‘মুক্তিযুদ্ধ, মুজিব ও বাংলাদেশ ২.০’ নিয়ে গালিবের ৫ কথা
‘মুক্তিযুদ্ধকে কারো লকারের ৮৩২ ভরি স্বর্ণ বানানোর মেশিনে পরিণত করার রাজনীতি করতে দেওয়া যাবে না’ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. মির্জা গালিব।
শনিবার (৬ ডিসেম্বর) ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এ মন্তব্য করেন।
এদিন দুপুরে প্রকাশিত ওই পোস্টে তিনি ৫টি বিষয়ে বিস্তারিত মতামত তুলে ধরেন।
ফেসবুক পোস্টে ড. গালিব বলেন—
১। আমাদের জাতীয় আবেগের কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধ। এই আবেগকে সামনে রেখে শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে প্রাসঙ্গিক রাখার একটি রাজনৈতিক কৌশল বহুদিন ধরে ব্যবহৃত হয়েছে। গত ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার প্রতিটি স্তরেই ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কে রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছিল। ফলে আগস্টের বিদ্রোহে ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ও পরে ধানমন্ডি ৩২–এ হামলা চালিয়েছে। যখন ‘জয় বাংলা’ বা ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান মানুষকে দমন ও ভয় দেখানোর হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন কারও কাছ থেকেই সেই স্লোগানের প্রতি শ্রদ্ধা প্রত্যাশা করা অবাস্তব।
২। আওয়ামী লীগ যে ‘মুক্তিযুদ্ধ-কেন্দ্রিক’ ইতিহাস তুলে ধরে— যা অনেকাংশে ভারতকেন্দ্রিক বয়ানও— সেখানে ১৯৭১-এর আগে বাঙালির রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে প্রায় অস্বীকার করা হয়। শেখ মুজিব ছাড়া অন্য কোনো নেতাকে (এমনকি ভাসানী বা তাজউদ্দীনকেও) সেই ইতিহাসে স্থান দেওয়া হয় না। এই দলীয় ব্যাখ্যার ওপর দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ, বাম এবং কিছু সেকুলার গোষ্ঠী যেভাবে রাজনীতি তৈরি করেছে, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাসিস্ট ও ইসলামোফোবিক রূপ ধারণ করেছে। বাংলাদেশের সমাজে যে প্রজন্মগত পরিবর্তন ঘটছে, তাতে এ ধরনের ইতিহাস ও রাজনীতির অবসান অনিবার্য।
৩। বাঙালি মুসলমানদের ইতিহাস বহু শতাব্দীর। দিল্লির শাসনের বিরোধিতা করে স্বাধীন সুলতানি আমল, ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্তির সংগ্রাম, ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের সৃষ্টি, ১৯৭৫-এর সিপাহী–জনতার আন্দোলনে বহুদলীয় রাজনীতির প্রত্যাবর্তন, ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ২০২৪-এর গণজাগরণ— সবকিছু মিলিয়েই আমাদের রাজনৈতিক যাত্রা। ৪৭–৭১–২৪— এই ধারাবাহিকতার ভিতেই বাঙালি ও মুসলিম— দুটো পরিচয় বহন করেই দেশকে সামনে এগোতে হবে।
৪। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে শেখ মুজিব একদিকে গুরুত্বপূর্ণ নায়ক, অন্যদিকে অনেক বিতর্কেরও অংশ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় রঙে ঢেকে তাকে একক ‘কাল্ট ফিগার’ বানিয়ে যে ফ্যাসিবাদী কাঠামো প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। এই প্রকল্প বাংলাদেশের মাটিতে আর কখনো সফল হবে না— এতে নিশ্চিত থাকা যায়।
৫। সবাইকে বিজয় মাসের শুভেচ্ছা। মুক্তিযুদ্ধ কোনো দল বা গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। এটি আমাদের সবার— ‘পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন’ -এর মতোই। এই যৌথ ঐতিহ্যকে ছেড়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যক্তিস্বার্থ বা সম্পদ বাড়ানোর যন্ত্র বানানোর রাজনীতি আর মেনে নেওয়া যাবে না।
বিপি/ এএস
