১০ প্রকার খেজুরের পুষ্টি, স্বাস্থ্যগুণ ও দাম

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট প্রতিবেদক
প্রকাশিত:০৩ মার্চ ২০২৫, ১১:১৪ পিএম
১০ প্রকার খেজুরের পুষ্টি, স্বাস্থ্যগুণ ও দাম

পবিত্র রমজান মাস আসার সঙ্গে সঙ্গে যে ফলটির চাহিদা সর্বাধিক বৃদ্ধি পায় তা হলো খেজুর। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানদের মতো বাংলাদেশিদের কাছেও এটি ইফতার শুরুর একটি ঐতিহ্যবাহী উপায়। জাতভেদে প্রতিটিরই রয়েছে অনন্য স্বাদ। এছাড়া অধিকাংশ খেজুরেরই রং, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যগুণ প্রায় কাছাকাছি। রোজা ছাড়া প্রতিদিনের জলখাবার বা ভারী খাবারের সঙ্গেও খেজুর দারুণ একটি সংযোজন। এই ফলটি নিয়েই আজকে স্বাস্থ্য বিচিত্রা। চলুন, দেশের বাজারে চলমান বিশ্ব নন্দিত ১০টি খেজুরের জাত, উৎস, পুষ্টি, স্বাস্থ্যগুণ ও বাজার দর সম্বন্ধে জেনে নেওয়া যাক।

বর্তমান বাজারের জনপ্রিয় ১০টি খেজুর

আজওয়া

মাঝারি ডিম্বাকৃতি কুঁচকুঁচে কালো বর্ণের আজওয়া খেজুর উৎপন্ন হয় সৌদি আরবের মদিনায়। সম্পূর্ণ চর্বিহীন এই ফল প্রাকৃতিক চিনির শর্করা উপাদানসহ প্রোটিনে ভরপুর। এতে আরও আছে ফাইবার, ক্যালসিয়াম, আয়রন ও পটাসিয়াম। খনিজ পুষ্টিগুলো হাড়ের গঠনকে মজবুত করে। পেশীর ফাংশন ও হৃদযন্ত্রে সামগ্রিক সুস্থতার বিকাশ ঘটায়। আর ফাইবার হজমশক্তি ত্বরান্বিত করে পরিপাকতন্ত্র স্বাভাবিক রাখে।

মানের ভিত্তিতে খুচরা কাঁচা বাজারে আজওয়ার দাম কেজি প্রতি ৬৪০-৮০০ টাকা। কোনো কোনো বাজারে এগুলো ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার টাকা বিক্রি হয়।

মেডজুল

বৃহদাকৃতি ও সুমিষ্ট স্বাদের জন্য বিশ্বব্যাপি স্বীকৃত মেডজুল। এই খেজুর উৎপন্ন হয় মরক্কোর তাফিলাল্ত অঞ্চলে। এগুলো ফিনিক্স ড্যাক্টাইলিফেরা প্রজাতির উদ্ভিদ থেকে চাষ করা হয়। বর্তমানে এগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইস্রায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়।

শরীরের পর্যাপ্ত ক্যালরির জন্য মাত্র দুটি মেডজুলই যথেষ্ট। এর কার্বহাইড্রেটের বিশাল অংশ হচ্ছে অর্গানিক শর্করা, যা দেহে প্রয়োজনীয় শক্তির ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে। মেডজুলে বিদ্যমান পুষ্টিকর ফাইবার ও প্রোটিন হজমের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। এতে আরও আছে পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ও আয়রনের মতো খনিজ পদার্থ।

এই উচ্চ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সম্পন্ন উপাদানগুলো অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। ফাইবার সামগ্রী রক্তে শর্করার মাত্রা বজায় রাখে ও ওজন ঠিক রাখার ক্ষেত্রে উপযোগী ভূমিকা পালন করে। আকার ও বাজারের পৌঁছানোর পূর্বে প্রক্রিয়াকরণের উপর ভিত্তি করে এই খেজুরের দামে যথেষ্ট তারতম্য হয়। এই পরিধি নিম্নে ৯২০-৯৬০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১০০০- ১৮০০ টাকা হয়ে থাকে।

মারিয়াম

প্রাথমিকভাবে ইরানে চাষকৃত এই খেজুর মাঝারি থেকে বড় আকারের হয়ে থাকে। ফিনিক্স ড্যাক্টাইলিফেরা প্রজাতি ভুক্ত গাছ থেকে উৎপন্ন এই খেজুর মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গলে যায়। প্রাকৃতিক শর্করার আধার এই ফল মানবদেহে শক্তি যোগানের একটি মূল্যবান উৎস।

পুষ্টি উপাদান হিসেবে হজম-সহায়ক ফাইবারের উপস্থিতি হজমে সহায়তা করে ও কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ অংশ নেয়। পাশাপাশি বিদ্যমান পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও আয়রনের মতো খনিজ উপাদানগুলো রক্তনালীগুলোকে শিথিল রাখে ও হাড়কে শক্তিশালী করে। বিভিন্ন স্থানীয় বাজারভেদে বর্তমানে মারিয়াম খেজুরের দাম ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত রাখা হচ্ছে।

খুরমা খেজুর

দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি খুরমা খেজুরের উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলোর মধ্যে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ারও ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। বাংলাদেশে খেজুরের এই জাতকে সাধারণত শুকনো খেজুর বলা হয়। বাজারজাত করার পূর্বে কড়া রোদে শুকানো হয় বিধায় এগুলো খাওয়ার জন্য উপযোগী গঠন ও মিষ্টি স্বাদ পায়।

শুকনো খেজুর কার্বোহাইড্রেট ও প্রাকৃতিক ফাইবারে সমৃদ্ধ, যা দেহে শক্তি যোগায় ও হজম এবং অন্ত্রের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখে। পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও আয়রনের মতো গুরুত্বপূর্ণ খনিজের উপস্থিতি থাকায় এগুলো হৃদরোগ, পেশীর নড়াচড়া ও রক্তে অক্সিজেন পরিবহনে অবদান রাখে। এ ছাড়াও এতে রয়েছে পরিশোধিত চিনি সমৃদ্ধ জৈব শর্করা, যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যের অধিকারি। সুতরাং নিত্য আহারে এই ফল রাখা মানে শরীরের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে মুক্তি পাওয়া। দেশের নানা স্থানের কাঁচা বাজারগুলোতে এগুলোর দাম প্রতি কেজিতে ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা। তবে প্রিমিয়াম জাতের মূল্য ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকাও ছাড়িয়ে যায়।

সুক্কারি

ক্যারামেল ও মধুর মিশ্রণযুক্ত স্বাদ ও সোনালী বর্ণযুক্ত সৌদি আরবের সুক্কারি সারা বিশ্বব্যাপি জনপ্রিয়। অধিকাংশ নরম খেজুরগুলোর মতো এটিও মুখে দিতেই ব্যতিক্রমি স্বাদে পুরো মুখ ভরে যায়। পুষ্টিগত দিক থেকে সুক্কারি দ্রুত শক্তিবর্ধক অর্গানিক শর্করায় ভরপুর। এতে থাকা ফাইবারগুলো পরিপাক সচল রেখে হজমের সুস্বাস্থ্যে অবদান রাখে।

খনিজ উপাদানগুলোর মধ্যে পটাসিয়ামের আধিক্য বেশি, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতার বিকাশ ঘটায়। এগুলোর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান শরীরকে প্রদাহ থেকে রক্ষা করে। মান ও জাতের ভিন্নতার উপর নির্ভর করে সুক্কারির প্রতি কেজির দাম ২৫০ থেকে ৬৩০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে।

মাবরুম

সৌদি আরবে চাষকৃত মাবরুম খেজুর বেশ লম্বাকৃতি ও লালচে-বাদামী রঙের হয়। এর আবরণটি বেশ দৃঢ় হয় ও অন্যান্য খেজুর থেকে এর মিষ্টতা কিছুটা কম। চিনি কম থাকলে মাবরুম হজম-সহায়ক ফাইবারে সমৃদ্ধ, যা পরিপাকতন্ত্রের যাবতীয় সমস্যা নিরসণে অংশ নেয়।

ফলটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন বি ৬ ও আয়রন সরবরাহ করে থাকে। পুষ্টি উপাদানগুলোর পরিমিত সমন্বয় হৃদরোগ, রক্ত, পেশী ও মস্তিষ্ক-জনিত স্বাস্থ্যঝুঁকিগুলো দূর করে। প্রতি কেজি ৪০০-৪৫০ টাকা। তবে সৌদিতে বাছাইকৃতগুলোর মূল্য ১২০০ টাকা পর্যন্ত রাখা হয়।

কালমি

সৌদি আরবের মদিনায় উৎপন্ন হওয়া এই খেজুরের আরেক নাম সাফাভি। আকারে মাঝারি থেকে লম্বা, রঙ কালো। বাহ্যিক আবরণ হাল্কা আর্দ্র ও নরম। এটি দ্রুত শক্তিবর্ধকের জন্য অপরিশোধিত শর্করা ও স্বাস্থ্যকর অন্ত্রের বিকাশে উপযোগী ফাইবারের যোগান দেয়।

খনিজ পদার্থের এই ভান্ডারে রয়েছে পটাসিয়াম, আয়রন ও ম্যাগনেসিয়ামের পরিমিত সমন্বয়। এগুলো রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, হৃদপিণ্ডের সুস্বাস্থ্য, পেশীর সচলতা, স্নায়ুর কার্যকারিতা ও হিমোগ্লোবিনের সঞ্চালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কালমির বর্তমান বাজারের দর কেজি প্রতি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকার মধ্যে।

আম্বার

ফিনিক্স ড্যাক্টাইলিফেরা গাছ ও মদিনায় উৎপন্ন খেজুরের এই জাতকে ‘আনবারা’ নামেও ডাকা হয়। মোটা খেজুরগুলোর গঠন একটু ব্যতিক্রম আকৃতির ও রঙে গাঢ় বাদামীর সঙ্গে থাকে কালচে আভার মিশ্রণ। আম্বারের প্রধান পুষ্টিগুনগুলোর মধ্যে রয়েছে— অপরিশধিত শর্করা ও ফাইবার, আয়রন, পটাসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম।

তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় আম্বার খেজুর রাখা মানে হজম, রক্তচাপ, পেশী ও হাড়ের সমুন্নত কার্যকারিতা বজায় রাখা। স্থানীয় বাজারে প্রাপ্যতা ও চাহিদার উপর ভিত্তি করে এগুলোর প্রতি কেজির মূল্য ৭০০-১৬০০ টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করে।

জাহেদী

হালকা সোনালী-বাদামী রঙের ও ডিম্বাকৃতির মাঝারি আকারের এই খেজুরের উৎপত্তিস্থল ইরাক। বাইরের বাদামের গন্ধ বিশিষ্ট আবরণটি আধা-শুষ্ক ও দৃঢ় এবং স্বাদ হাল্কা মিষ্টি।

জাহেদী খেজুর শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় হজমকারী ফাইবার, কার্বোহাইড্রেট, শর্করা, পটাসিয়াম ও সোডিয়াম সরবরাহ করে। এতে রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন বি৬, আয়রন, ফ্ল্যাভোনয়েড ও অ্যামিনো অ্যাসিড। এগুলো সক্রিয়ভাবে পরিপাক ক্রিয়া স্বাভাবিক রাখে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং রক্ত প্রবাহে অক্সিজেন পরিবহন বাড়ায়। বাজার প্রতি কেজির মূল্য ন্যূনতম ২২০-২৫০ টাকা।

দাব্বাস

একদম ছোট থেকে মাঝারি গড়নের গাঢ় বাদামী রঙের দাব্বাস খেজুর চাষের প্রধান অঞ্চল সংযুক্ত আরব আমিরাত। প্রায় সব ধরণের খেজুরের মতো এটিও সংগৃহীত হয় ফিনিক্স ড্যাক্টাইলিফেরা উদ্ভিদ থেকে।

এই ফলে আছে ফাইবার, ক্যালসিয়াম, আয়রন, পটাসিয়াম ও সেলেনিয়াম। পুষ্টি উপাদানগুলো সামগ্রিক ভাবে হজম, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া ও রক্তে অক্সিজেন পরিবহনে কার্যকরি অবদান রাখে। এই খেজুরের অ্যান্টি-ডিহাইড্রেশন, সোডিয়াম ও পটাসিয়ামের ভারসাম্য বজায় রাখার বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। এগুলোর মূল্য সাধারণত প্রতি কেজিতে কমপক্ষে ৪০০ থেকে সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা।

শেষাংশ

বিশ্বের নানা অঞ্চল থেকে উৎসরিত অনন্য স্বাদের এই ১০ রকম খেজুর রমজানে রোজাদারদের স্বাস্থ্যের সামগ্রিক উন্নতিতে অবদান রাখে। তন্মধ্যে কালো বর্ণের আজওয়া অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর। আকারে বড় ও সুমিষ্ট খেজুর হিসেবে স্বীকৃত মেডজুল ও আম্বার, অন্যদিকে নমনীয়তার দিক থেকে মারিয়াম খেজুর প্রসিদ্ধ।

দাব্বাসের ভেতরটাও একই রকম কোমল। দক্ষিণ এশিয়ার প্রসিদ্ধ খাবার খুরমা খেজুর, আর সুক্কারির জনপ্রিয়তা তার ক্যারামেল-সদৃশ স্বাদের জন্য। দীর্ঘক্ষণ মুখে রেখে সুঘ্রাণ সৃষ্টির জন্য মাবরুম বেশ উপযোগী। জাহেদীতে রয়েছে হালকা বাদামের স্বাদ, আর অন্যান্য খেজুরের তুলনায় অত্যধিক খনিজ উপদান মিলবে কালমি বা সাফাভিতে। সব মিলিয়ে রোজাকালীন আহার থেকে দীর্ঘ বিরতিতে এই খেজুরগুলো হতে পারে দেহের শক্তি সঞ্চয়ের উৎকৃষ্ট মাধ্যম।