শ্রীচরণেষু দাদা: এক
কাঁধে একটি মলিন ব্যাগ। ডান হাতে ঝুলে আছে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটি কম্বল। এটাই যেন অরুণের জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার শেষ অবলম্বন।
রাতের শেষ প্রহর। গ্রামটি তখনও ঘুমে আচ্ছন্ন। আগে ভাগেই সকালের রোদ ওঠার আগেই অরুণ গ্রাম ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। কম্বলটি বিক্রি করে ঢাকায় রওনা দিবে। তার দ্রুত পদক্ষেপে যেন কোনো ক্লান্তি নেই, কিন্তু তার মন যেন ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। তার চোখে ঝাপসা, কন্ঠে দুঃখের ভার, তবুও অরুণের পা থামছে না। বুকের ভিতর ক্রমশ জমে উঠছে কান্না, কিন্তু সেই কান্নার শব্দ এখনো কেউ শুনতে পাচ্ছে না।
সে দৌড়াচ্ছে। পেছনে ফিরে তাকানোর যেন ফুরসৎ নেই। লোকজন ঘুম থেকে উঠার আগেই গ্রাম ছাড়তে হবে। চলে যাবে শহরে। আর ফিরে আসবে না। এতো বড় অপমান তার পক্ষে হজম করা অসম্ভব। বলে কিনা-“বের হইয়া যা এই বাড়ী থেইক্যা।“
অল্প বয়সের গরম রক্ত হঠাৎ করেই টগবগ করে জ্বলে উঠেছিলো অরুণের। হবেইতো!
জীবনের সঙ্কটময় মুহূর্তে, যখন মানুষ ঘোর দুঃখ ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, তখন তার রক্ত যেন এক অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়। প্রতিটি সেকেন্ড যেন হয়ে উঠে একটি অনিশ্চিত যুদ্ধের ঘন্টাধ্বনি। উদ্বেগের চিহ্ন যেন ফুটে ওঠে চোখে-মুখে। এমনটিই হয়েছিল অরুণের। হৃদপিণ্ডের গভীরে তীব্র উত্তেজনার দোলা পেন্ডুলামের মতো যেন হঠাৎ ডানে বায়ে ঘুরতে লাগলো। তাই দরিদ্র বাবার উত্তেজিত কথাগুলি অরুনের ভালো লাগেনি। এই যেন তারুন্যের চরম অবমাননা। অগ্নমূর্তি হয়ে উঠেছিলো অরুণ। রক্তের ধমনীর স্রোত যেন বেগবান হয়ে ওঠেছিল। প্রতিটি ধক্ ধক্ যেন সাঁড়াষির মতো কানে এসে বাজছিল। হঠাৎ দূরে নির্জন বটগাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় মায়ের মুখটা চোখে পড়তেই, যেন বুকের ভেতর থেকে সমস্ত গরম হাওয়া বেরিয়ে যায় এক নিমিষে। চোখের ভাষা আর মায়ের হাতজোড়ার কাতর অনুরোধে অরুণের বুকের ভেতর যেন এক ভারী কষ্টের পাথর বসে গেল। অসহায়ত্বের এক নিঃশব্দ বোঝা তাকে নুইয়ে দিল হুট করে। বুকটা প্রথমে চুপসে গেলেও, ধীরে ধীরে নিজের ভেতরে সাহসের এক অদ্ভুত শক্তি অনুভব করলো সে। যেন কোন এক অদৃশ্য হাত তাকে দৃঢ়তার সঙ্গে মাটিতে গেঁথে দিল, ঝড়ে নত না হওয়া এক মহীরুহের মতো। মনে হতে লাগল হঠাৎ যেন সময় থেমে গেছে। বিশ্ব এক অন্ধকারে ঢেকে গেছে।
মাথা নীচু করে দ্রুত বেগে সেখান থেকে বেড়িয়ে যায়। প্রতিজ্ঞা করে, কিছু একটা করতেই হবে।
বাঁশ ঝাড়ের ভেতর দিয়ে আর ঘন গাছপালার প্রাচীর ভেদ করে সরু কাঁচা রাস্তা ধরে যখন শেখ বাড়ির পুকুরের কাছে এসে পৌঁছায়, তখন পুকুরের এক কোণে ছাতার মতো ছড়িয়ে থাকা কদম গাছের পাতায় টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল। সমস্ত গ্রামটা যেন নিজের মায়াবী সুরে মগ্ন ছিল। বৃষ্টির ছন্দে যেন মিশে ছিল বাঁশির এক অপূর্ব অজানা সুর। পুকুরের পাশে অর্ধশতাব্দী পুরনো স্কুল, যেখানে অরুণ তার শৈশবের দিনগুলো কাটিয়েছে। কিন্তু আজ, চারপাশের সেই চেনা দৃশ্যগুলো দেখার মতো সময় তার নেই—পুকুর, স্কুল, গাছপালা, কিছুই তার নজরে পড়ে না। তার মন এখন উদ্বেগে আচ্ছন্ন।
বর্ষার দিন। কাল সারারাত ঝপ ঝপ করে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছিল। কাঁচা রাস্তা কাদায় থক থক করছে। ভোর থেকেই গুড়ী গুড়ী বৃষ্টি হচ্ছিল। আকাশ যেন এক অশ্রুসিক্ত চাদর মেলে ধরেছে। অরুণ ধীর পায়ে পুকুরের পাশের মাটির রাস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি কনা মাথার উপড়ে পড়ে ধীরে ধীরে কপাল বেয়ে গালের উপরে এসে পড়ছে। কিন্তু সেদিকে অরুনের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সামনে এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে মাত্র কয়েক বছর, কিন্তু দেশ জুড়ে এখনো অস্থিরতা। গ্রামে খাদ্য সংকট, বাড়িতে অভাবের কষ্ট। আর অরুণ? সে জানে, আজ তাকে এই গ্রাম ছেড়ে যেতেই হবে।
অরুণের চোখে-মুখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। পেছনে তার কাঁচা বাড়ি, যেখানে তার মা, বাবা,ছোট ভাই-বোনেরা হয়তো এখনো ঘুমিয়ে আছে। সেই ছোট্ট বাড়িটা, যেখানে প্রতিদিন অভাবের দহন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত। আজকের এই সকালের মতো শীতল আর দুঃখভারাক্রান্ত দিন তার জীবনে আর আসেনি। আজ সে জানে, তাকে নতুন এক জীবন শুরু করতে হবে। হাঁফাতে হাঁফাতে এক সময় গ্রামের বাজারে এসে পোঁছালো।
অরুণ দৌড়াচ্ছে, দম ফেলার ফুরসত নেই। "দৌড়াও, অরুণ, দৌড়াও!" তার মনের ভিতর থেকে কেউ যেন চিৎকার করছে।
সকালের প্রথম বাসটা স্টেশনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আবার ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে। অরুণ জানে, এই বাসটা ধরতেই হবে। তা না হলে ঢাকার ট্রেনটা ঠিক সময়ে ধরতে পারবে না। পেছনে পড়ে থাকা গ্রামের সব দুঃখ, কষ্ট, অভাব—সব কিছু ভুলে যাওয়ার একমাত্র উপায় এই বাস। এই বাসে করেই পাড়ি জমাবে সেই অজানা শহরে, যেখানে শুরু হবে তার নতুন জীবনের।
সে বাসটাকে ধরার জন্য দৌড়াচ্ছে।
তখন হঠাৎ যেন তার মনের গভীর থেকে কেমন এক অদ্ভুত আওয়াজ শোনা গেল—“দৌড়াও, অরুণ, দৌড়াও! থেমো না! সামনে যাও! ছুটে যাও! এই গ্রামের কষ্টের হাত থেকে মুক্তি পাও!”
সে চমকে উঠে চারপাশে তাকাল। আশে পাশে তখন কেউ নেই। কিন্তু সেই আওয়াজ যেন তার মনের ভেতর গুঞ্জন করতে লাগল। সেই অদ্ভুত কণ্ঠস্বর, যেন কোনো অজানা শক্তি তাকে তাড়া করছে, তাকে শহরের দিকে নিয়ে যেতে চায়।
“তুমি পারবে, অরুণ,” সেই কণ্ঠস্বর আবারও শোনা গেল। “এই গ্রাম তোমার জন্য নয়। এখানে শুধু দুঃখ, কষ্ট আর অভাব। ঢাকায় যাও, সেখানেই তোমার নতুন জীবনের শুরু।”
অরুণ দৌড়াতে শুরু করল। বুকের ভেতর ধকধক করছে, পায়ের তলায় যেন জমাট বাঁধা কাদা তার চলার পথ আটকে রাখতে চাইছে। কিন্তু সে থামে না। তার মনের ভেতর সেই কণ্ঠস্বর আরও জোরে চিৎকার করতে থাকে—“দৌড়াও! সামনে এগিয়ে যাও! পেছনে কিছু নেই, শুধু এগিয়ে যাও!”
বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তার মুখের উপর পড়তে লাগল, যেন প্রকৃতিরও কান্না শুরু হয়েছে। আজ তাকে যেতে হবে, সে এই গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে।
চলতি বাসেই উঠে পড়লো। ভেতরে গিয়েই খালি সীটটি যেন তার হাতের মুঠোয় ধরা জীবনে একান্ত আশ্রয় হয়ে উঠল। বাসটি যখন থ্যাক থ্যাক শব্দ তুলে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে, চারপাশের সবুজ গাছপালা যেন এক বেগে পিছনে সরে যাচ্ছে। রাস্তার অবস্থা শোচনীয়। গর্তে ভরা পথ। কিন্তু সেই কষ্টের পথে বাসের ড্রাইভার দক্ষ হাতে গাড়ি চালিয়ে চলেছে, যেন জীবন পথে কতশত বাধা পেরিয়ে যাওয়ার মতো। বাসের টেপ রেকর্ডারে বেজে চলেছে দেশের গান-“তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগড় পাড়ি দেব রে। আমরা কজন নবীন মাঝি..”। অরুণের জীবন যেন সেই গানের মতোই, দিশেহারা ঢেউয়ের মাঝে হারিয়ে যাওয়া এক নবীন মাঝি, যে কোনোভাবে এই সাগর পাড়ি দিতে চায়।
অরুণের চোখ চলে গেছে দূরের মাঠ পেরিয়ে আরও দূর। আকাশের সীমানায় আটকে আছে যেন তার মনের কোনো গভীর ভাবনা। মাথায় যেন এক অদৃশ্য কষ্টের মাছি ভন ভন করছে, নানা স্মৃতি, নানা বেদনা তার মনে গেঁথে আছে।
এইসব ভাবনায় ডুবে থাকতে থাকতে, বাস এসে থামে কুমিল্লার টমছম ব্রিজের কোলাহলমুখর বাস স্টেশনে। বৃষ্টি থেমে গেছে সে অনেকক্ষন। চারপাশে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। মাটির রাস্তাগুলো কাদামাটি জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। তবে সকালের সোনালি রোদ সবকিছুতে একটা উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে দিয়েছে।
স্টেশনের পাশে ছোট ছোট দোকানপাট। চায়ের কেটলি থেকে ধোঁয়া উঠছে। দোকানের সামনে কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে। কেউবা এক কাপ চা হাতে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, কেউবা কথা বলছে। স্টেশনের এক কোনায় কিছু রিকশাওয়ালা অপেক্ষায়। বৃষ্টির পরের ভেজা রাস্তায় তাদের রিকশাগুলো একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে পাখির কিচিরমিচির। পত পত করে ডানা মেলে একদল পাখি আকাশে আনন্দ মেলায় যোগ দিয়েছে।
কম্বলটা এবার বিক্রি করতে হবে। তারপর রেলস্টেশনের দিকে ছুটতে হবে। পকেট একেবারে ফাঁকা, একটা টাকাও নেই। এদিক-সেদিক তাকাতে লাগল, কী করবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ বাম পাশে একটু দূরে একটা লেপ-তোষকের দোকান নজরে পড়ল। দ্রুত সেই দিকে ছুটে চলল।
অরুণ: (দোকানে ঢুকে) ভাই, এই কম্বলটা বিক্রি করতে চাই। কত দিবেন?
দোকানদার: (কম্বলটা হাতে নিয়ে) হুম, পুরনো দেখাচ্ছে। তবে ভালোই আছে। চুরির মাল নাকি? ৫০ টাকা দিতে পারব।
অরুণ: (কিছুটা হতাশ গলায়) না ভাই, আমাদের কম্বল। একটু বেশি দিন না? খুব ভালো কম্বল এটা।
দোকানদার: দেখুন, বেশি দিতে পারব না। ৫০ টাকা, নিলে নিন।
অরুণ: (অবশেষে রাজি হয়ে) আচ্ছা, দিন। ৫০ টাকাই দিন।
দোকানদার: (টাকা গুনে অরুণের হাতে দেয়) এই নিন।-দোকানদার পাঁচটি দশ টাকার নোট এগিয়ে দিলো।
অরুণ: (টাকা নিয়ে) ধন্যবাদ ভাই।
দোকান থেকে বেড়িয়েই অরুণ সোজা একটি রিকশায় চেপে বসল। গন্তব্য ট্রেন স্টেশন। জীবন যেন সেই ট্রেনের মতোই। চলতে চলতে, থামতে থামতে, কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে।
স্টেশনে পৌঁছে সে দেখল, ট্রেনটি ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাচ্ছে। তার শ্বাসপ্রশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে জানে, এই ট্রেন তাকে তার মুক্তির পথে নিয়ে যাবে। সে ছুটে গেল। হাঁফাতে হাঁফাতে ট্রেনের দরজায় পৌঁছে, অরুণ কোনোমতে হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল একটি হ্যান্ডেল। শরীরের সব শক্তি দিয়ে সে নিজেকে ট্রেনের ভেতরে টেনে নিয়ে গেল। “এগিয়ে যাও, অরুণ!” কণ্ঠস্বর আবারও শোনা গেল, “তোমার অপেক্ষায় আছে এক নতুন সকাল। ঢাকায় গিয়ে তুমি নতুন জীবন শুরু করবে। তোমার পরিবারের জন্য, তোমার জন্য। পেছনে ফিরে তাকিও না, সামনে যাও!”
অরুণ তখন ট্রেনে উঠেছে, সে জানে পেছনে ফেলে এসেছে তার গ্রাম, তার পুরনো জীবন। ট্রেনটি ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে, আর অরুণের চোখের সামনে ভেসে উঠছে ঢাকার অজানা দৃশ্যপট। কুয়াশাচ্ছন্ন গ্রামের সেই কাঁচা বাড়ি থেকে শুরু করে শহরের উজ্জ্বল আলোর দিকে যাত্রা শুরু হলো তার।
হঠাৎ দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা কন্ডাক্টর ক্ষিপ্তভাবে তার দিকে তাকিয়ে বলল, "টিকিট কই?"
অরুণ চুপ। তার পকেটে টিকিট কেনার মতো বাড়তি পয়সা নেই। কেবল মাত্র ১০ টাকার পাঁচটি নোট। জীবনের সব সঞ্চয় এই নোটগুলিতে গচ্ছিত আছে। সে জানে, এই পয়সা দিয়েই তাকে ঢাকায় পৌঁছে নতুন কোনো সুযোগ খুঁজতে হবে। এটাকা এখন খরচ করা যাবে না।
অরুণ কন্ডাক্টরের দিকে তাকিয়ে বললো “টিকিট নাই।“
কিন্তু কন্ডাক্টর তাতে খুশি নয়। সে অরুণের হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, "টিকিট ছাড়া ট্রেনে উডেছ কেন? ট্রেনে চলতে যে টিকিট লাগে হেইডা জাননা?" অরুণ কিছু বলার আগেই কন্ডাক্টর তাকে এক ধাক্কায় দরজার বাইরে ফেলে দিতে চাইল। কিন্তু অরুণের হাত শক্তভাবে ধরে রইল হ্যান্ডেলে।
হঠাৎ, কন্ডাক্টর তার গালে একটি জোরে চড় মারল। সেই চড়ে অরুণের মাথা ঘুরে গেল, কিন্তু সে হাল ছাড়ল না। কন্ডাক্টর আরও একবার ধাক্কা মারতে গেল, কিন্তু তখনই ট্রেনের ভেতর থেকে একজন যাত্রী কন্ডাক্টরকে থামিয়ে দিল। "বাচ্চা ছেলেটাকে ছেড়ে দাও," সেই যাত্রী বলল, "কেউ না কেউ তার ভাড়া দিয়ে দেবে।"
কন্ডাক্টর কিছুক্ষণ গুম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর বিরক্ত মুখে পিছিয়ে গেল। অরুণ তখন নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে এক নিঃশ্বাসে এতক্ষণ ধরে জমা থাকা কষ্ট, অপমান, আর ভয়কে মিশ্রিত করে কাঁদতে শুরু করল। দুহাতে চোখ-মুখ চেপে ধরলো।
ট্রেনটি তখন শহরের সীমানা ছেড়ে দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। অরুণ জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবতে লাগল—এখন সে সত্যিই পালিয়ে এসেছে। সে আর সেই কষ্টের গ্রামে নেই, যেখানে তার পরিবারের প্রতিদিনের সংগ্রাম। আজ থেকে শুরু হবে তার নতুন জীবন, যেখানে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না।
ঢাকা শহর তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। কিন্তু তাতে কী? এই শহরেই সে তার নিজের পরিচয় খুঁজে পাবে, তার পরিবারের জন্য কিছু করে দেখাবে।
এই নতুন শহরে অরুণ জানে না কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে। কিন্তু তার মনের মধ্যে একটাই ভাবনা—সে পালিয়ে এসেছে, আর তাকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
বিশাল হর্ন বাজিয়ে ট্রেনটি এসে থামল একটি ছোট্ট, ধূলোমাখা স্টেশনে। ঢাকার ফুলবাড়ী রেল স্টেশন। আধুনিক গুলিস্তানের অংশ হলেও, তখনকার সময়কার এই স্থানটি ছিল একেবারে অন্যরকম। অরুণের শরীর ক্লান্তিতে অবসন্ন, তার মন অস্থিরতায় ভরা। সারা দিন কিছু খাওয়া হয়নি। তাই এখন পেটে প্রচণ্ড ক্ষিদে।
ট্রেন থেকে নামতেই তার চোখে পড়ল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের এক করুণ চিত্র। স্টেশনটি নিস্তব্ধ, প্ল্যাটফর্মে গুটিকয়েক মানুষ। চেহারায় যেন বয়ে যাচ্ছে অনিশ্চয়তার ছাপ। বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপতে থাকা এই মানুষগুলো যেন তাঁদের যাত্রার শেষ গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য অমানবিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ফুলবাড়ী স্টেশনের চারপাশে তখনও ঢাকার আধুনিকতার স্পর্শ লাগেনি। খোলা জায়গা, কিছুটা গ্রাম্য পরিবেশ, লাল ইটের তৈরি রেলস্টেশনটি টিনের ছাদে ঢাকা। স্টেশনের আশেপাশে ছোট ছোট দোকানপাট আর বেশ কয়েকটি চায়ের দোকান অরুনের চোখে পড়লো। সেখানে মানুষজন বসে আড্ডা দিচ্ছে। কারো হাতে চায়ের কাপ। কেউ দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছে।। রেললাইন বরাবর কাঁচা রাস্তা দিয়ে দুয়েকটি গরুর গাড়ি, রিকশা আর সাইকেল চলাচল করছিলো।
সন্ধ্যা তখন পুরোপুরি নেমে এসেছে। স্টেশনের সামনে ছোট্ট একটা বাজার চোখে পড়ল, কিন্তু আশেপাশের নিস্তব্ধতা অরুণের মনে এক অদ্ভুত অস্বস্তি এনে দিলো। চারপাশের এই নিঃশব্দ পরিবেশ যেন তাকে অজানা ভয়ে আচ্ছন্ন করে তুলল। শরীরটা হঠাৎ কেঁপে উঠল, আর মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল—এ কি তবে সেই ঢাকা শহর, যার ব্যস্ততা আর কোলাহল এতদিন কল্পনায় ছিল?
কিন্তু রাস্তার পাশের নিয়ন বাতিগুলোর ম্লান আলো তার মনের ভয় কিছুটা প্রশমিত করল। আলোগুলো যেন তাকে আশ্বাস দিল, শহরটা ঠিকই আছে, শুধু একটু অন্যরকম। ধীরে ধীরে অরুণের মনে একধরনের শান্তি নেমে এলো, যেন আলোগুলো তার পথের দিশারি হয়ে উঠেছে।
স্টেশন বিল্ডিংটি ক্ষয়ে গেছে। দেয়ালের প্লাস্টারগুলিও ভেঙে পড়ছে। যাত্রীদের বসার জন্য কাঠের বেঞ্চগুলো ভাঙাচোরা। বসারও উপায় নেই। আশে-পাশে পানের পিচকি লেপ্টে আছে। কেমন একটা বিশ্রী গন্ধ নাকে লাগছে।
এবার ব্যাগটি কাঁধে তুলে স্টেশনের সামনের রাস্তায় পা দিতেই অরুণ অনুভব করল সেই কষ্ট, যা গোটা দেশকেই গ্রাস করে ফেলছে। কিছু বাচ্চা ছেলে-মেয়ে, পেটে ক্ষুধা আর চোখে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি নিয়ে প্ল্যাটফর্মের বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের কাপড় ছেঁড়া, মলিন, আর চোখে-মুখে একরাশ হতাশা। স্টেশনের এক কোণায় এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক বসে আছে, তার হাতে একটা ভাঙা কাসার বাটি, কিন্তু সেখানে কোনো দানের আশায় কেউ নেই। সবাই যেন নিজেদের সমস্যায় এতটাই ডুবে গেছে যে অন্যের দিকে তাকানোর সময়ও নেই।
স্টেশন থেকে কিছুদুর আসতে না আসতেই অরুণ অনুভব করল, কেউ যেন তার দিকে এগিয়ে আসছে। সেই নির্জন স্টেশনে, ভেজা মাটি আর ধোঁয়াটে আকাশের নিচে, একজন অপরিচিত মানুষ হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটির মুখ অন্ধকারে ঢাকা, লম্বা লম্বা গোঁফ-দাড়ি। এলোমেলো জট বাঁধানো চুলগুলি মাথার চারপাশে এবরো-থেবরো হয়ে ছড়িয়ে আছে। তারমধ্যে চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। লোকটি ধীর স্বরে বলল, “কোথায় যাচ্ছিস? তুই কি জানিস, এই শহরে অপরিচিতদের কী হয়?”
অরুণের শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। সে লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারল না। মনে হলো, তার পা দুটো যেন জমে গেছে, গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছে না। দুহাত দিয়ে কাঁধের ব্যাগটিকে শক্ত করে ধরে রাখলো। লোকটি আবারও জিজ্ঞাসা করল, “তোর কাছে কি টাকা আছে? এই শহরে টাকার খুব দরকার। টাকা ছাড়া এখানে মরে যাবি। বাঁচতে পারবি না। কি করবি এখানে?”
অরুণ আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে উঠল। তার পকেটে মাত্র ৫০ টাকা, যা তার শেষ সম্বল। এ টাকা দিয়েই বানাবে স্বপ্নের সিঁড়ি। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, তার সেই স্বপ্নও যেন এই লোকটির সামনে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না কী করবে, কোথায় যাবে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি যেন তার সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গ্রাস করতে চাইছে। “তোর টাকাটা দে,” লোকটি এবার আরও গম্ভীর স্বরে বলল।
অরুণের গলা শুকিয়ে গেছে, সে কোনো উত্তর দিতে পারছে না। তার মন বলছে দৌড়াতে, কিন্তু তার শরীর যেন বরফ হয়ে গেছে। এই অন্ধকার, ধোঁয়াটে স্টেশনটিতে, অরুণের মনে হলো, সে এক বিভীষিকার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে না, এই পরিস্থিতি থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসবে। লোকটির চোখের দৃষ্টি, তার কণ্ঠস্বর, সবকিছুই যেন তাকে আরও গভীরভাবে ভয়ের মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তবুও, কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে, অরুণ বলল, “আমার কাছে কিছু নেই... আমি এখানে নতুন এসেছি।” কিন্তু তার কথা শুনে লোকটি আরও কাছে এগিয়ে এল, আর তার মুখের ভাব আরও কঠিন হয়ে গেল।
ঠিক সেই মুহূর্তে, স্টেশনের অন্য পাশ থেকে আরেকজন লোক চিৎকার করে উঠল, “এই পাগল, ছেলেটাকে ছেড়ে দে ”-এই বলেই লোকটি তেড়িয়ে আসছিল। সেই কণ্ঠে কিছুটা সাহস আর শক্তি ছিল, যা লোকটিকে পিছু হটতে বাধ্য করল। সে এক মুহূর্তের জন্য অরুণের দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর ধীরে ধীরে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
অরুণের হৃদয় তখনো দ্রুত ধকধক করছে। ভেতরে কোথাও যেন আগুনের শিখা জ্বলছে। এই অন্ধকার শহর তাকে ভয় দেখাতে চেয়েছিল, কিন্তু সে বুঝল, ভয়ের মাঝেই লুকিয়ে আছে তার আসল শক্তি। ধীরে ধীরে সে চলতে শুরু করলো। চোখে এক অদম্য প্রতিজ্ঞার ঝিলিক। আজকের এই ঘটনা তাকে বদলে দিয়েছে। একটি নতুন অরুণের জন্ম হয়েছে। সে এবার নিজের ছায়াকেও জয় করবে। পিছনে ফিরে একবার সেই অন্ধকার পথের দিকে তাকিয়ে সে মুচকি হেসে বলল, "খেলা তো এখন শুরু হলো।"
অরুণ জানে, সামনে যা অপেক্ষা করছে তা অজানা, কিন্তু এবার সে প্রস্তুত।
হঠাৎ করে, অরুণের কানে আছড়ে পড়ল একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর—"বাবা, তুমি এখনও বারান্দায় আছো? খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। যাও, খাওয়ার টেবিলে আসো।" অরুণ দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল। দাঁড়িয়ে আছে ছোট মেয়ে রুপা, যার নিষ্পাপ মুখটি যেন তার সমস্ত অন্ধকারের কাঁপনকে মুছে দিচ্ছে।
চলবে , পর্ব-১
ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট