শ্রীচরেণেষু দাদা: নয়

Bangla Post Desk
ড. পল্টু দত্ত
প্রকাশিত:১৬ মার্চ ২০২৫, ০৭:০৩ পিএম
শ্রীচরেণেষু দাদা: নয়

শুভ্রর দুই বছরের বড়ো বিকাশদার বড়ো ছেলের বউ প্রিয় সকালে ফোন করে সুতপাকে দাদার মৃত্যুর সংবাদটা দিয়েছিলো। এর মধ্যে বেশ কয়েক ঘণ্টা কেটে গেছে। শুধু শোকের ভারটা এখনো চারপাশে একই রকম রয়ে গেছে। তবে বাইরে শীতের থমথমে ভাবটা আর নেই। দিন বাড়ন্ত হওয়ার সাথে সাথে নীলাভ পড়ন্ত শেষ সকালের রোদ ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু শুভ্রর মনে এখনো এক হাহাকারের মরুভূমি, যেন ধুক ধুকে এক ঘন অন্ধকার। রান্নাঘরের দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুতপার চোখ এখনও লাল, কান্না থেমেছে ঠিকই, কিন্তু বেদনাটা তীক্ষ্ণ হয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে আছে। শুভ্র তখনো লাইব্রেরিতে বসে আছে। জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে, দৃষ্টি কোথাও আটকে নেই—নির্বিকার, অথচ ভেতরে এক ভয়ানক ঝড় বয়ে চলেছে। সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না, দাদা নেই। কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, কিন্তু খবরটা যেন তার মনের মধ্যে পুরোপুরি প্রবেশই করেনি। একটা দমচাপা অনুভূতি বুকের ভেতর গুমড়ে উঠছে। কান্না আসছে, কিন্তু সে থামিয়ে রেখেছে।

এবার রান্না ঘরের দড়জা খোলার শব্দ কানে ভেসে এলো। সুতপা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে লাইব্রেরিতে ঢুকলো। শুভ্রর কাঁধে হাত রাখল।

"তুমি বাড়িতে ফোন দেবে না? বিকাশদাকে একটা ফোন দাও...বৌদির সাথে একটু কথা বলো--- প্রতুলের সাথেও কথা বলো। কিভাবে কি করতে হবে, একটু খোঁজ নাও।" তার গলাটা কাঁপছিল, তবু সে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছিল। "দাদার বড় মেয়ে পল্লবীর সাথে আমি কথা বলছি। ও খুব ভেঙে পড়েছে। ও বললো দাদাকে পুরনো ঢাকার বাড়ীতে নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে সরাসরি গ্রামে নেওয়া হবে।“

দাদার একমাত্র ছেলে প্রতুল। একজন ডাক্তার। এখন সবকিছু তো তাকেই সামলাতে হবে।

প্রতুল মাঝবয়সী মানুষ, বয়স পঁয়তাল্লিশের কোঠায়। গায়ের রং খানিকটা শ্যামলা, কিন্তু তাতে তার ব্যক্তিত্বের ঔজ্জ্বল্য একটুও কমে নাই। দীর্ঘকায় শরীর, সুউচ্চ কাঠামো, আর সামনে বেরিয়ে থাকা বড়সড় উদর তাকে এক দেখাতেই আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। রোগী দেখা, নাক-কান-গলায় অস্ত্রোপচার করা, ওষুধপত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকা, এসবই তার পেশার অংশ, কিন্তু তার সত্যিকারের ভালোবাসা হলো খাবারের প্রতি। বিশেষ করে বিরিয়ানি আর মাংসের প্রতি তার অকুণ্ঠ আসক্তি। 

একপ্লেট সুগন্ধি বিরিয়ানি কিংবা ঝাল ঝাল মাংসের পদ সামনে এলে প্রতুলের মুখে প্রশান্তির হাসি খেলে যায়। খাওয়ার প্রতি তার এমন অগাধ ভালোবাসা যেন তার জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। বড় বড় উৎসব হোক বা ক্লান্তিকর হাসপাতালের ডিউটির পরে নিজের প্রিয় রান্নার স্বাদ নেওয়া—খাবার তার জীবনের অন্যতম আনন্দ।

তার এই খাওয়া-দাওয়ার শখ নিয়ে পরিবারের লোকজন মাঝেমধ্যে মজাও করে, কিন্তু প্রতুল তাতে খুব একটা মাথা ঘামায় না। সে হাসিমুখে বলে— "জীবনটা একটাই, খাওয়া যদি ঠিকমতো না হয়, তবে আর কিসের আনন্দ?"

প্রতুলের মতো ছেলে হয় না। মায়ার শরীর। কারো দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে পারে না। 

প্রতুলের মা যখন মারা যান, প্রতুল এবং অরুণদাদা দুজনেই বিশেষ কোনো কারণে কলকাতায় ছিলেন। যেদিন মারা যান, তার আগের দিন রাত শুভ্র ঘুমুতে পারেনি। একটু পর পরই রুপার বর কিংবা কখনো রুপা মায়ের বিষম অসুস্থতার খবর দিচ্ছিলো। কিন্তু পরদিন সকালে প্রতুলই শুভ্রকে ফোন করে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল— “কাকা, মা আর নেই। আমি আর বাবা এয়ারপোর্টে যাচ্ছি।”

গাড়ির মধ্যে তখন প্রতুলের বাবা এবং কাকা সঞ্জয়ও ছিলো। শুভ্র  প্রতুলের বাবা অরুন দাদার ক্ষীন কন্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলেন। ধীরে ধীরে বললেন, "আমি জানতাম, এভাবেই হবে... কিন্তু আমি দেখতে চেয়েছিলাম শেষবারের মতো।"

প্রতুল এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, "বাবা, আমরা পৌঁছানোর আগেই মা চলে গেলেন... আমরা যদি একটু আগে যেতে পারতাম..."

বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "জীবনে সবকিছু সময়মতো হয় নারে প্রতুল... তোর মা আমাকে কতবার বলেছে, একদিন আমরা সবাই একা হয়ে যাব। আজ সেটা সত্যি হলো।"

হঠাৎ ফোনটা কেটে গেলো।

শুভ্র এখনো ভেবেই চলছে। 

তার ভাবনারা যেন এলোমেলো হয়ে একে অপরের সাথে গুলিয়ে যাচ্ছে। একদিকে প্রতুলের কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর এখনো তার কানে বাজছে— "কাকা, মা আর নেই..." আর অন্যদিকে প্রতুলের বাবার সেই শান্ত অথচ ভারী কণ্ঠ— "আমি দেখতে চেয়েছিলাম শেষবারের মতো..."

সমস্ত কিছু কেমন যেন অবাস্তব লাগছে শুভ্রর কাছে। 

সুতপা বলেছিল বিকাশদাকে ফোন করতে। কিন্তু কেন জানি শুভ্রর হাতটা ফোনের দিকে এগোচ্ছে না। কী বলবে সে? বিকাশদা ফোন ধরলেই কি সত্যিটা আরো গভীরভাবে বাস্তব হয়ে যাবে? এত বছরের অভ্যস্ত সম্পর্ক, চেনা হাসিমুখগুলো, মাঝে মধ্যে কথা বলা—সব এক মুহূর্তে বদলে গেছে।

শুভ্র জানে, একসময় ফোন করতেই হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে, সে শুধু চুপচাপ বসে আছে, একরাশ স্মৃতি আর অপরাধবোধের ভারে যেন নিঃশব্দে ডুবে যাচ্ছে।

বিকাশ শুভ্রর বড়ো ভাই। দুজনেই ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে স্কুলে পড়াশোনা করত। তবে বিকাশ বয়সে বড়ো হলেও পড়াশোনার প্রতি তার বিশেষ মনোযোগ ছিল না। বই-খাতা নিয়ে বসতে তার ভালো লাগত না, আর স্কুলে যাওয়ার নাম শুনলেই মাথা ধরতে শুরু করত। পরিবার থেকে যতই উৎসাহ দেওয়া হোক, সে যেন স্কুলের প্রতি একরকম বিরক্তই ছিল। বরং ধানক্ষেত আর পানের বরজের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো, সেখানে কাজ করা—এসবের প্রতিই তার বেশি টান ছিল।

বিকাশের এই স্কুল-বিমুখ স্বভাব নিয়ে পরিবারে কম দুশ্চিন্তা ছিল না। বিশেষ করে তার মাথাব্যথার ব্যাপারটা নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন ছিল। যখনই স্কুলে যাওয়ার কথা উঠত, তখনই সে মাথাব্যথার অজুহাত দেখাত। প্রথমে সবাই ভেবেছিল, হয়তো সত্যিই কোনো সমস্যা আছে, কিন্তু পরে বুঝতে পারল—এটা স্কুল এড়িয়ে যাওয়ার একটা কৌশলমাত্র।

এই ঘটনা ১৯৭৫ সালের পরের সময়কার। তখন পরিবারে ধীরে ধীরে কিছুটা স্বচ্ছলতা আসতে শুরু করেছে। শুভ্রর বড়ো ভাই অরুণদা ইতিমধ্যে বিয়ে করেছেন এবং ঢাকায় একটি ছোট্ট বাসা ভাড়া নিয়ে সংসার পাতিয়েছেন। তার আয়-রোজগারের কারণে পরিবারেও স্বস্তির ছাপ পড়েছে। এই সুযোগে অরুণদা ছোট ভাই সুবীরকেও ঢাকায় নিয়ে যান এবং সেখানে একটি ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন, যাতে অন্তত সে ঠিকভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। 

হঠাৎ সুতপার হালকা ধাক্কায় শুভ্রর ভাবনায় কিছুটা ছেদ পড়লো। ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কান্না এবং শোকে ভারাক্রান্ত সুতপার দিকে তাকাতেই সুতপা ফিস ফিস করে ঘাড়টা একটু নীচু করে বলে উঠলো-

-“কি ভাবছো? এখন উঠ। ফোনের কাজটা সেরে নাও।“

শুভ্র নিঃশব্দে মাথা নেড়ে উঠে দাড়ালো। ধীরে ধীরে রান্না ঘরে এসে টেবিলে রাখা মোবাইলটা হাতে তুলে নিল। কিন্তু আঙুলগুলো যেন অসাড় হয়ে আছে। প্রথম ফোন দিলো বৌদিকে।  কল লাগতেই ওপাশ থেকে এক মুহূর্তের নীরবতা, তারপর বৌদির গলাটা ভেসে এলো—কাঁপা কাঁপা, কান্নাভেজা, ব্যথায় ভরা।

"ছোড়দা…!"

শুভ্রর কণ্ঠ আটকে গেল। বুকের ভেতর একটা ভারি পাথর চেপে ধরেছে যেন। সে কিছু বলতে পারছে না, শুধু নিঃশ্বাস ফেলছে। ওপাশ থেকে বৌদি আবার বলল, "ছোড়দা, কেমন আছেন...!  বড়দাতো আর নেই….”

শুভ্র চোখ বন্ধ করল। ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে উঠছে, কিন্তু সে আটকানোর চেষ্টা করছে।

"শুনেছি বৌদি...প্রিয় ফোন করেছিলো" কণ্ঠটা ভাঙা, তবু শান্ত রাখার চেষ্টা।

ওপাশ থেকে আর কিছু শোনা গেল না, শুধু ফোঁপানোর শব্দ। ফোনটা কানে চেপে ধরে শুভ্র চুপচাপ বসে রইল। সুতপা তার দিকে তাকিয়ে বলল, "শুভ্র... কিছু একটা বলো। তুমি এভাবে থাকলে চলবে না। আমাদের এখনো অনেক কিছু করতে হবে। মোবাইলটা স্পীকারে দাও"

শুভ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

বৌদির সাথে কথা হলো। কী কী করতে হবে সব নিয়ম কানুন সুতপাকে বলে দিলো। বৌদিরা সবাই কিছুক্ষনের মধ্যেই গ্রামের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিবে।

 একসময় ফোনটা টেবিলে রেখে সুতপার দিকে তাকালো শুভ্র-

"সবকিছু একসাথে এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল, বুঝতে পারছি না, সুতপা। আমি দাদাকে শেষবারের মতো দেখে আসতে পারলাম না... শেষ কথাটা বলারও সুযোগ পেলাম না..."

সুতপা কিচ্ছু বলল না, শুধু শুভ্রর হাতটা নিজের হাতে শক্ত করে চেপে ধরল। বাইরে দুপুরের আলো আরও গাঢ় হচ্ছে, কিন্তু তাদের চারপাশে কেবল শূন্যতা, এক গভীর শোকের অন্ধকার...

বৌদির কন্ঠে এমন এক অসহায়ত্ব ছিল, যা শুনে শুভ্রর হৃদয় ছিঁড়ে যেতে লাগল। চোখ দুটি জলে ছল ছল করতে লাগলো। কন্ঠে কী এক চাপা আর্তনাদ। এত দূরে থেকে কিছুই করতে পারছে না সে।

"বৌদি, আমি রাখছি...সবকিছু মঙ্গলমতো যেন শেষ হয়" ফিসফিস করে বলল শুভ্র।

"কবে আসবেন, ছোড়দা? এখন না এসে বরং পারলে বড়দার শ্রাদ্ধের আগে আসবেন?" বৌদির গলা কান্নায় ভারী হয়ে এল।

শুভ্র একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার টিকিট কাটা ছিল। যেদিন শ্রাদ্ধ তার তিনদিন পরেই যাওয়ার কথা। কিন্তু এখন তাকে দাদার শ্রাদ্ধে থাকতেই হবে।

"বৌদি, আমি আজই টিকিটের ডেইটটা চেঞ্জ করবো। যত তাড়াতাড়ি পারি, চলে আসব।"

বৌদি আর কোনো কথা বললেন না, শুধু ফোনের ওপাশে একটা চাপা কান্নার শব্দ শোনা গেল।

ফোনটা রেখে শুভ্র নিঃশব্দে মাথা নিচু করে বসে রইল। মনে যেন এক ঝটকায় দরজা খুলে গেল ফেলে আসা দিনগুলোর। পুরনো দিনের স্মৃতির পাতাগুলো একে একে চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল—দাদার সঙ্গে কাটানো সেসব অমূল্য মুহূর্ত! ঢাকায় পড়ার সময় দাদার পাশে বসে ছুটির দিনে গল্পের আড্ডা, সন্ধ্যায় উত্তেজনায় ঠাসা বাংলা নাটক দেখা, শীতের সকালের কুয়াশার চাদরে মোড়া বারান্দায় গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে দাদার স্নেহমাখা হাসি, সন্ধ্যায় পড়তে বসার সময় দাদার সস্নেহ কণ্ঠে "সব ঠিক আছে তো? পড়াশুনায় কোন অসুবিধা হচ্ছে নাতো?" বলে খোঁজ নেওয়া—এ যেন ছিল এক অনাবিল ভালোবাসার আশ্রয়!

আর সন্ধ্যায় একটু দেরি করে বাসায় ফিরলে দাদার সেই অস্থিরতা, উদ্বেগ মাখা চোখে মুখে দড়জার দিকে তাকানো, হাসফাস করা, বৌদিকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা—সব স্মৃতিগুলো যেন আজ বুকের ভেতর হাহাকার তোলে। এক একটা মুহূর্ত যেন পুরনো সিনেমার দৃশ্যের মতো চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, কিন্তু আজ বাস্তবে ছুঁতে পারছে না! শুভ্রর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে—সময় কেমন নির্মম! কিছু মানুষকে আমাদের জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, কিন্তু স্মৃতিগুলো ঠিকই প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের সঙ্গে থেকে যায়!

"শুভ্র..."

সুতপা ধীরে ধীরে তার পাশে এসে বসল। শুভ্র ধীর চিত্তে মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে ছিলো, যেন সেটার ভেতরেই কোথাও দাদার অস্তিত্ব রয়ে গেছে। চোখ ভেজা, মুখে একরাশ ক্লান্তি আর অবসাদ।

সুতপা ধীর স্বরে বলল, "তুমি একটু অফিসেও জানিয়ে দাও। আজই না হয় টিকিটের ডেইটটা চেঞ্জ করে ফেলো। তবে তার আগে শ্রাদ্ধের দিনটা একটু জেনে নাও।"

শুভ্র ধীরে মাথা নাড়ল, চোখের কোণ এখনও ভারী। "হ্যাঁ, জানাতে হবে... বৌদি বলছে গ্রামে গিয়ে ডেইটটা জেনে জানাবে। তবে বলেছে আজ থেকে পনেরো দিন পরেই কাজটা হবে।"

সুতপা শুভ্রর হাত ধরে শক্ত করে চেপে ধরল। অনুভব করল শুভ্রর আঙুলগুলো হালকা কাঁপছে। "এতো ভেঙে পড়ো না, প্লিজ। দাদা চাইবে না তুমি এভাবে থাকো।"

শুভ্র মুখ তুলল, ঠোঁট কাঁপছে। কণ্ঠে একটা হারিয়ে যাওয়া শিশুর মতো ব্যথা, "সত্যিই কেমন জানি লাগছে... ছোটবেলা থেকে দাদাই তো আমাদের সব! বাবা-মায়ের পর দাদাই তো আমাদের সবগুলো ভাই-বোনদের ছায়া হয়ে ছিল। ঢাকায় পড়তে আসার পর থেকে একদিনও দাদা আমাকে কোন কটু বাক্য শোনায়নি, সব সময় আমাদের সবাইকে নিয়ে ভাবতেন,  অফিস থেকে ফিরে চা হাতে বসে থাকা, নাটকের টানটান দৃশ্যে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকা... আর আমি? কতদিন বলেছি 'বড় হয়েছি, এত খবর নেওয়ার দরকার নেই', অথচ আজ সেই খবর নেওয়ার মানুষটাই নেই!"

কথাগুলো বলতে বলতে গলা ধরে এল শুভ্রর।

সুতপা শুভ্রর হাতটা নিজের কোলের ওপর নিয়ে রাখল, আলতো করে আঙুল বোলাতে লাগল। "তুমি একা নও শুভ্র। আমরা সবাই আছি। "

শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এক মুহূর্ত নীরব থাকার পর আস্তে করে বলল, "জানি... কিন্তু নিজেকে বোঝানো এত সহজ না, সুতপা।"

দুপুর গড়িয়ে বিকেলের আর্দ্রতা নেমে এল। ঘরের বাতাসটাও যেন ভারী হয়ে আছে। শুভ্র অফিসে ইমেইল করে জানিয়ে দিল, এরপর টিকিট বদলানোর জন্য ওয়েবসাইট খুলল। কিন্তু মন পড়ে আছে অন্য কোথাও।

তারপর একে একে শুভ্র সবাইকে ফোন করতে লাগল। প্রতিটি ফোন যেন এক একটা শোকের বার্তা বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।

শেষে দিদিকে ফোন করতে গিয়েও এক মুহূর্ত থমকে গেল শুভ্র। ভেবেছিল দিদিরা হয়তো ইতোমধ্যেই খবরটা পেয়ে গেছেন। কিন্তু ফোন করেই বুঝতে পারল, দিদির কাছে এখনো কিছুই পৌঁছায়নি।

ফোন বাজতেই দিদি ধরল, স্বভাবসুলভ কণ্ঠে বলল—

"হ্যালো, কেডায়?"

শুভ্রর গলা শুকিয়ে এল। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল—

"আমি দিদি, আমি শুভ্র।"

"শুভ্র? কেমন আসছ?"

"আমি ভালো। তোমরা খবরটা পাইছত?"

দিদির কণ্ঠ মুহূর্তেই উৎকণ্ঠায় বদলে গেল—

"কিয়ের খবর? কিতা অইছেরে?"

শুভ্র জানত, যতটা সম্ভব ধীরে ধীরে বলা উচিত, কিন্তু তার মুখ থেকে কথাটা ফসকে বেরিয়ে গেল—

"দাদাতো আর নাই…"

এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড... যেন শব্দহীন একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল দিদির মনে। আর তারপর…

"কিতা কসরে!!!"

তারপর সব যেন ভেঙে পড়ল। ওপাশ থেকে ভেসে এলো হাউমাউ করে কান্নার শব্দ। এক তীব্র, হৃদয়বিদারক কান্না। শুভ্র ফোনটা শক্ত করে ধরে বসে থাকল।

"দিদি, ঘরে কেউ নাই?"

কান্নার মধ্যেই দিদি অস্পষ্টভাবে বলল—

"না… সুমন চেম্বারে… আর তর দাদা গ্রামের বাড়ীতে…কির্তন শুনতে গেছে…"

শুভ্র বুঝতে পারল, দিদি এই মুহূর্তে একদম একা। এই বিশাল খবরটা একা সামলানোর মতো শক্তি ওর নেই। শুভ্রর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল।

এখন কী করবে? ফোনের ওপাশ থেকে দিদির কান্না থামছেই না… আর শুভ্রর মনে হতে লাগল, এই শোকের ভার সে কিভাবে বইবে? কীভাবে সামলাবে এই মুহূর্তগুলো? দিদি যদি মূর্ছা যান? সর্বনাস! কী করলম আমি?

শুভ্রর মাথাটা কাজ করছিলো ধীরে ধীরে, যেন সবকিছু একটা ঘন কুয়াশার মধ্যে ঢাকা পড়ে গেছে। 

সে ফোনটা বন্ধ করে তাড়াতাড়ি  ফোন করল দিদির ছেলেকে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছিল, কী বলবে, কোথা থেকে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। ফোনের ওপাশে ওর দিদির ছেলে চেনা কণ্ঠে বলল—

"মামা, কী হয়েছে? তোমার গলাটা কেমন শোনাচ্ছে?"

শুভ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর ধীর গলায় বলল—

"বাবা, তোর বড় মামা আর নেই।"

ওপাশে মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এলো, যেন সময় থমকে গেছে। তারপর ভাঙা কণ্ঠে শুধুই একটা প্রশ্ন—

"কখন? কেমন করে?"

শুভ্র এক এক করে সব বলল। 

-“তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় যাও। তোমার মা বাসায় একা। খুব ভেঙ্গে পড়েছে।“

-“আমি এখনি যাচ্ছি মামা। গ্রাম থেকে বাবাকে নিয়ে ফিরছি।“

শুভ্র চোখ বন্ধ করে ফেলল। ভেতর থেকে একটা চাপা শ্বাস বেরিয়ে এলো। কত কথা, কত স্মৃতি একসাথে ভিড় করছে তার মাথায়। আর তখনই সুতপা আস্তে করে ফোনটা শুভ্রর হাত থেকে নামিয়ে নিলো, স্পিকারে দিলো, নিজেই একটু শান্ত কণ্ঠে বলল,

"বাবা তুমি তোমার মাকে আগে এটা ফোন দাও"

সুতপা এক মুহূর্ত শুভ্রর দিকে তাকিয়ে থাকল।

শুভ্রর চোখে আর জল নেই। কিন্তু তার মুখের অভিব্যক্তিতে এমন কিছু ছিল, যা বলে দিচ্ছিল—এই মুহূর্তের পর থেকে, সবকিছু বদলে যাবে।

চলবে—

ড. পল্টু দত্ত
শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিষ্ট