ইভটিজিংয়ের শিকার হলে যা করবেন ও যা করবেন না

Staff Reporter
বাংলা পোস্ট প্রতিবেদক
প্রকাশিত:২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:২৭ এএম
ইভটিজিংয়ের শিকার হলে যা করবেন ও যা করবেন না
ছবি : সংগৃহীত

গণপরিবহন, রাস্তা, অফিস, স্কুল-কলেজ, এমনকি নিজের বাসা– বাংলাদেশে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে নারীরা হয়রানি বা ইভটিজিংয়ের শিকার হন না। অনেকেই চুপ করে সহ্য করেন, অনেকে প্রতিবাদ করেন। কিন্তু কেমন হওয়া উচিত সেই প্রতিবাদের ভাষা?

ঠিকঠাক প্রয়োগ না হলেও বাংলাদেশের দণ্ডবিধিতে এসব হয়রানি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রত্যেকেই চান এই অপরাধ আইনের আওতায় আসুক ও অপরাধীর বিচার হোক। কিন্তু দুখঃজনক হলেও এটাই সত্য যে লাখ লাখ খুন, ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতির মতো মামলার ভিড়ে এই উত্ত্যক্তকারীদের বিচার হওয়া একটি দুর্লভ ঘটনা। তার ওপর আছে রাজনৈতিক পরিচয় আর ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা। তার মানে কি বিচারের ভার ছিনিয়ে নিয়ে ভুক্তভোগী নিজেও একজন অপরাধী হয়ে উঠবে? অথবা ’ক্ষমতাশালী’ কারও সাহায্য নিয়ে প্রতিশোধ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন? এভাবে কি নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব?

উত্তরটি এক কথায় ‘না’। আইনের প্রয়োগ চাইলে শুরুতেই আইনের সম্মান করতে হবে। সম্প্রতি দুজন নারীর নালিশে কয়েকজন তরুণ মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আরেকজন তরুণের ওপর। ছোট একটি অভিযোগের ভিত্তিতে রীতিমতো প্রাণ কেড়ে নিলো অভিযুক্ত তরুণের। ঘটনাটি হয়তো নিছক একটি ভুল বোঝাবুঝি অথবা না, তথ্য প্রমাণ ছাড়া সেই দাবি করবো না। কিন্তু তাই বলে ক্ষমতা জাহির করার প্রতিযোগিতায় একজন তরুণের প্রাণ হারানো আসলে সামাজিকভাবে আমাদের বিকৃতির দিকেই নির্দেশ করে।

তাহলে রাস্তায় যদি আপনি কারও দ্বারা অনিরাপদ বোধ করেন, বা হয়রানির শিকার হন, কী করবেন তখন?

১. শান্ত থাকুন ও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন
প্রথমেই নিজের নিরাপত্তা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবেন। আপনার আশেপাশে যদি সাহায্যে এগিয়ে আসার মতো কোনো মানুষ না থাকে বা আপনি ফাঁকা জায়গায় হেনস্তার শিকার হন, তাহলে গোপনে ছবি বা ভিডিও নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে দ্রুত নিরাপদ স্থানে চলে যান। সম্ভব হলে নিকটস্থ লোকালয়ে বা আলোর নিচে অবস্থান নিন।

২. জোরে প্রতিবাদ করুন
জোরে ’আমাকে বিরক্ত করবেন না’ বা ’সাহায্য করুন’ বলে চিৎকার করে আশেপাশের মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করুন। বাস, ট্রেন বা পাবলিক প্লেসে থাকলে কন্ডাক্টর বা নিরাপত্তাকর্মীর সাহায্য নিন।

৩. প্রমাণ সংগ্রহ করুন
মোবাইল ফোনে গোপনে ভিডিও বা অডিও রেকর্ড করুন। উত্ত্যক্তকারীর ছবি, গাড়ির নম্বর বা পরিচয় সংরক্ষণ করুন। সাক্ষী থাকলে তাদের পরিচয় ও ফোন নম্বর নিন।

৪. দ্রুত অভিযোগ দায়ের করুন
নিকটতম পুলিশ স্টেশনে অভিযোগ করুন। কেউ অসহযোগিতা করলে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা হেল্পলাইনে ফোন করুন।

জাতীয় জরুরি হেল্পলাইন নম্বরগুলো ফোনে সেভ করে রাখুন-
পুলিশ হেল্পলাইন: ৯৯৯
নারী ও শিশু সহায়তা: ১০৯
সাইবার ক্রাইম ইউনিট: ০১৭৬৯৬৯১৬০

সাইবার ক্রাইমের শিকার হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর অধীনে এই ওয়েবসাইটে রিপোর্ট করুন।

৫. সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করুন
আপনি যদি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হন, তাহলে কোনো সময় নষ্ট না করে প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করুন।

৬. আইনি সহায়তা নিন
সঠিক ভাষায় অভিযোগ দায়ের করার জন্য আপনার আইনি অধিকার জেনে নিন। দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ধারা ৫০৯ নারী উত্ত্যক্তকরণ (ইভটিজিং) সম্পর্কিত আইন। এই আইনে যেসব কাজ উত্ত্যক্ত করার হিসেবে বিবেচনা করা হবে তা হলো-

ক. অশালীন মন্তব্য করা

খ. অপ্রীতিকর শব্দ, ইশারা ও অঙ্গভঙ্গি করা

গ. অশালীন বস্তু (যেমন: অশ্লীল ছবি) দেখানো

ঘ. নারীর ব্যক্তিগত জীবনে অনধিকার প্রবেশ (যেমন: অবাঞ্ছিত ফোন কল)

আপনার অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপরাধীর এক বছর পর্যন্ত জেল বা টাকা জরিমানা বা দুটিই হতে পারে। দণ্ডবিধিতে বলা হয়েছে-

যে ব্যক্তি কোনো নারীর শালীনতা (লজ্জা) ভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে কোনো কথা বলে, কোনো শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি করে কিংবা কোনো বস্তু প্রদর্শন করে– এমনভাবে যাতে সেই কথা বা শব্দ ওই নারী শুনতে পায়, বা সেই অঙ্গভঙ্গি/বস্তু দেখতে পায়– অথবা ওই নারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ করে, তাকে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত সরল কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় শাস্তিতে দণ্ডিত করা হবে।

এবার জেনে নিন হয়রানির শিকার হলে কী কী করবেন না-

১. একা একা বাগবিতণ্ডায় জড়াবেন না।

২. নিজ উদ্যোগে শাস্তি দিতে যাবেন না। এতে আইন প্রয়োগ করা আরও কঠিন হয়ে যায়।

৩. কেউ মীমাংসা করে দিতে চাইলে সেই প্রস্তাব যদি আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে সেখানেই অনাস্থা প্রকাশ করুন ও আইনের সহায়তা নিন। চুপ করে পরে কাউকে দিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবেন না।

৪. হাতাহাতি বা মারামারিতে জড়াবেন না।

৫. আইন অনুযায়ী হওয়া বিচারকে টপকিয়ে ক্ষমতা প্রদর্শন করবেন না।

৬. দেরি করবেন না। ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে থানায় রিপোর্ট করুন। দেরি করলে প্রমাণ সংগ্রহ কঠিন হয়।

৭. সামাজিক মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ রাখবেন না। শুধু ফেসবুক বা টুইটারে পোস্ট করে ক্ষান্ত দিলে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হয় না। আইনি প্রক্রিয়া শুরু করুন।

৮. চুপ করে সহ্য করবেন না। ‘লোকে কী বলবে?’ ভেবে নীরব থাকলে অপরাধী বেপরোয়া হয়ে উঠবে।


মনে রাখবেন, আইনকে কঠোর করতে হলে এর প্রয়োগ করতে হবে। তাই আপনার পেশিগত বা সামাজিক ক্ষমতা থাকলেই সবকিছুকে বলপ্রয়োগ করে সমাধান করার চেষ্টা করবেন না। এতে একসঙ্গে অনেকগুলো জীবন নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কারণ নারী নিরাপত্তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে বিচার করার বিষয় নয়য়। এটি একটি সামগ্রিক ব্যবস্থা।