সময় চলে এসেছে, দ্রুতই দেশে ফিরে আসবো: তারেক রহমান


বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর কোনো গণমাধ্যমে মুখোমুখি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে লন্ডন থেকে তার দেশে ফেরা, আগামী নির্বাচনে দলের কৌশল, আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও তাদের নেতাকর্মীদের বিচার, বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রীক রাজনীতিসহ সমসাময়িক নানা বিষয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরেছেন তারেক রহমান। ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ওঠা চাঁদাবাজি-দখলের মতো নানা অভিযোগ নিয়েও খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি।
দেশে ফেরার প্রশ্নে যা বললেন তারেক
বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে গেছে এবং অনেকের ধারণা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আপনি (তারেক রহমান) দেশে এসে স্বশরীরে দলের নেতৃত্ব দেবেন। গত এক বছরে যে প্রশ্নটা বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে এবং এখনো আসছে যে আপনি এখনো দেশে ফেরেননি কেন। কেন আপনি এখনো দেশে ফেরেননি?
বিবিসি বাংলার করা এমন প্রশ্নের জবাবে তারেক রহমান বলেন, কিছু সংগত কারণে হয়তো ফেরাটা হয়ে উঠেনি এখনো। তবে সময় তো চলে এসেছে মনে হয়। ইনশাআল্লাহ দ্রুতই ফিরে আসবো।
কবে নাগাদ দেশে ফিরতে পারেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তারেক রহমান বলেন, দ্রুতই মনে হয়। দ্রুতই ইনশাআল্লাহ।
নির্বাচনের আগেই দেশে ফেরার সম্ভাবনার বিষয়ে সাক্ষাৎকারে জানতে চাইলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, রাজনীতি যখন করি, আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে স্বাভাবিক, নির্বাচনের সঙ্গে রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক কর্মীর একটি ওতপ্রত সম্পর্ক। কাজেই যেখানে একটি প্রত্যাশিত, জনগণের প্রত্যাশিত নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনের সময় কেমন করে দূরে থাকবো? আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে, ইচ্ছা থাকবে, আগ্রহ থাকবে সেই প্রত্যাশিত যে নির্বাচন জনগণ চাইছে। সেই প্রত্যাশিত নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হবে জনগণের সঙ্গে জনগণের মাঝেই থাকবো ইনশাআল্লাহ।
দেশে ফেরার বিষয়ে নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে করা প্রশ্নের জবাবে তারেক বলেন, বিভিন্ন রকম শঙ্কার কথা তো আমরা অনেক সময় বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে তো শুনেছি। সরকারেরও বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকেও তো অনেক সময় অনেক শঙ্কার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে, বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে।
চাঁদাবাজি-দখলের অভিযোগ প্রসঙ্গে যা বললেন
৫ আগস্টের পরে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এরই মধ্যে চাঁদাবাজি বা দখলের মতো নানা অভিযোগ এসেছে। আপনাদের দল থেকে অনেককে বহিষ্কার করা হয়েছে এটা ঠিক, আবার একই সাথে এটাও ঠিক যে এই অভিযোগগুলো কিন্তু বারবার আসছে। তো এটা থামানো যাচ্ছে না কেন?
বিবিসি বাংলার করা এমন প্রশ্নের উত্তরে তারেক রহমান বলেন, ‘আপনার প্রতি সম্মান রেখে আপনার সাথে এগ্রিও (একমত) যেমন করবো, আবার এখানে অন্য একটি বিষয় আমি তুলে ধরতে চাইবো। এর মধ্যে নিশ্চয়ই আপনারা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখেছেন যে, প্রায় ৭০০০ এর মতন আমাদের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আমরা কিছু সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। কিন্তু এই ৭০০০ এর সবাই কিন্তু আপনি যে অভিযোগ করলেন এই অভিযোগের সঙ্গে জড়িত নয়। এর মধ্যে এমন অনেক বিষয় আছে যারা অন্য সাংগঠনিক বিষয়ের সঙ্গে জড়িত। এটি গেল একটি বিষয়।’
তারেক রহমান বলেন, ‘দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে আমাদের কাছে এরকম যখন অনেক অভিযোগ এসেছে। আমরা অভিযোগগুলো তদন্ত করেছি। তদন্ত করার পরে আমরা বেশ কিছু বিষয় পেয়েছি। যেমন আমি দুই-একটি উদাহরণ দিয়ে আপনাকে বলি। যেমন- ধরেন দুই ভাই। কোনো একটি এলাকায় দুই ভাই আছে। দুই ভাইয়ের মধ্যে পারিবারিক সম্পত্তি, সহায় সম্পত্তি নিয়ে একটি সমস্যা আছে। এক ভাই বিগত যে স্বৈরাচার পলাতক স্বৈরাচার তাদের কারো সঙ্গে এক ভাইয়ের খুব ভালো সম্পর্ক। তার ফলে স্বৈরাচারের যে দোসর যার সঙ্গে এই এক ভাইয়ের সম্পর্ক, সে তার ইনফ্লুয়েন্সটি ব্যবহার করে অন্য ভাইয়ের সম্পত্তিও জোর করে দখল করে রেখেছে। এখন ৫ তারিখের পরে যে ভাই স্বৈরাচারের দোসরকে ব্যবহার করেছিলো সেই দোসরও তো পালিয়ে গিয়েছে। তো স্বাভাবিকভাবেই সেই ভাই এখন আর শেল্টার পাচ্ছে না।’
তো অন্য যার সম্পত্তি জোর করে রেখে দিয়েছিল অন্য ভাইটি। সেই অন্য ভাইটি স্বাভাবিকভাবে তার হক আদায় করতে গিয়েছে বা হক বুঝে নিতে গিয়েছে। এখন এক্সিডেন্টলি বা ইনসিডেন্টলি যে ভাই এতদিন বঞ্চিত ছিলো সম্পত্তি থেকে সেই ভাই বিএনপি করে। বিএনপির কোনো একজন কর্মী বা স্ট্রং সমর্থক বা নেতা যেটাই হোক। চাপিয়ে দিল অভিযোগ তুলে দিল অন্যজন যে বিএনপি দখল করতে গিয়েছে। এরকম ঘটনা আমরা প্রচুর পেয়েছি।
বিবিসি বাংলাকে তারেক রহমান আরও বলেন, আবার আরেকটি আমি উদাহরণ দেই যা সত্য, যা বাস্তব। স্বৈরাচারের সময় সারা বাংলাদেশে আমাদের প্রায় ৫০ লাখের বেশি নেতাকর্মীর নামে বিভিন্ন রকম গায়েবি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছিল। আমাদের বহু নেতাকর্মী তাদের ঘর বাড়িতে থাকতে পারতো না। তাদের বিভিন্নভাবে পালিয়ে থাকতে হতো। বিভিন্নভাবে সরে থাকতে হতো। এই সুযোগে স্বৈরাচার তাদের ব্যবসা বাণিজ্য, দোকান-পাট, ঘর বাড়ি, জমি জমা পুকুর দখল করে নিয়েছিল। ৫ তারিখে যখন স্বৈরাচার পলাতক হয়ে গিয়েছে, পালিয়ে গিয়েছে- তখন স্বৈরাচারের যারা দখল করেছে তারাও সাথে সাথে পালিয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের নেতাকর্মীরা তাদের নিজেদের যেগুলি বৈধ সম্পত্তি, পৈত্রিক সম্পত্তি সেগুলো আবার ফিরে পেতে গিয়েছে। তখন আবার কিছু সংখ্যক লোক প্রচার করেছে যে বিএনপির লোকজন দখল করতে গিয়েছে এরকম ঘটনা প্রচুর ঘটেছে।
‘আপনি যেই কথাটি বললেন সেরকমও কিছু ঘটেছে। সে কারণেই আমরা আমাদের অবস্থান থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। তবে এখানে আমার একটি প্রশ্ন আছে, যে প্রশ্নটি আমরা পাবলিকলিও করেছি। দেখুন আমরা একটি রাজনৈতিক দল। কিছু ঘটনা ঘটেছে। আমরা অস্বীকার করছি না। ঘটেছে যেমন, আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি তাদের বিরুদ্ধে।
যতটুকু আমরা জেনেছি, যতটুকু আমরা তদন্তের পরে পেয়েছি, যখন সত্যতা পেয়েছি, আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। কিন্তু পুলিশিং করা তো আমাদের কাজ না। রাজনৈতিক দলের কাজ অবশ্যই পুলিশিং করা না। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কখনো বলিনি সরকারকে যে, অমুককে ধরতে পারবে না, তমুককে ধরতে পারবে না, এই করতে পারবে না ওই কথা। আমরা কিন্তু কখনো বলিনি। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে যাদের কাজ পুলিশিং করা তারা কেন তাদের কাজটি করছে না। তারা কেন তাদের কাজে ব্যর্থ এটি আমাদের প্রশ্ন ‘
দখলদারি, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা আছে কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে তারেক রহমান বলেন, অবশ্যই। আমি তো আগেই বলছি পুলিশিং তো রাজনৈতিক দলের কাজ না, পুলিশিং করার দায়িত্ব সরকারের।
আগামী নির্বাচনে বিএনপি যদি সরকার গঠন করে সেক্ষেত্রে দলের নেতাকর্মী বা আপনার দলের নামে কোনো চাঁদাবাজি বা দখল এ ধরনের কিছু কেউ সেটা করতে পারবে না, কারণ তখন যেহেতু আপনারা সরকারে থাকবেন?
এমন প্রশ্নের উত্তরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ইয়েস, পুলিশ পুলিশের কাজ করবে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আইনশৃঙ্খলার কাজ করবে। বিএনপি ইনশাল্লাহ সরকার গঠন করলে আমার দলের কোনো নেতাকর্মী তখনো যদি এরকম কোনো অনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত হয় আমরা দলের অবস্থান থেকে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেব। দল তার পক্ষে থাকবে না, দলের অবস্থান এবং দেশের আইন অনুযায়ী। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব যাদের, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তারা তাদের কাজ করবে, সিম্পল। এখানে দুইয়ে দুইয়ে চারের মতন ব্যাপার।
গুম-খুনের জবাব আ’লীগকে, ৭১’র জবাব জামায়াতকে দিতে হবে
আওয়ামী লীগ ও জামায়াত প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলার প্রশ্নের জবাবে তারেক রহমান বলেন, ২০২৪ সালে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ যেসব হত্যা করেছে দেশ স্বাধীনের পর যখন তারা সরকার গঠন করেছিল ক্ষমতায় ছিল তখনও তারা লুট করেছে, খুন-গুম করেছে।
তিনি বলেন, বিগত ১৭ বছর গুম খুন যারা করেছে, এর জবাব যে রকম তাদেরকেই দিতে হবে, ঠিক একইভাবে ৭১ সালে কোনো রাজনৈতিক দল যদি তাদের কোনো বিতর্কিত ভূমিকা থেকে থাকে, তাহলে তাদের জবাব তারাই দেবেন। ওটা তো আর আমি দিতে পারবো না। আমারটা আমি দিতে পারবো। অন্যেরটা তো আমি দিতে পারবো না।
বিএনপি বহুদলীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস করে বলেও মন্তব্য করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, দেশের যে আইন-কানুন আছে তার ভেতরে থেকে যারা রাজনীতি করবে, অবশ্যই সবার রাজনীতি করার অধিকার আছে। এবং আমরা তো চাই সবাই রাজনীতি করুক। বহুদলীয় রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি।