শ্রীচরেণেষু দাদা: দশ


আজ তিন দিন হলো শুভ্র লন্ডন ফিরে এসেছে। কিন্তু মনটা এখনো যেন আটকে আছে গ্রামের বাড়িতে। কেমন থমথমে একটা ভাব, বিষাদের, বেদনার, খুব কষ্টের। চারদিকে কেমন যেন শীতল বাতাসের নিঃশব্ধ হাহাকার ছিলো বাড়ীর চারপাশে। গাছের পাতাগুলোও যেন নিস্তব্ধ নিথর শোকার্ত পরিবেশে।
দাদার শ্রাদ্ধের কাজটা ঠিকঠাক মতোই সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু সেই মুহূর্তগুলো এখনও শুভ্রর মনে গভীর দাগ কেটে আছে।
গ্রামের সব মানুষ, আত্মীয়-স্বজন, দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছিল দাদার শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে। বহু বছর পরে শুভ্র অনেক পুরনো মুখের দেখা পেল—শৈশবের বন্ধু, দূর সম্পর্কের কাকা-কাকিমা, মাসিমা, মামী, নাতি-নাতনী, প্রতিবেশীরা—যাদের সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি। কিন্তু এই পুনর্মিলন ছিল এক গভীর শোকের আবহে মোড়ানো। সবাই দাদার হঠাৎ চলে যাওয়ার ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
শ্রাদ্ধের দিনে বাড়ির উঠোনে বিরাট আয়োজন করা হয়েছিল। যেদিন শ্রাদ্ধ, তার আগের দিনই শুভ্র ঢাকায় এসে পৌঁছায়। কিন্তু পথের ক্লান্তি তার শরীরে গাঁট বেঁধেছিল। তাই সেদিন গ্রামে না গিয়ে পুরনো ঢাকায় ভাগিনীর বাসায় রাত্রিযাপন করেছিল।
পরদিন খুব ভোরে ভাগিনী ও তার পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে শুভ্র গ্রামে রওনা হয়। পথে যেতে যেতে তার মন কেমন এক অজানা আশঙ্কায় ভরে উঠছিল। যেন কেউ তাকে ডেকে বলছিল, “শুভ্র, তুই দেরি করে ফেললি।”
বাতাসের ভেতর এক অদ্ভুত শূন্যতা ছিল, আর গাছপালার পাতারা মৃদু মর্মরধ্বনি করে যেন কিছু বলতে চাইছিল। শুভ্রর বুকের ভেতর অজানা এক যন্ত্রণা ধক ধক করছিল। সারা পথটাই শুভ্রর চোখ দুটি আকাশ আর বাইরের সবুজ গাছগালীর বুকে থমকে ছিলো।
বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই তার কানে এলো শঙ্খ ধ্বনি, মন্ত্রোচ্চারণের গম্ভীর সুর। বাড়ির উঠোনেই শ্রাদ্ধের কাজ চলছিলো। ধূপের গন্ধ বাতাসে ভাসছিলো, কলাপাতায় সাজানো বিশুদ্ধ প্রসাদ আর ঘিয়ের সুগন্ধ মাখা পিণ্ড যেন এক অলৌকিক পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছিলো। পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দাদার ছেলে প্রতুল বসেছে শ্রাদ্ধের কাজে। এই প্রথম শূন্য মস্তকে প্রতুলকে দেখে শুভ্র অনুভব করল বুকের গভীরে লুকিয়ে থাকা সেই কুহক পাখিটির মর্মস্পর্শী রোদন।
ব্রাহ্মণদের কণ্ঠে উচ্চারিত মন্ত্র ধ্বনি যেন শাশ্বত আকাশের কোনো রহস্যময় বার্তা নিয়ে আসছিলো, যেন প্রাচীন ঋষিদের সুর সেখানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
শুভ্র ধীরে ধীরে উঠোনে প্রবেশ করল। প্রতুলের মুখের দিকে তাকাতেই তার গলা শুকিয়ে গেল। প্রতুলের চোখে যেন এক গভীর শূন্যতা, এক নিঃসঙ্গ শোক খেলা করছিল। শুভ্র বুঝতে পারল, সে দেরি করে ফেলেছে। শ্রাদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটা সে মিস করে ফেলেছে। এক অদ্ভুত অপরাধ বোধ তার সমস্ত সত্তা গ্রাস করল। বাবার জন্য, দাদার জন্য, পূর্বপুরুষদের জন্য তার থাকা উচিত ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে।
বাতাসে তখনও মন্ত্রের ধ্বনি ভাসছিল। ধূপের ধোঁয়া ধীরে ধীরে উপরে উঠছিল, যেন কারো আত্মার মুক্তির পথ দেখিয়ে দিচ্ছিল। শুভ্র অনুভব করল, তার ভেতরেও এক শূন্যতা, এক না-পাওয়ার ব্যথা জমে উঠছে। সে জানত, এই শ্রাদ্ধ শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি স্মৃতির এক জীবন্ত মূর্তি, যেখানে না থাকাটা এক অমার্জনীয় ব্যর্থতা। কিন্তু এখন কিছুই করার নেই। ধূপের ধোঁয়ার মতোই কিছু ব্যথা শুধু বাতাসে মিলিয়ে যায়, হৃদয়ের গহীনে দগদগে ক্ষত রেখে।
প্রতুল, বাবার ছবির সামনে বসে কাকাকে এক নজর দেখলো। চোখের জল যেন আর ধরে রাখতে পারছিল না।
প্রতুল অনুভব করল, বাবা চলে গিয়েও থেকে গেছেন – তার হৃদয়ের এক গোপন কোণে, গ্রামের বাতাসে, উঠোনের তুলসী গাছের ছায়ায়, আর সেই মহামন্ত্রের ধ্বনিতে, যা পুরুষানুক্রমে বয়ে চলে আসছে।
সারাটা বাড়ি তখন লোকে লোকারণ্য, অথচ চারপাশে যেন এক অদ্ভুত শূন্যতা। ঘর থেকে ভেসে আসছে চাপা কান্নার অনুরণন, যেন প্রতিটি দেয়ালও শোকে নীরবে কাঁদছে।
শুভ্র দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, ভেতরে যেতে পারছে না—পা যেন ভারী হয়ে গেছে। হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে ছুটে এলেন মীনাক্ষী দিদি। উন্মাদের মতো ছুটে এসে তিনি শুভ্রকে জড়িয়ে ধরলেন।
“শুভ্র…! তুই এলি, এবার আর দাদাকে দেখতে পেলি না…আর কখনো পারবি নারে…!”
কথাগুলো বলতে বলতে ভেঙে পড়লেন তিনি, শুভ্রের কাঁধে মুখ গুঁজে শিশুর মতো কাঁদতে লাগলেন।
শুভ্র কিছু বলতে পারল না, শুধু তার ঠোঁট কেঁপে উঠল। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের জল যেন দিদির কান্নার সঙ্গেই মিশে গেল—দুই ভাইবোনের নিঃশব্দ যন্ত্রণা এক হয়ে গেল শূন্যতার মাঝেই…
তারপর কেটে গেলো বাকিটা দিন……
সন্ধ্যা নামতেই বাড়ির আঙিনা ক্রমশ ফাঁকা হতে লাগল। একে একে সবাই ফিরে যাচ্ছিল, কিন্তু বুকের মধ্যে রেখে যাচ্ছিল অপূরণীয় শূন্যতার অনুভূতি। শুভ্রর মনে হলো, দাদার অনুপস্থিতি শুধু তার নয়, পুরো গ্রামের জন্যই এক অপূরণীয় ক্ষতি।
লন্ডনে ফিরে এলেও, মনে হচ্ছে যেন দাদার স্মৃতিগুলো তাকে বারবার ডেকে নিচ্ছে সেই পুরনো গ্রামে, সেই চেনা উঠোনে, যেখানে এখন শুধুই নিস্তব্ধতা আর স্মৃতির পদচিহ্ন।
গতকাল সকালে শুভ্র বাসায় একা ছিল। সপ্তাহের প্রথম কার্য দিবস। সুতপা যথানিয়মে অফিসে চলে যায়। শুভ্র বাসা থেকেই কাজ করবে। সকালের দিকে শুভ সাধরনত লিখতে বসে। কিন্তু আজ যেন লেখায় মন বসছে না। হঠাৎ ইচ্ছে হলো পুরনো কিছু কাগজপত্র গোছানোর।
অফিস রুমের এক কোণে পড়ে থাকা পুরনো ফাইলিং কেবিনেটের দরজাটা কড়মড় শব্দে খুলতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক পুরনো ফাইল—যেন অতীতের কোনো বন্দি স্মৃতি। ফাইলটির গাঢ় হলুদ হয়ে যাওয়া মলাটে জমেছে সময়ের ধুলো, কোণাগুলো ভেঙে চুরমার, আর পাতাগুলো যেন ক্লান্ত হয়ে একে অপরের বুকে লুটিয়ে আছে।
শুভ্র ধীরে ধীরে ফাইলটা হাতে নিতেই সেখান থেকে উড়ে বেরোল ছোট ছোট ধুলোর কণা, যেন দীর্ঘদিনের ঘুম ভেঙে জেগে উঠল তারা। পাতাগুলোর ফাঁক গলে ছোট ছোট পোকা-মাকড় ছুটোছুটি শুরু করল, যেন কেউ তাদের ঘুমন্ত রাজ্যে অনধিকার প্রবেশ করেছে।
শুভ্রর শরীর হালকা শিহরণে কেঁপে উঠল। ফাইলটা যেন শুধু কাগজের নয়, বরং পুরনো দিনের চাপা কথা, হারিয়ে যাওয়া কিছু গল্প আর ধূসর হয়ে যাওয়া সময়ের এক নীরব সাক্ষী…
শুভ্র ফাইলের ওপর জমে থাকা ধুলো সরানোর জন্য ধীরে ধীরে ফুঁ দিল। সাবধানে ফাইলটা তুলে নিল, ধুলো-মলিন মলাটের ভেতর লুকিয়ে থাকা অতীতের গল্পগুলোর ওজন যেন হাতে অনুভব করল।
মলাট খুলতেই চোখের সামনে উঁকি দিল একগুচ্ছ হলদে হয়ে যাওয়া চিঠি—সময় তাদের ওপর গভীর ছাপ ফেলে গেছে। চিঠির মাঝে লুকিয়ে আছে কিছু পুরনো ছবি, কোণাগুলো ভাঁজ পড়ে ক্ষয়ে গেছে, কিন্তু ছবি যেন এখনো ফিসফিস করে কোনো গল্প বলার অপেক্ষায়। আর তার নিচে রাখা রয়েছে দুইটি পুরনো বই—পাতাগুলো শুকিয়ে গেছে, কিন্তু তবুও হয়তো ভেতরে আছে হারিয়ে যাওয়া দিনের কিছু শব্দ, কিছু অনুভূতি…।
শুভ্রর ছোটবেলা থেকেই কবিতার প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল। স্কুলে বার্ষিক সাহিত্য ম্যাগাজিনে নিয়মিত তার ছড়া-কবিতা ছাপা হতো। তবে কলেজে পড়াকালীন সময়েই তার প্রতিভার প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি এলো—পুরান ঢাকার বাংলাবাজার থেকে প্রকাশিত "দৈনিক দিনকাল" পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা ছাপা হলো!
শুভ্র তো আনন্দে আত্মহারা, কিন্তু তার চেয়েও বেশি খুশি হলো দাদা অরুণ। খবরটা জানার পরই তিনি উচ্ছ্বাসে হকারদের কাছ থেকে পত্রিকার বিশ কপি কিনে নিলেন। বন্ধুদের দিয়ে বললেন, "দেখো, আমাদের শুভ্রর কবিতা ছাপা হয়েছে! আমার ছোট ভাইটা একদিন বড় কবি হবে!"
বন্ধুরা হাসিমুখে শুভ্রর কবিতা পড়লো, কেউ কেউ প্রশংসা করলো, কেউ আবার একটু রসিকতাও করলো—"শুভ্র তো সত্যিই একজন জাঁদরেল কবি হয়ে উঠছে!"
পরদিন দাদা শুভ্রকে রমনা মার্কেটে নিয়ে গেলেন। এক দোকানে গিয়ে সুন্দর একটা কাপড় পছন্দ করে দর্জিকে বললেন, " ভালোভাবে একটা টু-পিস সাফারি স্যুট তৈরি করে দাও। ভাইটির মাপটা ভালো করে দেখে নিও, যেন একদম নিখুঁত হয়। “
শুভ্র চমকে তাকাল, "দাদা, এসব কেন! এত টাকা খরচ করছো আমার জন্য?"
দাদা হাসলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "পাগল! তোর কবিতা ছাপানো হলো, এটা আমার জন্য কত বড় গর্বের কথা জানো? তোমার এই অর্জনটা আমি সারা পৃথিবীকে জানাতে চাই!"
শুভ্রর চোখ ভিজে এলো। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই দাদাই তো হয়ে উঠেছেন তার পরিবারের ছায়া। শুধু বড় ভাই নন, যেন বাবা, অভিভাবক, আশ্রয়স্থল—সবই।
শুধু এইটুকুতেই থেমে থাকলেন না দাদা। তিনি গুলিস্তানের স্টেডিয়াম মার্কেটে গেলেন, একটা বইয়ের দোকান থেকে দুই হাতে ধরে দুইটা বাংলা কবিতার বই কিনে আনলেন। শুভ্রর হাতে দিয়ে বললেন, "নিয়ে রাখ, কবি হতে হলে প্রচুর পড়তে হবে। তোমার লেখাগুলো যেন আরও শক্তিশালী হয়, আরও প্রাণ পায়!"
শুভ্র বইগুলো হাতে নিয়ে দেখল, দাদার চোখেমুখে কেমন এক অদ্ভুত আনন্দ খেলা করছে। সেই মুহূর্তে শুভ্র উপলব্ধি করল—দাদা শুধু বড় ভাই নন, দাদা তার জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।
বইগুলোর পাতায় যেন দাদার নিজ হাতে দেওয়া দাগ এখনো স্পষ্ট। যেন তিনি কোনো বিশেষ অংশের দিকে ইঙ্গিত করে বলে গেছেন, “এটা পড়তে ভুল করিস না, শুভ্র।”
আরেকটু খুঁজতেই বেরিয়ে এলো একটা পুরনো হাতঘড়ি। স্টিলের বডি, ছোট্ট একটা ফাঁটল পড়া কাচ, আর ধুলো জমে যাওয়া চামড়ার বেল্ট। শুভ্র আঙুল দিয়ে ধুলো ঝেড়ে নিলো। এই ঘড়িটা দাদা শুভ্রকে কিনে দিয়েছিলেন মস্কোতে প্রথম আসার সময়। অনেক বছর এই ঘড়িটা শুভ্রর হাতের কব্জিতে ছিলো। যেন এই ছোট্ট বস্তুটায় তার দাদার জীবনের একটা অংশ লুকিয়ে আছে।
একটা চিঠি চোখে পড়তেই শুভ্র চমকে উঠলো। দাদার নিজের হাতে লেখা চিঠি। হয়তো পঁইত্রিশ বছর আগের কথা। তখন শুভ্র ছিল মস্কোর ছাত্র, এক অচেনা দেশে নতুন স্বপ্নের পথচলা।
সে ধীরে ধীরে চিঠিটার ভাঁজ খুলল। পাতার হলদেটে কাগজে সময় তার চিহ্ন এঁকে দিয়েছে, প্রান্তগুলো কিছুটা মলিন, স্পর্শ করলেই ভেঙে পড়বে যেন। শুভ্রর চোখ আটকে গেল উপরের ডান কোণে—কালির কলমে লেখা বিবর্ণ, খানিকটা অস্পষ্ট একটি তারিখ। সে চোখ সরিয়ে নিয়ে আরও ভালো করে পড়ল— ১৪ই শ্রাবণ, ১৯৮৯।
সময়ের অতল থেকে উঠে আসা সেই তারিখটা যেন মুহূর্তেই শুভ্রকে টেনে নিয়ে গেল তিন দশকের পুরনো এক গল্পের ভেতরে…
হলুদ হয়ে যাওয়া পাতার গায়ে দাদার হাতের অক্ষর এখনো স্পষ্ট—
“প্রিয় শুভ্র,
সময় বদলাবে, তুমি বদলাবে, জীবনও বদলাবে। কিন্তু কখনো নিজেকে হারিয়ে ফেলো না। জগতে অনেক কিছু হারিয়ে যায়, কিন্তু শিক্ষা কখনো হারায় না। অভাবের কারনে আমি পড়তে পারি নাই। তুমিই আমাদের ভরসা। একদিন আমি থাকব না, কিন্তু আমার কথাগুলো থাকবে তোমার সাথে। ভালো করে পড়াশোনা করো। টাকা-পয়সার প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবে। জানি, বলবে না, তবু মনে রেখো—এটা তোমার একার লড়াই নয়, আমরাও আছি তোমার পাশে। তোমাকে যে অনেক বড়ো হতে হবে। নিজের শরীরের যত্ন নিও। অনেক সময় আমরা দায়িত্বের ভারে নিজের দিকে তাকাতে ভুলে যাই। মনে রেখো, তুমি যদি নিজের প্রতি যত্নবান না হও, তাহলে অন্যের জন্য কিছু করার শক্তিও হারিয়ে ফেলবে……।
সময় পেলেই মাকে চিঠি লিখবে। মা তো চিঠির আশায় দিন গুনে বসে থাকে। এই কাগজের টুকরোটা তাকে এক পৃথিবী সুখ এনে দেয়। আর হ্যাঁ, মনে রেখো—তোমার জন্য এই পৃথিবীতে কেউ অপেক্ষা করছে, সেই অপেক্ষাকে কখনো ছোট মনে করবে না…..।”
শুভ্রর চোখে জল চলে এলো। চিঠির প্রতিটা শব্দ যেন তার হৃদয়ের গহীনে গিয়ে আঘাত করছিল। দাদার সেই কথা সত্যিই মনে ধরল— “তোর জন্য এই পৃথিবীতে কেউ অপেক্ষা করছে।”
দাদা চলে গেছেন ঠিকই, কিন্তু তার ভালোবাসা, তার শিক্ষা, তার উপস্থিতি—এগুলো কোনোদিনও হারিয়ে যায়নি। শুভ্র যেন দাদাকে স্পষ্ট দেখতে পেলো, সেই চেনা হাসিটা, সেই কঠোর কিন্তু স্নেহময় চোখজোড়া।
চিঠিটা হাতে নিয়েই শুভ্র ধীরে ধীরে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে গাঢ় কুয়াশার চাদরে ঢাকা লন্ডনের আকাশ, কিন্তু তার হৃদয়ের ভেতর আলো জ্বলছে—দাদার লেখা কয়েকটা শব্দের মায়ায়।
ভাবতে ভাবতে শুভ্রর মন ভেসে গেল পুরোনো দিনে, সেই শৈশবের স্মৃতির ভিড়ে। চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল দাদার মুখে শোনা সেই প্রথম দিনের গল্প—যেদিন অভিমানী হৃদয়ে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। ঢাকায় প্রথম রাতের গল্পটা সত্যিই মনে রাখার মতো।
সেই দিন থেকেই শুরু হয়েছিল অরুণের জীবনে এক নতুন পথচলা, এক নিরন্তর সংগ্রামের গল্প। শুভ্র আজ থেকে সেই গল্পই বলবে—কিছু খণ্ডচিত্র, যেখানে জড়িয়ে আছে দাদার ত্যাগ, ভালোবাসা, আর এক অদম্য আত্মবিশ্বাসের কাহিনি।
খুব ক্লান্ত ছিলো অরুণ। এক অজানা শহরে প্রথম রাত। তাও কোন চার দেয়ালের নীচে সাজানো ঘরে নয়। এ যেন আস্তাকুঁড়ের পাশে পুরনো দিনের ভাঙাচোরা এক ভবন। সারাদিন ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়াও হয়নি। তাই দূর্বল শরীরটা নূয়ে পড়েছে। আস্তে আস্তে বিল্ডিংয়ের ভিতরে ঢুকে ভাঙা দেয়ালের এক পাশে গিয়ে বসলো অরুণ। ঘুমের ঘোরে মাথা এক সময় নুয়ে পড়ে।
রাত গভীর হতে থাকে। শহরের ব্যস্ততা থেমে গেলেও ঢাকার বাতাসে এক অদ্ভুত গুঞ্জন তখনও লেগে আছে। স্ট্রিটলাইটের হলুদ আলো ফাঁকা রাস্তার ধুলোয় ছড়িয়ে পড়েছে, আর দূর থেকে টুংটাং আওয়াজ তুলে তখনও দু-একটি রিকশা ছুটে চলছে। অরুণ ঘুমিয়ে ধীরে ধীরে নাক ডাকছে।
রাতের শেষ দিকে ঘুমিয়ে থাকা যুবকের পাশে ধীরে ধীরে দুজন অচেনা মানুষ এসে দাঁড়ায়। একজন লম্বা, পাতলা গড়নের, তার চোখে এক অদ্ভুত ঝিলিক। অন্যজন একটু বেঁটেখাটো, মুখে এক চিলতে দাড়ি, আর হাতে একটা পুরনো পিতলের আংটি।
“এই পোলাডা কেডায় আবার? কোন থাইকুন আইছে? আগে তো এইহানে দেহি নাই,” ফিসফিস করে বলে লম্বা জন।
বেঁটেখাটো লোকটি অবাক হয়ে বলে, “কই থেইক্যা দেইখব? আমরা এক লগে ছিলাম না হারাডা দিন? দেইখ্যাত লাগতাছে এক্কেবারে নয়া মাল। তবে জামা-প্যান্ট দেইখ্যা মনে অইতাছে শহরের পোলা। খুব কেলান্ত লাগতাছে। দেহস না, নাক ডাকতাছে।”
বেঁটেখাটো লোকটি সামনের দিকে ঝুঁকে বলে, “অর লগে কিছু আছে নি? দেখতামনি পকেটে হাত দিয়া।”
লম্বা জন একটু হাসে, “দেইখ্যা তো মনে হইতেছে না কিছু আছে। হইলেও বেশি হইবো না। খালি পকেটে দৌড়াইয়া আইছে মনে হইতাছে।”
এমন সময় পাশের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসে। ভোর হতে চললো। হঠাৎই অরুণ নড়েচড়ে ওঠে, যেন গভীর ঘুমের মধ্যেও কিছু অনুভব করতে পেরেছে।
চোখ খুলেই দুজনকে সামনে দেখতে পায়। এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। একটু ঘাবড়ে যায় অরুণ, শরীর সেঁটে দেয়ালে লাগিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে। বুঝতে পারছে না কি বলবে।
“এই ভাই, কারা তোমরা?” অরুণের কণ্ঠস্বরে আতঙ্ক ও সতর্কতার মিশ্রণ।
লম্বা জন একটু পিছিয়ে গিয়ে চোখ কুঁচকে তাকায়, দাঁত কেলিয়ে প্রশস্থ মুখে ভেচকিয় বলে -“শহরের পোলা নি?”
অরুণ মাথা নাড়ে। কথা বলার মতো শক্তি নেই তার। ভয়ে শরীরটা জবুথবু হয়ে আছে। হৃদপিন্ডটা শ`মাইল বেগে লাফাচ্ছিলো তখন।
“এইভাবে রাইতে ইহানে আইলা ক্যান? কিছু হইসে নি তোমার?” এবার খাঁটো লোকটি কথা বলে।
অরুণ মুখ খোলে, শুকনো ঠোঁট চাটে, তারপর বলে, “আমি... আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি।”
দুই আগন্তুক একে অপরের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ নীরবতা।
“এটা শহর, ভাই। এখানে পথ হারাইলে বিপদ আইছে,” লম্বা জন ঠান্ডা কণ্ঠে বলে।
বেঁটেখাটো লোকটি একটু এগিয়ে এসে বলে, “তোমার লগে কিছু আইছে নি? টেয়া-পয়সা?”
অরুণ ধীরগতিতে মাথা নাড়ে, “না... কিছু নেই।”
দুই আগন্তুক এবার আবার একে অপরের দিকে তাকায়। একটুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, যেন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করছে।
হঠাৎ লম্বা লোকটি বলে, “তুমি থাইকবা কই?”
অরুণ কিছু বলে না। সে নিজেও জানে না উত্তরটা।
বেঁটেখাটো লোকটি একবার মৃদু হেসে বলে, “আইচ্ছা, তুমি চিন্তা কইর না। আমরাও রাতে এইহানে থাকি।“ এই বলে লম্বা লোকটি হাসি ফুটিয়ে বলে-“আমি অইলাম আসলাম। আর এই যে বাইট্টা মানুষটা, এর নাম হইল তমাল। আমরা কুমিল্যা থেইক্যা আইছি। দুইডা মাস পার কইরা ফালাইছি এই ঢাকা শহরে। দিনে থাহি বাইরে। রাইত অইলে এহানে ঘুমাইতে আসি। আমাগো লগে আরো বেবাক লোক আছে। এই দেহনা সব্বাই কেমনে এদিক-সেদিক ঘুমাইয়া আছে।“
অরুণ অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকায়। চারিদিকে একটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করে।
“তোমার নামডা কিতা?”-লম্বা লোকটি অরুণকে জিজ্ঞেস করে।
অরুণ একটু দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে উত্তর দেয়, “আমি অরুণ।”
আসলাম মাথা নেড়ে হেসে বলে, “তুমি কইথ্যেইক্যা এইহানে আইছ?”
অরুণ একটু ইতস্তত করে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “আমি... নতুন আসছি। আমার গ্রামের বাড়ী কুমিল্যায়...”
তমাল আর আসলাম মুহূর্তেই একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসল। তমাল বলল, “আরে, তাইলে তো তুমি আমাগোই মানুষ! কুমিল্যার পোলা আবার একা থাকবো ক্যামনে?”
আসলাম বন্ধুসুলভ গলায় যোগ করল, “এই শহরে নতুন আইলা, তাইলে কিন্তু সাবধানে থাকতে হইবো। ঢাকার রাস্তা-ঘাট এত সহজ না, ভাই। কত কিছু শিখতে হইবো তোমারে! চিন্তা কইরো না, আমরা তো আছিই।”
অরুণ অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভয়ের সেই দমচাপা অনুভূতিটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে, মনের ভেতরে উষ্ণ একটা শান্তি অনুভব করলো। এতক্ষণে প্রথমবারের মতো মনে হলো, সে হয়তো একেবারে একা নয়।
চারপাশটা একটু ভালো করে দেখে নেয় অরুণ। কারোই ঘুম ভাঙেনি এখনো—কেউ কার্টনের ওপর গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে, কেউ বা ময়লা চাদর জড়িয়ে গভীর ঘুমে। এক কোণে এক বৃদ্ধ কাশতে কাশতে উঠে বসছে, যেন রাতের ঠান্ডা তার হাড়ের ভেতর ঢুকে গেছে।
বাইরে তখন ভোরের আলো ধীরে ধীরে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। রাস্তার বাতিগুলো তখনও ফ্যাকাশে জ্বলছে, কিন্তু সূর্যের সোনালি আভা ধীরে ধীরে সেগুলোকে ম্লান করে দিচ্ছে। দূরের এক চায়ের দোকানে আগুন জ্বলে উঠেছে, গরম পানির ধোঁয়া বাতাসে ভাসছে। পাশে কয়েকজন রিকশাওয়ালা ক্লান্ত দেহ নিয়ে বসে আছে, কারও চোখে ঘুম জড়ানো, কারও মুখে ভোরের ঝিমুনি।
এই শহরটা যেন দুই রকমের—একটা শহর এখনো স্বপ্নের ভেতর ডুবে আছে, আরেকটা শহর জেগে উঠছে ব্যস্ততা আর সংগ্রামের প্রস্তুতি নিয়ে। অরুণ গভীরভাবে শ্বাস নেয়। তার সামনে দুটো রাস্তা—একটা একাকীত্বের, আরেকটা এই অচেনা বন্ধুদের সঙ্গে পথ চলার।
আসলাম আর তমাল ওর দিকে তাকিয়ে আছে, মুখে হাসি, চোখে বোঝার মতো একটা অপেক্ষা—“কি বলো, ভাই? থাকবা নাকি আমাগো লগে?”
চলবে—
ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট