লামিন, রাফিনিয়ার রেকর্ডের রাতে সবার আগে কোয়ার্টারে বার্সেলোনা


প্রথম লেগে একজন খেলোয়াড় কম নিয়ে প্রায় পুরো ম্যাচজুড়ে ভুগতে থাকার পরও কোনোমতে ১-০ গোলে জেতার পর ফিরতি লেগে যেন সব ক্ষোভ উগরে দিল বার্সেলোনা। তাতে পুড়ে অঙ্গার হয়ে শেষ ষোলো থেকে প্রথম দল হিসেবে বিদায় দিল বেনফিকা, আর সবার আগে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করল হান্সি ফ্লিকের শিষ্যরা।
কাতালুনিয়ার অলিম্পিক স্টেডিয়ামে মঙ্গলবার (১১ মার্চ) চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ ষোলোর ফিরতি লেগে পর্তুগিজ দলটিকে ৩-১ গোলে হারিয়েছে বার্সেলোনা। এর ফলে ৪-১ গোলের অগ্রগামিতায় শেষ আটে উঠেছে কাতালান জায়ান্টরা।
ম্যাচের সবগুলো গোলই এসেছে প্রথমার্ধে। বার্সার তিনটি গোল আসে ১১, ২৭ ও ৪২তম মিনিটে। এর মধ্যে প্রথম ও তৃতীয় গোলটি করেন রাফিনিয়া। আর বাকি গোলটি আসে লামিন ইয়ামালের পা থেকে।
অপরদিকে বেনফিকার একমাত্র গোলটি করেন নিকোলাস ওতামেন্দি।
এর ফলে নতুন বছরে অপরাজেয় যাত্রায় অব্যাহত রাখল বার্সেলোনা। টানা ১৭ ম্যাচ হারেনি দলটি।
ম্যাচজুড়ে এদিন মোট ২০টি শট নেয় বার্সেলোনা, যার প্রথমার্ধে নেওয়া ৬টি শট ছিল লক্ষ্যে। অপরদিকে, আটটি শট নিয়ে মাত্র দুটি লক্ষ্যে রাখতে পারে বেনফিকা। বল দখলের লড়াইয়েও ছিল বার্সেলোনার প্রত্যাশিত আধিপত্য। দলটির ৬৫ শতাংশ পজেশনের বিপরীতে বেনফিকার ছিল ৩৫ শতাংশ।
এদিন ম্যাচের শুরু থেকেই কেউ কাউকে ছেড়ে কথা না বলার ইঙ্গিত দিলেও প্রথম শটটি নেয় বার্সেলোনা। পেদ্রির বাড়ানো পাস ধরে ষষ্ঠ মিনিটে গোলে শট নেন লামিন, তবে সহজেই তা লুফে নেন বেনফিকা গোলরক্ষক আনাতোলি ত্রুবিন।
দশম মিনিটে লামিনের পাস ধরে বক্সের মাঝ থেকে লেভানডোভস্কির নেওয়া আরও একটি শট প্রতিহত করেন ত্রুবিন। তবে পরের মিনিটে আর জাল অক্ষত রাখতে পারেননি এই ইউক্রেনীয় গোলরক্ষক।
একাদশ মিনিটে ডান পাশ দিয়ে প্রতিপক্ষের কয়েক খেলোয়াড়কে ড্রিবল করে বক্সে ঢুকেই বিপরীত পাশ দিয়ে এগোতে থাকা রাফিনিয়াকে লক্ষ্য করে একটি নিখুঁত ক্রস বাড়ান লামিন। এরপর ট্যাপ-ইনে তা ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া রাফিনিয়ার জন্য ছিল জলের মতো সরল।
এগিয়ে যাওয়ার পর এক মিনিটও সেই ব্যবধান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় কাতালানরা। ৫৮ সেকেন্ডের মাথায় কর্নার থেকে আসা ক্রসে দারুণ একটি হেডারে লক্ষ্যভেদ করে বেনফিকাকে সমতায় ফেরান ওতামেন্দি।
চকিতে গোল হজম করে ধীর লয়ে খেলতে থাকে বার্সেলোনা। ঠান্ডা মাথায় আরও পরিকল্পিতভাবে প্রতিটি আক্রমণ শানাতে তাকে দলটি। এর ধারাবাহিকতায় ২৭তম মিনিটে ফের ম্যাচে এগিয়ে যায় তারা।
এবার ম্যাচের শুরু থেকেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে খেলতে থাকা লামিন দেখান প্রতিভার ঝলক। জুল কুন্দের দেওয়া পাস ধরে ডান পাশ দিয়ে বক্সের বাইরের কোণা থেকে শট বাঁকিয়ে নেন এই তরুণ। আর বল ঝাঁপিয়ে প্রতিহত করতে চাওয়া ত্রুবিনের হাতের সামান্য বাইরে দিয়ে গিয়ে জালে জড়িয়ে যায়।
এর ফলে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে এক ম্যাচে গোল ও অ্যাসিস্ট করার রেকর্ড গড়লেন লামিন। ১৭ বছর ২৪১ দিন বয়সে এই রেকর্ড গড়লেন তিনি। এর ফলে ২০১৪ সালে ১৭ বছর ২৬৭ দিন বয়সে বাসেলের হয়ে সুইস ফরোয়ার্ড ব্রিল এমবলোর গড়া রেকর্ড ভাঙলেন লামিন।
শুধু তা-ই নয়, চলতি মৌসুমে বার্সেলোনার জার্সিতে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে তার গোলসংখ্যা হয়েছে ১২টি। এছাড়া ১৭টি অ্যাসিস্ট করে মোট ৩৬ ম্যাচ ২৯ গোলে অবদান রেখেছেন এই প্রতিভাবান তরুণ।
দ্বিতীয়বার ম্যাচে এগিয়ে যাওয়ার পর পজেশন ধরে রাখায় আরও মনোযোগী হয় বার্সেলোনা, আর বিপদ আরও যাতে না বাড়ে, সেকারণে রক্ষণে মনোযোগ দেয় বেনফিকা।
তবে এরপরও শেষ রক্ষা হয়নি। ৪১তম মিনিটে ত্রুবিন লেভার আরও একটি শট ঠেকিয়ে দিলেও পরের মিনিটেই রাফিনিয়ার শট ঠেকাতে ব্যর্থ হন গোলমুখে একা থাকা এই গোলরক্ষক।
এ সময় দুর্দান্ত এক পাল্টা আক্রমণে উঠে প্রতিপক্ষের বক্সের বেশ বাইরে থেকে বাঁ পাশে রাফিনিয়াকে বল বাড়ান আলেহান্দ্রো বালদে। এরপর এগিয়ে গিয়ে উপরে উঠে আসা ত্রবিনকে পরাস্ত করেন ২৮ বছর বয়সী ব্রাজিলীয় উইঙ্গার।
এর ফলে টুর্নামেন্টে চলতি মৌসুমে ১০ ম্যাচে ১১ গোল ও ৪টি অ্যাসিস্ট করে মোট ১৫টি গোলে অবদান রাখলেন এই ব্রাজিলিয়ান। এতে করে দুর্লভ এক রেকর্ডে নিজের নাম উঠিয়েছেন তিনি।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এক মৌসুমে বার্সেলোনার তো বটেই যেকোনো দলের ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের মধ্যে সর্বোচ্চ (১১) গোল করার রেকর্ডটি নিজের করে নিয়েছেন রাফিনিয়া। এতদিন বার্সেলোনার জার্সিতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ১০ গোল করার রেকর্ড ছিল রিভালদো (১৯৯৯/২০০০) ও নেইমারের (২০১৪/১৫)। সেই রেকর্ড ছোঁয়ার পর দ্বিতীয় গোলের মাধ্যমে সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন রাফিনিয়া।
এছাড়া সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ১৯টি অ্যাসিস্টের পাশাপাশি ২৭টি গোল করলেন এই ফরোয়ার্ড। অর্থাৎ, ৪১ ম্যাচে ইতোমধ্যে মোট ৪৬ গোলে অবদান রেখে ফেললেন তিনি।
এরপর ৩-১ গোলে এগিয়ে থেকেই বিরতিতে যায় ফ্লিকের শিষ্যরা। আর অগ্রগামিতায় তা হয় ৪-১।
প্রথমার্ধে ৬৬ শতাংশ সময় বলের পজেশন রেখে বার্সেলোনার ১২টি প্রচেষ্টার ৬টি লক্ষ্যে ছিল, যার তিনটিতে সফল হয় দলটি। অন্যদিকে, রক্ষণ সামলাতে ব্যস্ত বেনফিকা প্রথমার্ধে গোল পাওয়া ওই একটিই শটই নিতে পারে।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইহিতাসে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ-সংখ্যক গোল করা ফুটবলার এখন রাফিনিয়া। তবে এই সংখ্যা সামনের ম্যাচগুলোতে আরও বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকবে তার সামনে। ছবি: এক্স
দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নেমেই চতুর্থ গোলটি পেতে পারত বার্সেলোনা।, তবে ফ্রি কিক থেকে দূরের পোস্ট বরাবর আসা ক্রসটি হেডারে কাছ থেকেও জালের বাইরের পাশে মারেন রোনালদ আরাউহো।
পরের মিনিটে অবশ্য একটি গোল পেয়ে গিয়েছিল বেনফিকা, তবে বার্সার অফসাইড ফাঁদ এড়াতে ব্যর্থ হয় দলটি।
এরপর ৬৫তম মিনিটে আরও একটি গোল করার দারুণ একটি সুযোগ তৈরি করেন ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং ও কুন্দে। কিন্তু গোলমুখে ডান পাশ থেকে বিপরীত দিকে রাফিনিয়ার উদ্দেশে বাড়ানো কুন্দের নিচু ক্রসটিতে পা দিয়ে সযোগ নষ্ট করেন সেই ডি ইয়ংই।
এরপর থেকে বেশকিছু সময় বলের ওপর দখল রেখে বার্সেলোনাকে কোণঠাঁসা করে রাখে বেনফিকা। এ সময়ে একের পর এক গোলের সুযোগ তৈরি করতে থাকে তারা। তবে বার্সার ডিফেন্ডার ও মিডফিল্ডারদের চাপে তাদের পক্ষে ঠিকঠাকভাবে গোলে শট নেওয়াই হয়ে উঠছিল না।
শেষের দিকে আরও একবার ব্যবধান বাড়ানোর চেষ্টা করে বার্সেলোনার খেলোয়াড়রা। তবে আর গোল করতে না পারায় ৩-১ গোলে এবং অগ্রগামিতায় ৪-১ ব্যবধানে শেষ হয় ম্যাচ।
কোয়ার্টার ফাইনালে বুধবার রাতে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড ও লিলের মধ্যকার ম্যাচটিতে জয়ী দলের অপেক্ষায় থাকবে বার্সেলোনা। আগামী ৮ এপ্রিল ঘরের মাঠে কোয়ার্টারের প্রথম লেগ খেলবে ফ্লিকের দল।