ভেসে উঠলো তার সব রাতজাগা পরিশ্রম, ছেলের পড়াশোনার খরচজোগানোর জন্য সংসারের ন্যূনতম চাওয়া পাওয়া ভুলে যাওয়াঅরুণ বাবারপায়ে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়লোরাধেশ্যাম ধীরে ধীরে তার মাথায় হাতরেখে ফিসফিস করে বললেন, "তুই পাস করেছিস, মানে আমিও পাস করেছি।" অরুণ ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েসে কাঁদতে কাঁদতে বললো, "বাবা, আজ তোমার কষ্টের ঋণ শোধ হলোতুমি বলেছিলে, আমি পারবোআমি পেরেছিবাবা!"

রাধেশ্যাম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না চেপে বললেন, "তোর জন্যই আমার এই কষ্ট আজ সফল হলোচল এখন বাড়ী চল।“

সেদিন তার বাবা-মার মুখে ছিল এক অদ্ভুত শান্তিঅরুণ প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্সপাশ করেছেখবরটি শুনে মার চোখে জল এসে যায়দুহাত কপালে ঠেকে দরজারউপরে আটকিয়ে রাখা শ্রী শ্রী রাম-ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রণাম করে। অরুণেরমা ধরেই নিয়েছিল অরুণ পাস করবে নাপরীক্ষার সময় শরীর খুব অসুস্থ ছিলবলে অরুণের মা খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলতাই পাস করার সংবাদটি শুনে বেশআনন্দিতসেদিন যেন এই দরিদ্র পরিবারটির সব দুঃখ-কষ্ট এক নিমেষেই মুছেযায়স্বপ্নের প্রজাপতির পেখমের পত পত আওয়াজে ঘরটি মুখরিত হয়ে উঠলমুহূর্তেইশুভ্র তখনো ঠিক মতো দাঁড়াতে শিখেনি

অরুণদের বাড়িতে সেদিন অন্যরকম একটা পরিবেশমা অনেকদিন পর একটুভালো রান্না করছেনপাতিলে ফুটছে ভাত, আরেক পাশে ডাল আর তরকারিভাতের চালটুকু মায়ের জমিয়ে রাখা সঞ্চয় থেকেএই চালটা তিনি অনেকদিনধরে সংরক্ষণ করছিলেন কোনো বিশেষ দিনের জন্য। কিন্তু আজকের দিনটা তাকেখুব কাছের মনে হলোঅরুণ পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ভর্তি হবে, সেই আনন্দেতিনি ছেলেটার প্রিয় খাবার বানাচ্ছেনকিন্তু তাঁর মনের ভেতর ভারী এক অস্থিরতাযেদিন থেকে অরুণ জানিয়েছে যে সে পলিটেকনিক কোর্স করতে চায়, মা তখন থেকেই চিন্তায় পড়ে গেছেন

"এই খরচটা কিভাবে সামলাব আমরা?"—মনে মনে বারবার এই প্রশ্নটা ঘুরছে তারমাথায়কিন্তু ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে সব কষ্ট ভুলে যান তিনিমা জানেন, অরুণের স্বপ্ন তার কাছে অনেক বড়

রাতে সবাই মাটির চৌকিতে বসে খাচ্ছিলবাবার মুখে সেদিন একরকম সংকল্পদেখা যাচ্ছিল, আর অরুণের চোখে ছিল উজ্জ্বল আশাখাওয়ার ফাঁকে বাবাহঠাবললেন, "অরুণ, তুই বলেছিলি তোর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাস, পলিটেকনিক কোর্স করতে চাসএটা করলে তোর ভবিষ্যকেমন হবেচাকরি-বাকরি জুটবে তো?"

অরুণ চোখে একটা দৃঢ়তা এনে বলল, "বাবা, পলিটেকনিক কোর্স করলে আমার জীবনে উন্নতির সুযোগ আসবেএকটা ভালো চাকরি পেতে পারবআরতাড়াতাড়িও চাকরি পাওয়া যায়তোমাকেও এই কষ্টের জীবন থেকে বেড় করে আনতে চাই, পরিবারকে একটা ভালো জীবন দিতে চাইকিন্তু পলিটেকনিকেপড়াশুনায় খরচ কিছুটা বেশি।"

বাবা একটু খানি থেমে তার পাটভাঙা শার্টের বোতামগুলো খুলতে খুলতেবললেন, "আমাদের তো তেমন টাকা নেই, জানিসএকখণ্ড জমিটুকুই সবযারোজগার করি তাতেই যে সংসার চলে নাকিন্তু পড়াশোনা যে জীবন বদলে দিতেপারে, তাও জানি। তুই পড়াশোনা করলে আমার জীবন আর তোর জীবনের মধ্যেএকটা পার্থক্য থাকবেকিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি ন। কিভাবে এতো টকা-পয়সাযোগার করবো।"

মা পাশ থেকে অসহায় বাবার কথাগুলো শুনছিলেন আর পাণ্ডুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেনভাবতে লাগলেন,কীভাবে হবে? যে জমিটুকু আছে, সেটাই তাদের বাঁচারশেষ অবলম্বনএই জমিটুকু বিক্রি করলে যে বেঁচে থাকার আর কোন উপায়ইথাকবে নাসবাইকে নিয়ে যে পথে বসতে হবে। এ সব ভাবতে ভাবতে অরুণেরমায়ের মাথা যেন গুমোট হয়ে আসেচিন চিন ব্যথা অনুভব করে।

কিন্তু পরক্ষনেই তার ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সব চিন্তাই যেন ম্লান হয়ে যায়মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদুস্বরে বললেন, "জমিটুকু বিক্রি করে দাওওরভবিষ্যতটাই তো সবচেয়ে বড়।"

বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেললেনতিনি জানতেন, এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত, কিন্তু সেই জমিরসঙ্গে তার পিতৃপুরুষের স্মৃতি জড়িয়েতবু, অরুণের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মনেদৃঢ়তা আনলেন। "আগামীকাল জমি বিক্রির ব্যবস্থা করব," কথাটা এমনভাবেবললেন, যেন নিজের মনকে প্রস্তুত করছেন

অরুণ চুপচাপ শুনছিল, চোখে জল এসে গেলবাবা-মা এত বড় ত্যাগ করতেযাচ্ছেন তার জন্য। মনের ভেতর থেকে একটা কষ্টের অনুভূতি আসলেও, সেইকষ্টের আড়ালে লুকানো ছিল অদম্য ভালোবাসা আর স্বপ্ন

মা তখনও ভাবছেন, কেমন হবে অরুণের ভবিষ্যৎ? যুদ্ধের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে দূরথেকে, কিন্তু ছেলেটার মুখে এক আলোকিত স্বপ্নের আভামনে মনে ভাবতেথাকেন-“শেষ পর্যন্ত সামাল দিতে পারবে তো”?

পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে অরুণতবে ভর্তি ফিএবং বইপত্রের জন্য টাকা কোথায়? অরুণের বাবা, একজন দরিদ্র কৃষক, জানতেনশিক্ষা জীবনের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকিন্তু সামান্য জমিটুকু ছাড়া আর কিছুইছিল না তাদেরজমিটা ছিল পূর্বপুরুষদের একমাত্র অবশিষ্ট ধনতবু, সন্তানেরভবিষ্যতের জন্য তিনি দ্বিধা করলেন নাভবিষ্যতের কথা ভাবলেন নাযেসংসারের সকলেই থাকে অনাহারে-অর্ধাহারে, সপ্তাহে যেখানে একদিনও ভালো করে পুরো পেট ভরে ভাত খেতে পারে না সেই সংসারের অধিকর্তা সিদ্ধান্ত নিলেননিজের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দিবেনছেলের ভবিষ্যতের জন্য এইটুকু করা ছাড়া যে দরিদ্র রাধেশ্যামের কোন উপায় নেই

তাই এক সকালে, বাবা সেই জমিটুকু বিক্রি করে দিলেনসেই জমি, যেটা প্রজন্মেরপর প্রজন্ম ধরে তাদের কাছে ছিলএই জমিটুকুর উপরই সংসারের অনেকটাইনির্ভর ছিলমা, চুপ করে বসে ছিলেন এক কোণে, চোখের জল মুছছিলেনআড়ালেঅরুণ বোঝে, এই ত্যাগ তার জন্য কত বড়কিন্তু বাবার চোখে ছিল দৃঢ়সংকল্প। "জমি ফিরিয়ে পাওয়া যাবে, কিন্তু শিক্ষা না থাকলে, কিছুই থাকবে না," বাবা বলেছিলেন

অরুণ ভর্তি হলো পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে

এটাই ছিল তার স্বপ্ন-পূরণের প্রথম ধাপতবে শহরে এসে পড়াশোনা করা যে এতকঠিন হবে, তা সে আগে বুঝতে পারেনিএকেবারে নগণ্য টাকা নিয়ে শহরে পারেখেছিল সেবাবা জমির শেষ টুকরো বিক্রি করে যে সামান্য টাকা দিয়েছিলেন, সেটা দিয়ে প্রথম কয়েক মাসের খরচ সামাল দেওয়া গেলকিন্তু তারপর?

অরুণের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল শহরের এক কোণায়, ছোট্ট একটা বাড়ির এক ঘরেসেখানে সে থাকত আরও চারজন বন্ধু সহপাঠীর সঙ্গে। ঘরটা খুবই ছোট, চারপাশে দেয়ালের প্লাস্টার উঠে গিয়েছিলসবসময় একটা স্যাঁতসেঁতে ভাব, জানালার ফাঁক দিয়ে বাতাস ঢুকত খুব কিপটে করে। পাশেই জানালার গা ঘেঁষেএকটা বাড়ীজানাল দিয়ে আকাশ যেতো নাঘরটাও খুব ছোটঘরে একটা মাত্রখাটঅরুণ আর এক সহপাঠী খাটেই আর বাকি সবাই মেঝেতেই চাটাই পেতেশুততারা সবাই গ্রামের ছেলে, প্রত্যেকেই অরুণের মতোই অর্থকষ্টে ভুগছিলতবেঅল্প সময়ের মধ্যেই সবার মধ্যে একটা ভাব জমে যায়তাদের দেখলে মনে হতো, কষ্টের মুহূর্তেই বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়

খাবারের জন্য সবাই মিলে প্রতিদিন একটু একটু করে টাকা জমাতপালা করে রান্নার দায়িত্ব নেওয়া হতএকদিন অরুণ, পরের দিন কেউ অন্যজন। অনেক সময় ডাল আর ভাতেই দিন কেটে যেত, কখনও তেলের অভাবে তরকারিতে শুধুইলবণ আর হলুদ দিয়ে রান্না হত। তবুও তারা খুশি ছিলএই ছোট ছোট ত্যাগগুলোযেন ভালোবাসার এক মধুর অভিজ্ঞতা, যা তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন পূরণের পথকেমসৃণ করছিলতারা জানত, এটাই তাদের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড়বিনিয়োগ

তবে সকলের মধ্যে অরুণের পরিস্থিতি ছিল বেশ নাজুকপকেটে এত কম টাকাথাকত যে, প্রতিদিনের খরচের জন্য তাকে প্রতিটি মুহূর্তে হিসাব কষতে হতসামান্যবেশি খরচ করার সুযোগই ছিল নাএকটি মাত্র ট্রাউজার আর একটি শার্টে দিনচলছিল তারপায়ে থাকা স্যান্ডেলটিতেও ছিল অনেকগুলো সেলাইঠিক তখনইঅরুণ একটি টিউশনি খুঁজে পেলশহরের এক ধনী ব্যবসায়ীর ছোট মেয়েকেপড়ানোর কাজ শুরু করল সে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেই বাড়িতে গিয়ে পড়াতমেয়েটির পড়া শেষ হলে, অরুণকে সেখানে খাবার খেতে দেওয়া হতসেই খাবারইছিল তার কাছে এক বড় সঞ্চয়, কারণ এতে করে তার রাতের খাবারের খরচ বেঁচে যেত

বাড়ি থেকে বহু দূরে, এই অচেনা শহরে, অরুণের দিনগুলো কাটছিল এক গভীরকষ্ট আর নিরন্তর সংগ্রামের মধ্যে। প্রতিটি দিন যেন নতুন একটি চ্যালেঞ্জসকালেক্লাস, তারপর ছুটে যাওয়া টিউশনি করতে, আর রাতে ফিরে ক্লান্ত শরীরে বন্ধুরামিলে সামান্য খাবার রান্নার চেষ্টাবিদ্যুকখনও থাকত, কখনও থাকত নালোডশেডিং যেন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনাএমন সময়ে মোমবাতির মলিন আলোইছিল তার পড়াশোনার একমাত্র ভরসাটিউশনির সামান্য আয়ে নিজের প্রয়োজনমেটানো ছিল এক অসম্ভব সাধনাপ্রয়োজনীয় বইপত্র কেনার আগে তাকেবারবার ভাবতে হতকোনটা বেশি জরুরি। অনেক সময় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রকেনার ইচ্ছেটাকেই ত্যাগ করতে হতসেই অল্প টাকায় কখনও মেসের জন্য চাল, ডাল কিনে আনত, আবার কখনও নিজের জন্য একটি পুরনো বইতার মনেওএকটি চাপা যন্ত্রণা ছিলএই শহরে কারও কাছে সে যেন আপন কেউ নয়। এক নিঃসঙ্গ, অথচ লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা এক পথিককষ্টেরমধ্যেও অরুণ জানত, এই সংগ্রাম তার ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু প্রতিটি দিন শেষহলে মনে হত, এ লড়াইয়ের শেষ কোথায়? অন্ধকার ঘরে মোমের আলোতে নিজের ক্লান্ত মুখটা দেখে মাঝেমধ্যে চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ত। তবুও সেথেমে থাকেনি, কারণ তার কাছে প্রতিটি সংগ্রামের অর্থ ছিল তার স্বপ্ন-পূরণের এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া

পলিটেকনিকের কঠিন কোর্সগুলোতে অরুণ প্রতিদিন নতুন কিছু শিখত, কিন্তু সেইসঙ্গে প্রতিদিন নতুন এক দুশ্চিন্তা এসে দাঁড়াত তার সামনেআগামীকাল কীভাবেখরচ চলবে? এতকিছুর মাঝেও অরুণ হাল ছাড়েনিবন্ধুরা মাঝে মাঝে হালকারসিকতা করত, "অরুণ, তুই তো ধনী লোকের বাড়ি টিউশনি করিস, তোর তোবড়লোকি অভ্যাস হয়ে যাবে!"

অরুণ হাসত, কিন্তু তার চোখে এক অদম্য ইচ্ছার ঝলক ছিলসে জানত, এইকষ্টের দিনগুলো অস্থায়ীতার সামনে যে ভবিষ্যৎ, সেটা তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে, এই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই

কঠোর পরিশ্রমে শুরু হলো তার নতুন জীবনতবে এক বছরের মধ্যেই সবকিছুপাল্টে যেতে লাগল। ১৯৭১ সাল, যুদ্ধের আগমনী বার্তা যেন বাতাসে ভাসছিলদেশ স্বাধীনতার জন্য জেগে উঠছেহঠাকরেই একদিন অরুণের পড়াশোনাথেমে গেলদেশ যেন অশান্ত হয়ে উঠলোচারিদিকে শুধু হট্টগোলফিস ফিস, ফাঁস ফাঁস চাপা কণ্ঠের আওয়াজ চারিপাশেসবাই আস্তে আস্তে শহর ছেড়ে গ্রামেছুটছেশহর অঞ্চলে এরই মাঝে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলশুরু হলো এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়

শহরের চারপাশে তখন এক অদ্ভুত আতঙ্ক ঘিরে ধরেছেদিন দিন উত্তেজনাবাড়ছে, মানুষের মুখে শুধু স্বাধীনতার কথাপলিটেকনিকের ছাত্ররা ক্লাসের বাইরেবসে মুক্তিযুদ্ধের আলোচনা করত, সবার চোখে যেন একরকম তেজ ছিলঅরুণওপ্রতিদিন শুনত তাদের কথাকারও ভাই যোগ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, কারও বাবা গ্রামেলড়ছে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধেকিন্তু অরুণের মন পড়ে থাকত তার পরিবারেরদিকেতাদের কি হবে? তার ছোট বোন, যে তখন চট্টগ্রামের কাকার বাড়িতেআছে। তার কি হবে?

অরুণের বন্ধুদের সঙ্গে সেই ছোট্ট বাড়িতে পড়াশোনার দিনগুলো যেন হঠাৎই খুবদূরের মনে হতে লাগলরাতের অন্ধকারে সবার ঘুম ভাঙত গুলির আওয়াজেবাতাস ভারী হয়ে উঠছিল ভয়ের গন্ধেঅরুণ অনেকবার ভেবেছিল, "বোনকেফিরিয়ে আনব কবে?" কিন্তু চট্টগ্রামে যাওয়া সেই সময় অসম্ভব ছিলপাকবাহিনীরঅবরোধে সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে

এক সন্ধ্যায় তারা সবাই মিলে যখন রান্না করছিল, তখন একজন বন্ধু হঠাবলল, "এইভাবে আর কতদিন? শহরটা নিরাপদ নয়আমাদের গ্রামে ফিরে যেতে হবে।"

অরুণের ভেতরেও সেই একই চিন্তা ঘুরছিলসে তার মা-বাবার মুখ ভেবে চিন্তায়পড়ে গেলবাড়ি ফিরে গেলে নিরাপত্তা থাকবে কি না, তাও জানে না, কিন্তু শহরেথাকা মানে মৃত্যুর ঝুঁকি। প্রতিটি দিন যেন ঘন কালো মেঘের মতো, অজানা ভয়েঢেকে যাচ্ছে

অবশেষে একদিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলোযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বাঁচার একমাত্রউপায়, বাড়ি ফেরাঅরুণ আর তার বন্ধুরা রাতের আঁধারে বাড়ির পথ ধরলযান বাহন যেন থুবড়ে পড়েছেআতংকে সব কিছুই বন্ধশহরে কোন বাস কিংবা বেবি ট্যাক্সি নাই বললেই চলেঅলিতে গলিতে ফাঁকা রিক্সাগুলি টুংটাং আওয়াজতুলে সাঁ সাঁ করে ছুটে চলছেকেউ কেউ দুএক জন প্যাসেঞ্জার তুলে নিয়েছেনদুইএকটা মালবাহী গরর গাড়ী অতি সন্তর্পণে এগিয়ে চলছেরাস্তা ঘাটে তেমনব্যস্ততা নেইযেন চারিদিকে এক নিস্তব্ধ শোকের ছায়াথম থমে ভাব চারিদিক

অগত্যা হেঁটেই রওনা দিলোগ্রামে যেতে প্রায় পনের-ষোল মাইল হাঁটতে হবে

ক্লান্তি, ক্ষুধা আর ভয়ের মাঝেও তারা চলতে থাকলঅরুণের মনে শুধু একটাইপ্রশ্ন—বোনকে কীভাবে ফিরিয়ে আনবে? চট্টগ্রামের রাস্তাগুলো অবরুদ্ধ, সেখানেপৌঁছানো প্রায় অসম্ভব

গ্রামে ফিরে এসে অরুণ দেখল, তার বাবা-মা ইতোমধ্যে প্রায় সবকিছু গুছিয়েরেখেছেতারা জানত, এই যুদ্ধ থেকে বাঁচতে হলে দেশ ছেড়ে পালানোই একমাত্রপথকিন্তু মেয়েটাকে ফেলে কীভাবে যাবে? মা’র চোখে জল, বাবা চুপচাপ বসে ছিলেন, যেন কোনও গভীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। "তাকে নিয়ে আসার চেষ্টাকরব," বাবা বলেছিলেন, কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে উঠেছিল যে তা আরসম্ভব হলো না

অরুণ বুঝতে পারলো দেশ আজ আক্রান্ততার চারপাশের অন্যায়, অত্যাচারদেখে চমকে উঠে মাঝে মাঝেখুব অস্থির মন।। স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে মনচাইলবন্ধুরা একে একে মুক্তিযোদ্ধাদের দলে যোগ দিচ্ছেঅরুণও চেয়েছিলযেতে, দেশের জন্য কিছু করতেকিন্তু মা-বাবা তাকে বাধা দিলেনতারা জানতেন, ছেলে যুদ্ধে গেলে বেঁচে ফিরে আসার নিশ্চয়তা নেই

"আমরা তোকে হারাতে পারব না," মা কান্নাভরা কণ্ঠে বললেনবাবা চুপচাপতাকিয়ে থাকলেন, যেন ভেতরে ভেতরে ছেলেকে যেতে দিতে চান, কিন্তু বাবা হিসেবেতিনি আটকিয়ে ছিলেন

এক গভীর রাতে, সারা গ্রাম নিস্তব্ধকেবল দূরের আকাশে ভেসে আসা গুলিরশব্দ শোনা যাচ্ছিল, যেন যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা তাদের নিঃশ্বাসের মধ্যে মিশে যাচ্ছেঅরুণের মা বললেন, "আর এক মুহূর্ত দেরি করলে আমাদের কেউই বাঁচব না।" সেই কথাগুলো যেন এক অশ্রুত শপথের মতো তাদের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিতহলসেদিন রাতে তাদের বাড়ির সব আলো নিভে গেলঅন্ধকারে, চুপিসারে, তাঁরা দেশ ছেড়ে পালানোর প্রস্তুতি নিলেন

অরুণের মনে অস্থিরতাবোনকে ফেলে যাওয়ার চিন্তা তার হৃদয়কে যেন টুকরোটুকরো করে দিচ্ছিলতার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল শৈশবের দিনগুলোযখন বোনের হাসি ছিল তার সমস্ত ক্লান্তি দূর করার অব্যর্থ ওষুধকিন্তু যুদ্ধেরকঠোর বাস্তবতা আর বেঁচে থাকার তাগিদ তাদের জন্য আর অন্য কোনো পথ ছিলনাভোরের আলোর এক ফোঁটা আভা এখনও আকাশে দেখা যায়নিতারানীরবে নদীর ঘাটে এসে পৌঁছায়অরুণ একবার পেছনে তাকালতার শৈশবেরপরিচিত বাড়ি, খেলার মাঠ, আর সেই প্রিয় বোনকিন্তু আজ সেই চেনা দৃশ্যগুলোতার জন্য শুধুই এক দুঃসহ স্মৃতির ভারদেশ ছেড়ে যাওয়া মানে শুধু মাটি, জমিবা বাড়ি ত্যাগ করা নয়, বরং ত্যাগ করা তাদের হাসি, কান্না, ভালোবাসা আরজীবনযাপনের এক অনন্য অধ্যায়

মুক্তিযুদ্ধের ধ্বনি তখন গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিটি শ্বাস যেন ভয়ে, প্রত্যাশায় এবং বেদনার সাথে মিশে আছে। অরুণের চোখে জল। বাবার পিছু নীলসে, কিন্তু তার মনে হাজারো প্রশ্ন। "স্বাধীনতা কি সত্যিই আমার এই শূন্যতা পূরণকরতে পারবে?" দেশ একদিন মুক্ত হবে, কিন্তু তার জীবনের সবচেয়ে সোনালিসময়, তার ছোটবেলার খেলা, তার শিক্ষার স্বপ্ন আর প্রিয় বোনের সঙ্গ, সবকিছুসময়ের অন্ধকারে মিশে গেল

নদীর বুকে নৌকা ভেসে চলল, আর অরুণ অনুভব করল যে শুধু তাদের শরীরনয়, তাদের আত্মাও যেন এই মাটিকে আঁকড়ে ধরে আছে। স্বাধীনতার মশালহয়তো একদিন জ্বলবে, কিন্তু সেই মশালের আলোতে তার ব্যক্তিগত স্মৃতিরঅন্ধকার দূর হবে কি?

হঠামাঝির বৈঠার টানায় জলের ছলছল শব্দ ভেদ করে অরুণের কানে এক গভীর শূন্যতার মতো আছড়ে পড়লো এক হৃদয়বিদারক আওয়াজনৌকার এক কোণে নীরব মূর্তির মতো বসে থাকা তার মা, যিনি এতক্ষণ একদম চুপ ছিলেন, হঠাৎই ডুকরে কেঁদে উঠলেনমনে হচ্ছিল, যেন হৃদয়ের সমস্ত ব্যথা একত্রেপ্রকাশিত হলো সেই কান্নায়অরুণ অবাক হয়ে চুপচাপ শুনতে লাগলোনৌকারপরিবেশের নিস্তব্ধতা যেন তার মায়ের কান্নার তীব্রতায় কাঁপতে শুরু করলনৌকারদুলুনি আর জলের মৃদু শব্দের মাঝে এই কান্না যেন এক গভীর বেদনার প্রতিধ্বনিহয়ে উঠল

 

চলবে—পর্ব ৪

ড. পল্টু দত্ত

শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট