নোটিফিকেশনের ভিড়ে নিঃশব্দে ডুবে যায় মনের শান্তি

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট প্রতিবেদক
প্রকাশিত:২২ এপ্রিল ২০২৫, ১১:১৫ এএম
নোটিফিকেশনের ভিড়ে নিঃশব্দে ডুবে যায় মনের শান্তি
ছবি : সংগৃহীত

এমন এক সময় ছিল যখন সকাল শুরু হতো পাখির ডাক আর নিজের ভাবনায়। এখন? ঘুম ভাঙে একের পর এক টুংটাং শব্দ, ভাইব্রেশন আর রঙিন স্ক্রিনে ঝলমলে এক ‘ডিজিটাল দুনিয়া’র ডাকে। সবকিছু এতটাই জোরে চিৎকার করে, যে নিজের মনের কণ্ঠস্বরটাই চাপা পড়ে যায়। নীরবতার দাম হারিয়েছে, আর বদলে গেছে বিশ্রামের সংজ্ঞা।

ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই হাত চলে যায় ফোনে। ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটক- নতুন কী এলো? কে কী বলল? কে দিল লাইক? দিন শুরু হয় স্ক্রিনে, আর রাত শেষ হয় সেই স্ক্রিনের আলোয়। অথচ এই সারাদিনের নোটিফিকেশনের ভিড়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায় নিজেকে বোঝার সময়টা। হারিয়ে যায় মনের শান্তি।

আমরা এক ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা, যেখানে প্রতি সেকেন্ডে বাজে নতুন নোটিফিকেশন, চোখে পড়ে নতুন কারোর ‘পারফেক্ট’ জীবন। অথচ তার পেছনে লুকিয়ে থাকে এক গভীর নিঃসঙ্গতা; যা বলি না, ভাবি শুধু। তবে এই ঝলকানির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক নিঃশব্দ ব্যাধি; মানসিক চাপ, আত্মমূল্যবোধের সংকট আর গভীর বিষণ্ণতা। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম, যারা প্রতিনিয়ত ‘ভাইরাল’ হওয়ার দৌড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে।

দিন শেষে কতটা ভালো ছিলাম; এটা আর কেউ মনে রাখে না, এখন শুধু মনে রাখে কে কতটা ভাইরাল হলো। মন চায় একটু নিস্তব্ধতা, একটা নিঃশ্বাস যেখানে নিজের মতো করে ভাবা যায়। কিন্তু সেই মুহূর্তটাও যেন খুঁজে পাওয়া যায় না, কারণ ঠিক তখনই টুংটাং করে জানান দেয় আরও একটি নোটিফিকেশনের।

ভাইরাল হবার অসুস্থ প্রতিযোগিতা
বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভাইরাল হবার এক অদ্ভুত তাড়া কাজ করছে। রিল বানিয়ে রাতারাতি ফেম পাওয়ার আশায় সময়, শ্রম এমনকি নিজেকে হারানোর মতো অবস্থাও তৈরি হয়।

এই চাপ এক ধরনের ‘ডোপামিন হাই’ এর মতো কাজ করে। লাইক, কমেন্ট, শেয়ার এগুলো একধরনের ক্ষণস্থায়ী সুখ দেয়। কিন্তু পরে তৈরি হয় এক শূন্যতা। একটা রিল ভাইরাল না হলে, একটা পোস্টে লাইক কম পড়লেই মনে অশান্তি শুরু হয়।

ভাইরালের পেছনে কেন ছুটছে সবাই?
সোশ্যাল মিডিয়ার একটা বড় চালিকাশক্তি হলো ‘ভিউ’ আর ‘লাইক’। অ্যালগরিদম এমনভাবে সাজানো, যেখানে জনপ্রিয়তা মানে সাফল্য এবং অপ্রকাশিত থাকা মানে গুরুত্বহীন। এই চাপে পড়ে এখন অনেক তরুণ-তরুণী ‘ভাইরাল কনটেন্ট’ বানানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। টিকটক, রিলস, ইউটিউব শর্টস-সব জায়গায় চলছে সেলফ ব্র্যান্ডিংয়ের চেষ্টা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে প্রতি চারজনে একজন মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় ভুগছেন। এর অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে এসেছে অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার।

একটা গবেষণা বলছে, দিনে ২ ঘণ্টার বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাড়ে উদ্বেগ, তৈরি হয় হীনমন্যতা এবং কমে আত্মমর্যাদাবোধ।

সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই দেখা যায়, কেউ ঘুরতে গেছেন, কেউ দামি কিছু কিনেছে আবার কেউবা আছেন পারফেক্ট রিলেশনশিপে; যা দেখে মনে হয়, আমরা পিছিয়ে আছি। অথচ বাস্তবতা খুব ভিন্ন। সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ নিজের জীবনের কেবল ভালো দিকটাই দেখায়- কান্না, ক্লান্তি, ব্যর্থতা এসব থাকে না সেখানে।

বাস্তবতা বনাম ফিল্টার করা জীবন
সোশ্যাল মিডিয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো-বাস্তবতা বিকৃতি। একটি ছবি পোস্ট করার আগে ১০টা ছবি তোলা হয়, একগাদা ফিল্টার বসানো হয়, ক্যাপশনে যোগ হয় কৃত্রিম সুখ। এসব দেখে অন্যরা মনে করে, ‘সবাই ভালো আছে, শুধু আমি নেই।’ এই তুলনার সংস্কৃতি থেকেই জন্ম নেয় ‘ফোমো’ (Fear of Missing Out)। নিজের জীবনকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করে আমরা ভুলে যাই পেছনের গল্পটা।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাডিকশন ব্যাপক হারে বেড়েছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, স্ন্যাপচ্যাট, ইউটিউব ইত্যাদিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটে। ফলে কমে মনোযোগ, বাড়ে একাকীত্ব ও হতাশা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্কুল ও কলেজপড়ুয়া অনেকেই এখন ‘ফোমো’ নামক মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। বন্ধুদের পোস্ট দেখে মনে হয় তারা পিছিয়ে পড়ছে। এই অনুভূতি দীর্ঘমেয়াদী হতাশা আর বিষণ্ণতায় পরিণত হতে পারে।

লাইক মানেই ভালোবাসা নয়
‘লাইক’ আর ‘কমেন্ট’ যেন নতুন প্রজন্মের আত্মবিশ্বাসের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই ডিজিটাল স্বীকৃতি না পেলে অনেকেই হয়ে পড়ছে হতাশ। অনেক সময় দেখা যায়, কেউ একটি ছবি বা ভিডিও পোস্ট করেছে, কিন্তু প্রতিক্রিয়া কম—সেই হতাশা থেকে মুছে ফেলছে পোস্ট, আবার কখনো নিজের গুরুত্ব নিয়েই সংশয়ে পড়ে যাচ্ছে।

নিঃশব্দ এক মাদকতার নাম সোশ্যাল মিডিয়া
বর্তমানে ‘ডোপামিন হাই’ (আমাদের মস্তিষ্ক অতিরিক্ত ডোপামিন নামক এক ধরনের ‘সুখ হরমোন’ নির্গত করে, যার ফলে আমরা হঠাৎ করে খুব আনন্দ, উত্তেজনা বা সন্তুষ্টি অনুভব করি) নামে নতুন একধরনের আসক্তি তৈরি হয়েছে । প্রতি স্ক্রলেই মস্তিষ্কে ক্ষণস্থায়ী আনন্দের অনুভব হয়, যার নাম ডোপামিন রিলিজ। এভাবে মস্তিষ্ক এই স্রোতে আসক্ত হয়ে পড়ে। যখন এই ডোপামিন আসে না, তখন শুরু হয় হতাশা, খালি খালি লাগা, একাকীত্ব।

বিশেষজ্ঞরা এটাকে বলেন ‘ডিজিটাল ডিপ্রেশন’। চোখের সামনে কেউ হাসছে, নাচছে, ঘুরছে-আর আপনি শুধু দেখছেন। কিন্তু নিজের জীবন যখন একঘেয়ে লাগে, তখন সেই আনন্দও হয়ে ওঠে বিষের মতো।

ডিজিটাল ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায়
সমস্যা যত গভীরই হোক না কেন, তার সমাধানও আছে। সোশ্যাল মিডিয়ার উপকারিতা যেমন আছে তেমনই আছে তার অপকারিতাও। একটু সতর্কতাই আপনাকে এই সমস্যা থেকে বের হতে সাহায্য করবে। ডিজিটাল ডিটক্স বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ডিজিটাল জগৎ থেকে দূরে থাকা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য দারুণ কার্যকর।

সপ্তাহে একদিন ‘নো সোশ্যাল মিডিয়া ডে’ রাখতে পারেন। ঘুমাতে যাওয়ার আগে অন্তত ১ ঘণ্টা স্ক্রিন ফ্রি রাখুন। খাবারের সময় ফোন এক পাশে রেখে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান। বই পড়া, হাঁটা, গান শোনা বা মেডিটেশনের জন্য সময় রাখুন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিন। এরপরও যদি নিজেকে একা মনে হয় তাহলে কোনো দ্বিধা না করে কাউন্সেলরের সাহায্য নিন।

সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে- সংযোগ, তথ্য, পরিচিতি। কিন্তু সবকিছুরই একটা সীমা থাকা জরুরি। ভাইরালের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে যদি নিজের মানসিক স্বাস্থ্যকে হারিয়ে ফেলি, তাহলে সে দৌড়ের কোনো মানে হয় না। এই সময়ে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হওয়া। মনে রাখা দরকার ‘পোস্ট’ এর পেছনের জীবনটাই আসল। ভাইরাল না হলেও চলবে, নিজের মতো করে শান্তিতে, সুস্থভাবে বাঁচাই বড় কথা।