ঈদ পর্যটন: ঢাকায় সংকীর্ণতা, বাইরে একঘেয়ে

Bangla Post Desk
ইউএনবি
প্রকাশিত:০১ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৫৭ এএম
ঈদ পর্যটন: ঢাকায় সংকীর্ণতা, বাইরে একঘেয়ে

ঈদ মানে এখন কেবল নাড়ির টানে বাড়ি ফেরার গল্পই না। সময়ের ব্যবধানে ঈদের ছুটিতে মানুষের ঘোরাঘুরি নিজ গ্রামের পাশাপাশি অন্যান্য দর্শনীয় স্থানে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। রূপ নিয়েছে রীতিমতো পর্যটনে। কিন্তু বৈচিত্র্যহীন আয়োজনে ঢাকার পর্যটন হয়ে পড়েছে সংকীর্ণ। আর সবকিছুতে গতানুগতিক ও একঘেয়েমির কারণে ঢাকার বাইরে ঘুরতে যেতেও স্বস্তিবোধ করছেন না পর্যটকরা।

ঈদের দিন সোমবার (৩১ মার্চ) বিকালে রাজধানীর বাড্ডায় বসে সেই অভিজ্ঞতার কথাই বলছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম (৫৫)। ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে এবার দেশের বাইরে ঘুরতে যাওয়ার কথা থাকলেও শেষমেশ আর যাচ্ছেন না। দেশেই থেকে যাচ্ছেন তিনি।

আবার দেশে থাকলেও কোথাও ঘুরতে যাবেন না বলে ঠিক করেছেন নজরুল। এমনকি ঢাকা শহরেও ঈদের দিন বিকাল বেলা বের হবেন না। পুরো সময়টা কাটাবেন পরিবারের সঙ্গে।

কেন এমন চিন্তা, জানতে চাইলে নজরুল বলেন, ‘খেয়াল করলে দেখবেন আমাদের দেশে প্রায় প্রতিটি উৎসবের রঙ একই রকম। ঈদের দিন সকাল বেলা নামাজ শেষে বাসায় ফিরে দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করার পর বের হয়ে ঢাকায় সর্বোচ্চ কোথায় যাওয়া যায়; হয় কোনো আত্মীয়ের বাসায়, আর না হয় পার্কে, না হলে সবাই মিলে ভালো কোনো রেস্তোরাঁয়।’

‘এই যে প্রি-স্ক্রিপ্টেড ঈদ। ঘুরে ফিরে প্রতিবছর একই রকম আনন্দ নেয়ার চেষ্টা। এটা বিশ্বের ভালো কোনো দেশের শহরে নেই। ঢাকার বাইরে গিয়েও কোনো লাভ নেই। আধাবেলা ঘুরে একঘেয়েমি জিনিসপত্র দেখে ক্লান্ত হয়ে যেতে হয়,’ বলেন তিনি।

এক সময় ঈদে ঢাকার প্রতিটি এলাকায় ছোট-বড় মেলা বসতো। সেই স্মৃতিচারণ করে রাজধানী গোপীবাগের বাসিন্দা মোসাব্বের হোসেন (৭২) বলেন, ‘মেলার পাশাপাশি পুরান ঢাকায় নৌকা বাইচের আয়োজন করা হতো। বড় বড় মাঠে ঘোড়দৌড়ের ব্যবস্থা থাকতো। কিন্তু এখন ঈদ হয়ে গেছে পার্কে ঘোরা আর রেস্টুরেন্টে খাওয়ার মধ্যের সীমাবদ্ধ।’

এ জন্য রাজধানীর অতি বাণিজ্যিকীকরণকে দায়ী করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি নগর-পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান। তার ভাষ্য, ‘এখন আর এই শহরে বাণিজ্যিক বড় লাভের বাইরে বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠার সুযোগ নেই। আগে ঢাকার যেসব মাঠে মেলা বসতো, এখন সেসব মাঠের অনেকগুলোর অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না।

‘নৌকা করে ঘুরে বেড়ানোর খাল দখল হয়ে গেছে। জলাশয় ভরাট করে বড় বড় বাণিজ্যিক অট্টালিকা উঠেছে ঢাকার বুকে। আর এসব অট্টালিকা কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠেছে ঈদ আনন্দের খোরাক।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকার পার্কগুলোও দখল হয়ে গেছে। ধানমণ্ডি লেক এলাকা ঘুরলে এখন মনে হয় এখানে লেক মুখ্য না, মুখ্য হয়ে উঠেছে লেকের পাশে গড়ে উঠা ডজনখানেক রেস্টুরেন্ট। ঢাকাকে নিয়ে কোনো ধরনের কোনো কার্যকর পরিকল্পনা কারও মধ্যে দেখা যায় না। ঈদের দিন যারা ঢাকায় থাকেন, তারা প্রতিবছরই একমুখী সংকীর্ণ ঈদ পালন করতে করতে একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছেন।’

গতবার ঈদে পরিবার-পরিজন নিয়ে কক্সবাজার ঘুরতে গিয়েছিলেন হুমায়ুন রশিদ (৩২)। নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কক্সবাজার ঘুরে দেখতে আপনার দুই দিনের বেশি সময় লাগবে না। এরপরই যে কারো একঘেয়েমি ধরে যাবে। এখানে সমুদ্র দেখার বাইরে আর যেসব বিনোদনের ব্যবস্থা আছে, তা একরকমের ধাপ্পাবাজি। বেশি টাকা নিয়ে বোট রাইডিং, প্যারা সাইকেলিং, হর্স রাইডিং, বাইক রেসিং এর নামে বিনোদনের খোলসে যা কিছু হয় তা এক রকমের লোক ঠকানো।’

হুমায়ুন বলেন, ‘যখন একটি দেশের পর্যটক বুঝতে পারেন তাকে পদে পদে ঠকানো হচ্ছে, তখন সে এসব পর্যটন কেন্দ্রগুলোর ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেন। গত ঈদে কক্সবাজারে প্রায় ৮ লাখ পর্যটক এসেছিল। সি-বিচে যারপরনাই ভিড় দেখে মনে হচ্ছিল রাজধানীর কোনো মাছের বাজারে দাঁড়িয়ে আছি। হোটেলে রুম ভাড়া ছিল কয়েকগুণ বেশি। ২০ টাকার আলুভর্তা মানুষ বাধ্য হয়ে ১৫০ টাকায় কিনে খেয়েছে। এই যদি পর্যটন কেন্দ্রগুলোর ব্যবস্থাপনার অবস্থা তাহলে মানুষ কেন আসবে!’

গতবারের মতো এবার ঈদেও দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো সেজেছে নানা সাজে। ইতোমধ্যে কক্সবাজারের ৮০ শতাংশ হোটেল বুক হয়ে গেছে। বাকিটাও দুই একদিনের মধ্যে হয়ে যাবে বলে আশা করছেন হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও হোটেল বুকিংয়ে বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে এমন অভিযোগ ক্রেতাদের।

ঈদের একদিন পর কক্সবাজারে সি-বিচ মুখোমুখি যেকোনো হোটেলের ভালো মানের এসি রুম বুক করতে গিয়ে ফয়সাল দেখেন প্রতিটি কাপল রুমের ভাড়া ৮-৯ হাজার টাকা। ফয়সাল বলেন, ‘থ্রি স্টার হোটেলের এসব রুমের ভাড়া আগে ছিল ৪-৫ হাজার টাকা। ঈদকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে ভাড়া দ্বিগুণ করা হয়েছে, যা মোটেই কাম্য নয়।’

দীর্ঘদিন কক্সবাজারের একটি হোটেলে ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন মুরশিদ হোসেন। বর্তমানে ঢাকার একটি তিন তারকা হোটেলের মহাব্যবস্থাপক পদে আছেন তিনি।

কেন পর্যটন মৌসুমে হোটেলগুলোতে বাড়তি ভাড়া নেয়া হয় এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মৌসুম ছাড়া বেশিরভাগ সময়েই হোটেল ব্যবসা মন্দা যায়। তখন ৫০ শতাংশের উপরে রুম বুকিংয়ে ছাড় দিয়েও পর্যটক পাওয়া যায় না। হোটেলগুলোকে টিকিয়ে রাখতে, কর্মীদের বেতন-ভাতা দিতে বাধ্য হয়ে পর্যটন মৌসুমি পর্যটকদের থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করতে হয়।’

সিলেট, কক্সবাজার, বান্দরবান এবং কুয়াকাটা অঞ্চলের হোটেলগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এপ্রিলের ১-৫ তারিখের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রুম বুকিং দিয়েছেন পর্যটকরা। পর্যটকদের স্বাগত জানাতে এবং বিনোদনের ব্যবস্থা করতে প্রস্তুত হচ্ছে পর্যটন স্পটগুলো।

এ প্রস্তুতি আদৌ যথেষ্ট কিনা সে প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ শোয়েব-উর-রহমান বলেন, ‘কীভাবে পর্যটক টানতে হয়, তার নূন্যতম কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই।’

‘প্রতি বছর ঈদ শেষে শোনা যায় ১৫ লাখ পর্যটক দেশের নানা স্পট ঘুরে বেড়িয়েছেন। কিন্তু এই সংখ্যাটির অফিসিয়াল কোনো ভিত্তি নেই। যতদিন না পর্যটকদের সংখ্যার নিরিখে পর্যটনকেন্দ্রগুলো প্রস্তুত করা হবে, যতদিন না পর্যটন স্পটে বিনোদনের নতুন সংজ্ঞা সেট করা হবে, ততদিন পর্যন্ত আশু সমাধান আশা করা যায় না।’

শোয়েব বলেন, ‘দেশের মানুষ এক-দুবার কক্সবাজার-বান্দরবান গেলে পরে আর যেতে চায় না। কিন্তু বালি বা ব্যাংককের মতো শহরে মানুষ বারবার যেতে চায়। এর সবচেয়ে বড় কারণ বাংলাদেশের পর্যটন স্পটগুলোর বিনোদন নিতান্তই একমুখী। কিন্তু দেশের বাইরে শুধু প্রকৃতি না, প্রকৃতি আর মানুষের সৃষ্টিকর্মের মিথস্ক্রিয়ায় এক একটি পর্যটন কেন্দ্রকে একেক রূপে ঢেলে সাজানো হয়েছে। পর্যটক জানেন, চাইলেই দুই দিনে পুরো ব্যাংকক ঘুরে দেখা সম্ভব না। কিন্তু আপনি সকালে শুরু করলে সন্ধ্যার মধ্যে কক্সবাজারের মূল মূল স্পটগুলো ঘোরা শেষ হয়ে যাবে ‘

‘আবার পর্যটনকে কেন্দ্র করে স্পটগুলোতে যেসব সিন্ডিকেট গড়ে উঠছে, তাতে করে পর্যটকদের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। এক ধরনের অদ্ভুত মূল্যস্ফীতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। পর্যটকদের কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ পর্যটকদের ওপর তাদের একরকমের বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিনের এই বৈরিতা পর্যটকদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি করে। এতে করে আইন-শৃঙ্খলারও অবনতি হওয়ার শঙ্কা থাকে,’ যোগ করেন শোয়েব।

এবারের ঈদ পর্যটনে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। রাজধানীর পাশাপাশি দেশের অন্যান্য জেলায় বিগত কয়েক মাসের বিভিন্ন ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মনে বিরাজ করছে এক ধরণের চাপা শঙ্কা।

বিয়ের পর এবারের ঈদের ছুটিতে স্ত্রীকে নিয়ে প্রথমবারের মতো সাজেক ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেও বাদ দিয়েছেন এনজিও কর্মী আহমেদ পিয়াস (২৮)। বলেন, ‘দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে দুজন মিলে কোথাও যেতে সাহস হচ্ছে না। পরিবার এবং বন্ধু পরিজনদের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে গেলে দল বেধে যেতে। যাতে করে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি হলে মোকাবেলা করা যায়।’

তবে এবার ঈদে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে বাড়তি সতর্ক অবস্থানে আছে বলে জানায় ট্যুরিস্ট পুলিশ বিভাগ। ট্যুরিস্ট পুলিশ হেড কোয়াটার্সের পুলিশ সুপার (লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া) খন্দকার খালিদ বিন নূর বলেন, ‘র‍্যাব-সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিটি পর্যটন স্পটে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিতে ট্যুরিস্ট পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। আশা করছি কোনো ধরনের নিরাপত্তাজনিত সমস্যা হবে না। পর্যটকরা নির্বিঘ্নে আনন্দের সঙ্গে তাদের ঈদের ছুটি কাটাতে পারবেন।’

‘কোনো পর্যটক যেকোনো ধরনের সমস্যায় ট্যুরিস্ট পুলিশের সাহায্য নিতে পারবেন। স্থানীয় থানার পাশাপাশি স্পটে আলাদা ভেস্ট এবং ক্যাপ পড়ে ট্যুরিস্ট পুলিশ অবস্থান করবে। সমস্যা হলে তৎক্ষনাৎ তাদের শরণাপন্ন হতে পারবেন পর্যটকরা।’

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচিবোধের পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এই রুচিবোধের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের অন্যান্য পর্যটন স্পটগুলোতে রুচিশীলতার ছোঁয়া আদৌ লেগেছে কিনা বেসামরিক বিমান পরিবহন এবং পর্যটন মন্ত্রণালয় দিতে পারেনি এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (পর্যটন) মো. আতাউর রহমানকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এসবের কোনো আপডেট আমার কাছে নেই। অফিসে গিয়ে কথা বলে পরে জানাতে পারবো।’

প্রতি বছরই ঈদের ছুটিকে কেন্দ্র করে লাখ লাখ মানুষ দেশের পর্যটন স্পটগুলোতে ভিড় জমাচ্ছে। কিন্তু ফিরে এসে বলছেন তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। পরিস্থিতি না বদলানোর কারণে অনেকে দেশ বাদ দিয়ে বাইরে ঘোরার জন্য বেছে নিয়েছেন বালি কিংবা ব্যাংকের মতো শহর, অনেকেই আবার রাজধানীতে থেকেও উঠছেন হাঁপিয়ে। এ অবস্থায় দেশের পর্যটন খাতকে সময়োপযোগী করে গড়ে তোলার আর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা।