থার্টি ফার্স্ট উদযাপনে প্রস্তুত কক্সবাজার, বুকিং হয়ে গেছে সব হোটেল-রিসোর্ট
পুরনো বছরকে বিদায়, আর নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত কক্সবাজার। এবার অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি পর্যটক সমাগমের আশা করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট গেস্টহাউস ও কটেজের মালিকরা সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। ইতোমধ্যে আগামী শনিবার পর্যন্ত শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট-গেস্টহাউসের সব কক্ষ বুকিং হয়ে গেছে।
এদিকে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে সব ধরনের নিরাপত্তা প্রস্তুতি। তবে সমুদ্রসৈকত ও উন্মুক্ত স্থানে এবারও কনসার্ট কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকছে না। কয়েকটি তারকা হোটেল প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে নানা আয়োজন রেখেছে। ওই দিন কক্সবাজারে ভ্রমণে আসা লাখো পর্যটকের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে প্রস্তুতি নিয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশ।
ইতোমধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে থার্টি ফার্স্ট নাইটের আয়োজন সম্পন্ন করতে জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দলের নেতা ও হোটেল মালিকদের সঙ্গে সমন্বয় সভা করেছে জেলা প্রশাসন। পর্যটকের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং শান্তিপূর্ণভাবে বর্ষবিদায় ও বরণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে কঠোর নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে বলেও সভায় জানানো হয়।
পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি বছর থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে পর্যটন নগর কক্সবাজার লোকারণ্য হয়ে ওঠে। বছরের শেষ সূর্যাস্ত দেখতে সমুদ্রসৈকত ও আশপাশের পর্যটন এলাকায় অতিথি ও স্থানীয় মিলিয়ে কয়েক লাখ মানুষের সমাগম ঘটে। এবারও তেমন প্রত্যাশা তাদের।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, থার্টি ফার্স্ট নাইটে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতে এবারও উন্মুক্ত স্থানে কনসার্ট কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নেই। তবে কয়েকটি তারকা হোটেল প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে নানা আয়োজন রেখেছে। তারপরও কয়েক লাখ পর্যটকের আগমন ঘটবে। পর্যটকদের জন্য হোটেলের মধ্যেই থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে সৈকতের কোথাও উন্মুক্ত স্থানে কনসার্ট কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠান থাকছে না। সৈকতে আতশবাজি, পটকা ফুটানো নিষিদ্ধ। তবে প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে একাধিক তারকা হোটেল নিজেদের ইনডোরে কনসার্টের আয়োজন করছে। সেখানে বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়া হবে।
থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করতে ইতোমধ্যে পর্যটকরা কক্সবাজারে আসতে শুরু করেছেন বলে জানালেন কক্সবাজার বৃহত্তর বিচ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. আবদুর রহমান।
তিনি ট্রিবিউনকে বলেন, “থার্টি ফার্স্ট নাইট ঘিরে কয়েক লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটবে। ইতোমধ্যে পর্যটকরা আসতে শুরু করেছেন। কারণ শীতকালীন ছুটি চলছে। এবারের ছুটিতে পর্যটকে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে কক্সবাজার। যারা আগেভাগে আসছেন তারা সমুদ্রসৈকত, ইনানী বিচ, হিমছড়ি, রামুর বৌদ্ধবিহার, ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, মহেশখালীর মৈনাক পাহাড়ের আদিনাথ মন্দিরসহ বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে ঘুরছেন। আবার সেন্টমার্টিনেও যাচ্ছেন পর্যটকরা। বিগত সময়ে অনেক ভ্রমণপিপাসু সেন্টমার্টিনে অবস্থান করে নতুন বছর বরণ করতেন। এবার তা সীমিত।”
তারকা হোটেলে থার্টি ফার্স্ট নাইট
কক্সবাজারের তারকামানের হোটেল সায়মান বিচ রিসোর্টে থাকছে কনসার্টের আয়োজন। পুরো রিসোর্ট আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। পাশাপাশি মেরিন ড্রাইভ সড়কের প্যাঁচার দ্বীপ সৈকতে ইকো ট্যুরিজম পল্লির মারমেইড বিচ রিসোর্টে সংগীতশিল্পীদের নিয়ে বর্ষবিদায় ও বরণ উৎসব হবে। সৈকতের লাবণী পয়েন্টের হোটেল কল্লোলের আঙিনায় বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে হোটেল কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া হোটেল ওশান প্যারাডাইস, হোটেল কক্স-টুডেসহ কয়েকটি রিসোর্টে নিজস্ব অতিথিদের জন্য বর্ষবিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।
হোটেল সায়মন বিচ রিসোর্টের গেস্ট রিলেশনশিপ অফিসার সোমাইয়া আকতার রাবু বলেন, “থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে আমাদের নানা আয়োজন রয়েছে। হোটেলকে নতুন করে সাজানোর পাশাপাশি গেস্টদের জন্য রয়েছে নানা সুবিধা। থাকছে শীতকালীন পিঠা উৎসব। হোটেলের ইনডোরে কনসার্টের আয়োজন করা হবে। এতে দেশের খ্যাতনামা সংগীতশিল্পীরা অংশ নেবেন। শুধুমাত্র হোটেলের গেস্টরা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারবেন। আশা করছি, জমকালো আয়োজনে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে পারবেন পর্যটকরা।”
কক্সবাজার ট্যুরিস্ট ক্লাবের সভাপতি মো. রেজাউল করিম বলেন, “‘অন্যান্য বছরের মতো এবারও থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে সমুদ্রসৈকত ও উন্মুক্ত স্থানে কনসার্ট কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকছে না। তবে তারকা হোটেলগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় গেস্টদের জন্য আয়োজন করছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। উন্মুক্ত স্থানে কনসার্টের আয়োজন করা গেলে আরও বেশি পর্যটন আসতো।”
বুকিং হয়ে গেছে সব হোটেল-রিসোর্ট
হোটেল মালিকরা বলছেন, সোমবার থেকে শহরের হোটেল-মোটেল-গেস্টহাউস-রিসোর্টের কোনো কক্ষ খালি নেই। গত দুই দিন ১০% কক্ষ খালি থাকলেও থার্টি ফার্স্ট নাইট (৩১ ডিসেম্বর) পর্যন্ত শতভাগ কক্ষ অগ্রিম বুকিং করা। আগামী ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত অন্তত পাঁচ-সাত লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটবে বলে আশা তাদের।
কক্সবাজার হোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, “এখন পাঁচ শতাধিক হোটেল রিসোর্ট গেস্টহাউস কটেজের কোনো কক্ষ খালি নেই। হোটেল রিসোর্ট গেস্টহাউসে দৈনিক ধারণক্ষমতা এক লাখ ৪০ হাজার। এখন একটি কক্ষে গাদাগাদি করে পাঁচ-সাত জন করে থাকছেন। এ রকম অবস্থা থাকবে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। সামনে পর্যটক আরও বাড়বে।”
কলাতলী-মেরিন ড্রাইভ হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মৌখিম খান বলেন, “প্রতি বছর থার্টি ফার্স্ট নাইট ঘিরে কয়েক লাখ পর্যটকের সমাগম হয়। এবারও ব্যতিক্রম হবে না। এজন্য আমরা বাড়তি প্রস্তুতি নিয়েছি। প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে পর্যটকদের কীভাবে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়া যায়, সেসব আয়োজন সম্পন্ন করেছি। আশা করছি, পর্যটকরা থার্টি ফার্স্ট সুন্দরভাবে উপভোগ করতে পারবেন।”
৫ বছর ধরে উন্মুক্ত স্থানে অনুষ্ঠান বন্ধ
২০২০ সাল থেকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ও উন্মুক্ত স্থানে কনসার্ট কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে না। তখন করোনা মহামারির কথা বলে এসব অনুষ্ঠান আয়োজন বন্ধ করা হয়েছিল।
এ বিষয়ে কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ.ন.ম হেলাল উদ্দিন বলেন, “উন্মুক্ত স্থানে অনুষ্ঠান না থাকলে থার্টি ফার্স্ট জমে না। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা আগমন ঘটে। তখন থেকে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সৈকতের উন্মুক্ত স্থানে বাউন্ডারি দিয়ে অনুষ্ঠান করা হতো। ২০১৯ সালেও একইভাবে আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু করোনা মহামারি আসার পর পুরো পর্যটন নগর প্রায় অচল হয়ে যায়। ২০২০ সাল থেকে করোনা মহামারির কারণে উন্মুক্ত স্থানে কনসার্ট কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে এখন যেহেতু করোনা নেই, তাই উন্মুক্ত স্থানে কনসার্ট ও অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি দেওয়া উচিত ছিল প্রশাসনের। এসব আয়োজন করলে জমজমাট হয়ে উঠবে পর্যটন শিল্প।”
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (পর্যটন সেল) মো. তানভীর হোসেন বলেন, “সমুদ্রসৈকত ও উন্মুক্ত স্থানে কনসার্ট কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার থার্টি ফার্স্ট নাইট আয়োজন সংক্রান্ত জেলা প্রশাসনের সমন্বয় সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। তবে পর্যটকরা নিজেদের মতো নতুন বছর উদযাপনে মধ্যরাত পর্যন্ত বিচে ঘুরতে পারবেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বেশ কয়েকটি টিম মাঠে থাকবে। শহরে যানজট কমানোর ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।”
পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এবারও উন্মুক্ত স্থানে থার্টি ফার্স্ট নাইটের আয়োজন বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানালেন ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান।
তিনি বলেন, “উচ্ছৃঙ্খল আচরণ থেকে বিরত থাকতে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর কয়েক স্তরের বিশেষ নিরাপত্তা বলয় তৈরি করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তল্লাশি ছাড়া কাউকে সৈকতে নামতে দেওয়া হবে না। সাদা পোশাকের পাশাপাশি সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকছে পাঁচটি ভ্রাম্যমাণ টিম। শুধু নিরাপত্তা নয়, পর্যটকদের সমস্যা সমাধানের জন্য থাকবে ট্যুরিস্ট পুলিশের বিশেষ টিম।”