এ কেমন ব্যবস্থা, এ কেমন আমেরিকা?

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট ডেস্ক
প্রকাশিত:০৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:০২ পিএম
এ কেমন ব্যবস্থা, এ কেমন আমেরিকা?
ছবি: সংগৃহীত

আমেরিকার লাখ লাখ মানুষ যখন প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন টেসলার শেয়ারহোল্ডাররা সিইও ইলন মাস্ককে এক ট্রিলিয়ন ডলারের এক নজিরবিহীন প্যাকেজ অনুমোদন করেছে। এক ব্যক্তির অসীম সম্পদ ও কোটি মানুষের দারিদ্র্যের এই সুস্পষ্ট বৈপরীত্য, আমেরিকার আয়-বৈষম্যের নগ্ন চিত্র উন্মোচন করে দিয়েছে।

ইরানি সংবাদ সংস্থা ফার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের নভেম্বরে আমেরিকা তার অন্যতম প্রকট অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র প্রত্যক্ষ করল, যখন টেসলার শেয়ারহোল্ডাররা ৭৫ শতাংশের বেশি ভোটে ইলন মাস্কের জন্য এক ট্রিলিয়ন ডলারের এক বিশাল ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ অনুমোদন করে।

এই প্যাকেজের লক্ষ্য টেসলার বাজারমূল্যকে ৮.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা, লাখ লাখ হিউম্যানয়েড রোবট ও স্বয়ংচালিত সাবস্ক্রিপশন বিক্রি করা ইত্যাদি।

এদিকে এই অর্থ অনুমোদনের ফলে মাস্কের সম্পদ এখন প্রায় ৪৭৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। যা তাকে বিশ্বের প্রথম ট্রিলিয়নিয়ার হওয়ার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

যদিও মাস্ক কোনো নির্দিষ্ট বেতন-ভাতা নেন না; তিনি শুধু এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যগুলো অর্জিত হলে অতিরিক্ত এক ট্রিলিয়ন ডলারের শেয়ার পাবেন, যা কোম্পানিতে তার মালিকানা ১৩ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে উন্নীত করবে।

টেসলার বোর্ড অব ডিরেক্টরস এই সিদ্ধান্তকে ‘মাস্কের প্রতিভা ধরে রাখার’ উপায় হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত আসে এমন এক সময়ে, যখন লাখ লাখ মার্কিন নাগরিক খাদ্যসংকটে ভুগছে।

সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ৪৭ মিলিয়ন মানুষ প্রতিদিন পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে রয়েছে। যার মধ্যে ৪২ মিলিয়নের বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীন পরিবারে বাস করে। এই তিক্ত বৈপরীত্য শুধু একটি সংবাদ বা ঘটনা নয়, বরং বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে আয়-বৈষম্যের ক্রমবর্ধমান চিত্র।

আমেরিকার আয়-বৈষম্য দীর্ঘদিন ধরে একটি কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে স্বীকৃত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা আরও দ্রুত বেড়েছে। দেশটিতে আয়-বৈষম্যের পরিমাপক ‘জিনি সহগ’ (Gini Coefficient) ২০২৫ সালে ০.৪২-এ পৌঁছেছে। এটা দেখায় যে সম্পদ অতিরিক্তভাবে ধনীদের হাতে কেন্দ্রীভূত। এই সূচক ০ (সম্পূর্ণ সমতা) থেকে ১ (সম্পূর্ণ বৈষম্য) পর্যন্ত মাপে এবং আমেরিকার মান উন্নত দেশগুলোর গড় (প্রায় ০.৩০) এর চেয়ে অনেক বেশি। ১৯৮০-এর দশকে এটি ছিল ০.৩৮।

যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারি ব্যুরো ও বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে এই হার ছিল ০.৪১ এবং পূর্বাভাস বলছে- এটি আরও বাড়বে।

এই বৃদ্ধির মূলে রয়েছে নিওলিবারেল অর্থনৈতিক নীতিতে; ধনীদের ওপর কর কমানো, শ্রম ইউনিয়নগুলোর দুর্বলকরণ এবং প্রযুক্তি বিনিয়োগে কেন্দ্রীভূত হওয়া। যা ন্যায়সঙ্গত বন্টনের পরিবর্তে মুনাফা অভিজাতদের পকেটে ঢেলে দেয়।

যেখানে ২০০৯ সাল থেকে ন্যূনতম মজুরি অপরিবর্তিত, সেখানে মাস্কের মতো বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ প্রযুক্তি শেয়ারের উত্থানে বিস্ফোরকভাবে বেড়েছে।

এখন টেসলার এই পুরস্কার সেই বৈষম্যকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সমর্থকদের যুক্তি, মাস্ক ‘লক্ষ্য পূরণ না করলে কিছুই পাবেন না’, তাই কোম্পানির সফলতা মানে শেয়ারহোল্ডারদের মুনাফা।

তবে সমালোচকদের মতে, এটি মূলত ‘বৈধ ডাকাতি’। কারণ এমনকি যদি মাস্ক কয়েকটি লক্ষ্যই অর্জন করেন, তবুও তিনি শত শত বিলিয়ন ডলার পাবেন, যেখানে টেসলার শ্রমিকদের বার্ষিক আয় মাত্র ২০ থেকে ৩০ হাজার ডলার। আর তারা ৩৪ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি ও খাদ্যদ্রব্যের দামের বৃদ্ধির সঙ্গে সংগ্রাম করে চলেছেন।

এছাড়াও মাস্কের এই পুরস্কারের পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির বাজেটের চেয়েও বেশি। এটি যেমন উচ্চাভিলাষী উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা (যেমন- এক মিলিয়ন Optimus রোবট তৈরি) নির্ধারণ করেছে, তেমনি এর ঝুঁকিও সমাজের কাঁধে। টেসলার ব্যর্থতা হাজারো জনের চাকরি নষ্ট করতে পারে। বিপরীতে সফলতা মাত্র কয়েকজনের হাতে আরও বেশি সম্পদ কেন্দ্রীভূত করবে।

এই জাঁকজমকের বিপরীতে রয়েছে ৪২ মিলিয়ন ক্ষুধার্ত আমেরিকান। এর মধ্যে ১৪ মিলিয়ন শিশু যা গত দশকের সর্বোচ্চ।

২০২০ সাল থেকে খাদ্যদ্রব্যের ২০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি, সেবা খাতে গোপন বেকারত্ব এবং খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির বাজেট কাটছাঁটই এর প্রধান কারণ।

আরকানসাসের মতো রাজ্যে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হার ১৮.৯ শতাংশ এবং কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিনো সম্প্রদায়ে তা ৬০ শতাংশেরও বেশি। এই ক্ষুধা কেবল স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি নয়, বরং দারিদ্র্যের চক্রও অব্যাহত রাখে।

যখন মাস্ক তার রোবট দিয়ে ‘বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের অবসান’ নিয়ে কথা বলেন, তখন লাখ লাখ আমেরিকান খাদ্য কুপনের ওপর নির্ভরশীল।তবে ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি খাদ্য সহায়তা বাজেট কমিয়ে দিয়েছে। এই বৈপরীত্য আমেরিকার অর্থনৈতিক মডেল সম্পর্কে গভীর শিক্ষা দেয়।

০.৪২ জিনি সূচক কেবল বৈষম্যের মাপ নয়, বরং এর সামাজিক পরিণতিও প্রকাশ করে অপরাধ, বর্ণগত উত্তেজনা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি।

উপরন্তু শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদিত মাস্কের এই ট্রিলিয়ন ডলারের পুরস্কার দেখায় যে, ‘শেয়ারহোল্ডার মুনাফা’ সামাজিক ন্যায়বিচারের চেয়ে অগ্রাধিকার পায়।

কিন্তু এই মডেল কি টেকসই? ইতিহাস বলে, চরম বৈষম্য- হয় বিপ্লব, নয়তো সংস্কারে শেষ হয়। উদাহরণস্বরূপ- ২০১১ সালের 'Occupy Wall Street' আন্দোলন ছিল ‘১ শতাংশের’ বিরুদ্ধে। আর আজ বার্নি স্যান্ডার্সের প্রস্তাবিত ‘ধনসম্পদ কর’-এর মতো নীতির প্রতি নতুন করে সমর্থন বাড়ছে।

পরিশেষে বলা যায়, মাস্কের এক ট্রিলিয়ন ডলারের পুরস্কার এবং ৪২ মিলিয়ন মানুষের ক্ষুধা নিয়ে আমেরিকায় আয়ের বৈষম্যের তীব্রতা পরিবর্তনের জন্য একটি আহ্বান। রাজনীতিবিদদের করের সমতা, মজুরি বৃদ্ধি এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগের ওপর ফোকাস করতে হবে। এই সংস্কার ছাড়া, আমেরিকা আরও বেশি বৈপরীত্যের দেশে পরিণত হবে।