বাংলাদেশকে ট্রানজিট করে দক্ষিণ এশিয়ার ‘নিয়ন্ত্রণ’ চায় স্টারলিংক

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট প্রতিবেদক
প্রকাশিত:০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৪০ পিএম
বাংলাদেশকে ট্রানজিট করে দক্ষিণ এশিয়ার ‘নিয়ন্ত্রণ’ চায় স্টারলিংক
ছবি : সংগৃহীত

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ইন্টারনেট ব্যবসায়ের বাজার দখলে মরিয়া ইলন মাস্কের স্পেসএক্সের স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক স্টারলিংক। ভুটানে তারা ইন্টারনেট সেবা দেওয়া শুরু করলেও তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। কারণ দূরবর্তী দেশ সিঙ্গাপুর ও মঙ্গোলিয়াকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে ভুটানে ইন্টারনেট সেবা দিতে হচ্ছে স্টারলিংককে। এতে জমছে না ব্যবসা।

ব্যয় ও দূরত্বের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সিঙ্গাপুরকে বাদ দিয়ে এবার বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে চায় স্টারলিংক। এজন্য ঢাকার অদূরে গাজীপুরের হাইটেক পার্কে বড় গ্রাউন্ড স্টেশন বসানোর পরিকল্পনা করছে তারা। এখান থেকে স্টারলিংক ভুটানসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ইন্টারনেট সেবা দিতে চায়।

বিষয়টি নিয়ে স্টারলিংক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিএল) সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা শেষ করেছে। এরপর আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পেতে গত ১৩ আগস্ট বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) চিঠি দিয়েছে।

আনফিল্টারড আইপি চায় স্টারলিংক

বিটিআরসিটকে দেওয়া চিঠিতে স্টারলিংক উল্লেখ করেছে, বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে তারা তাদের বাংলাদেশের ‘পয়েন্ট অব প্রেজেন্স (পপ)’ বা ডেটা হাবকে সিঙ্গাপুর ও ওমানের হাবের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চান। এ সংযোগের জন্য তারা ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিজড সার্কিট (আইপিএলসি) ও আনফিল্টারড আইপি ব্যবহার করার অনুমতি চেয়েছেন।

চিঠিতে আরও বলা হয়, স্টারলিংকের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয় নেটওয়ার্ক রেজিলিয়েন্সি ও রিডান্ডেন্সি। আন্তর্জাতিক এ সংযোগ কেবল স্টারলিংকের নিজস্ব নেটওয়ার্কের স্থিতিশীলতা ও সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হবে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বা স্থানীয় ব্যবহারকারীদের ডাটার কোনো সম্পর্ক থাকবে না।

বিটিআরসিকে আশ্বস্ত করে স্টারলিংক চিঠিতে আরও উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা প্রত্যেক গ্রাহকের ইন্টারনেট ট্র্যাফিক স্থানীয় ইন্টারনেট আন্তর্জাতিক গেটওয়ে দিয়েই পরিচালিত হবে। দেশের নিরাপত্তা, আইনসম্মত পর্যবেক্ষণ ও কনটেন্ট ব্লকিং সংক্রান্ত সমস্ত নীতিমালা কঠোরভাবে মেনে চলা হবে। এ সংযোগ স্থাপনের জন্য তারা সরকার অনুমোদিত স্থানীয় কোম্পানি ‘ফাইবার অ্যাট হোম’ এবং ‘বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল’ থেকে আইপিএলসি সেবা নেবে।

বিটিআরসির সভায় আলোচনা, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি

গত ২৭ আগস্ট বিটিআরসির ২৯৮তম কমিশন সভায় স্টারলিংকের এ আবেদন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে বৈঠকে অনুমোদন দেওয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বিটিআরসি।

বৈঠকে অংশ নেওয়া কমিশন সদস্যরা জানান, সভায় স্টারলিংক সার্ভিসেস বাংলাদেশ লিমিটেডের পারিচালনা কার্যক্রম পরিদর্শন বিষয়ে প্রাথমিক প্রতিবেদন পেশ করেন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন্স বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শফিউল আজম পারভেজ।

তিনি জানান, লাইসেন্সের অনুচ্ছেদ ৫.১ অনুযায়ী স্টারলিংকের বাংলাদেশে গেটওয়ে স্থাপনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে গেটওয়ে পরিদর্শনের বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু বিটিআরসির অন্যান্য লাইসেন্সিং কার্যক্রম শুরুর আগে অপারেশনাল কার্যক্রম পরিদর্শনের নজির রয়েছে। সে সূত্রধরে গত ১০ আগস্ট ই-মেইলে স্টারলিংক ঢাকার কালিয়াকৈরে দুটি এবং রাজশাহী ও যশোরে একটি করে মোট চারটি গেটওয়ে স্থাপন করেছে বলে জানিয়েছে। ই-মেইল পেয়ে গত ১৩ আগস্ট স্টারলিংককে স্থাপনাসমূহ পরিদর্শনের চিঠি দেওয়া হয়। এরপর ১৬ আগস্ট বিটিআরসি থেকে পরিদর্শন আদেশ জারি করা হয়।

পরিদর্শন শেষে দেওয়া মতামত অনুযায়ী, প্রতিটি স্থাপনাই ভাড়ায় পারিচালিত হচ্ছে। কোথাও স্টারলিংক সার্ভিস লিমিটেডের কোনো প্রতিনিধি পাওয়া যায়নি। এমনকি স্থানীয় অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো কারিগরি ব্যক্তির অথবা পরিচালনার বিষয়ে কোনো তথ্য সংগ্রহ করা যায়নি।

অন্যদিকে, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) থেকে গত ৩০ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে পাঠানো চিঠি অনুযায়ী, স্টারলিংক বাংলাদেশে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর আগেই তাদের বাংলাদেশে স্থাপিত গেটওয়েতে ডিটিআই স্থাপনসহ এলও রিকোয়ারমেন্ট নিশ্চিত করেছে।

অনুমোদনের ‘পক্ষে’ খাত-সংশ্লিষ্টরা, ভাবছে বিটিআরসি

বর্তমানে ভুটানের গ্রাহকদের সিঙ্গাপুরের গ্রাউন্ড স্টেশনের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে স্টারলিংক, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল; আবার ল্যাটেন্সিও অনেক বেশি। সেজন্য ফাইবার অ্যাট হোম ও বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেড থেকে আইপিএলসি এবং আনফিল্টারড আইপি ব্যান্ডউইথ কিনে বাংলাদেশের গেটওয়ে থেকে সিঙ্গাপুর ও ওমান পপে ডাটা পরিবহন করার পথে হাঁটছে স্টারলিংক।

বিদেশি গ্রাহকদের জন্য যে আন্তর্জাতিক লিংকটি যাবে, স্টারলিংক চায় সেখানে বাংলাদেশ সরকার যেন কোনো ফিল্টার বা ব্লক না করে। এক দেশের ট্রাফিক যখন অন্য কোনো দেশের মধ্য দিয়ে ভিন্ন কোনো দেশে যায়, তা সাধারণত মধ্যবর্তী দেশের ফিল্টারিংয়ের আওতায় থাকে না।

জানতে চাইলে ফাইবার অ্যাট হোমের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা প্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, বর্তমানে আমাদের পাশের দেশে স্টারলিংক তাদের গ্রাহকদের সেবা পৌঁছে দিচ্ছে সিঙ্গাপুর ও মঙ্গোলিয়ার মধ্য দিয়ে। ফলে এ ব্যবসাটা এ দুটি দেশের হাতে রয়েছে। স্টারলিংক বাংলাদেশকে এখন ট্রানজিট করতে চায়। এর মাধ্যমে আমাদেরকে তাদের ব্যবসায়ে প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছে। এখন যদি এটা ফিল্টারড করা হয়, তাহলে তো চলবে না। পাশের দেশগুলোর ব্যবহারকারীরা কী ব্যবহার করবে; না করবে, সেটা বাংলাদেশ নজরদারি করতে চাইলে সে ব্যবসা কখনও হবে না।

স্টারলিংকের অনুমোদনের বিষয়টি গাইডলাইন পর্যালোচনা ও দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী। তিনি বলেন, তারা (স্টারলিংক) আমাদের একটি চিঠি দিয়েছেন। টেকনিক্যাল ইস্যুগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। দেশের বিদ্যমান আইন ও গাইডলাইন অনুযায়ী যদি তাদের অনুমোদন দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে দেবো। আর যদি আইন ও গাইডলাইনের বিপরীত কিছু থাকে, তাহলে দেবো না।