আতলেতিকো-বার্সেলোনা: অবিশ্বাস্য সব ঘটনার জন্ম দিয়ে ম্যাচজুড়ে যা হলো

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট ডেস্ক
প্রকাশিত:১৭ মার্চ ২০২৫, ১০:৩৪ এএম
আতলেতিকো-বার্সেলোনা: অবিশ্বাস্য সব ঘটনার জন্ম দিয়ে ম্যাচজুড়ে যা হলো

চলতি মৌসুমে ইউরোপের বদলে যাওয়া দলগুলোর মধ্যে অন্যতম দুটি নাম আতলেতিকো মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা। এক দল বিপুল অর্থ খরচ করে সাজিয়েছে দুর্দান্ত এক দল, অন্যটি টাকার অভাবে একাডেমির কিশোর ফুটবলারদের তুলে দিয়েছে নতুন এক কোচের হাতে।

আতলেতিকোর অর্থ আর হান্সি ফ্লিকের জাদুকরি ছোঁয়ায় দুই দলেই এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। চলতি মৌসুমে এই দুই দলের আগের দুই ম্যাচেও মিলেছিল ধ্রুপদী লড়াইয়ের দেখা। তবে তৃতীয়বারের দেখায় যা হলো তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য।

দুপক্ষই ম্যাচে অবিশ্বাস্য সব ঘটনার জন্ম দিয়েছে। চলুন দেখে নেই উত্তেজনাকর এই ম্যাচটি শুরু হয়ে কীভাবে শেষ হলো।

এদিন মাঠে নেমেই দুর্লভ এক রেকর্ডে নাম লিখিয়েছেন আতলেতিকো মাদ্রিদ, এরপর বার্সেলোনা এবং পরে আবারও লস রোহিব্লাঙ্কোসদের জার্সি গায়ে চাপানো ফরাসি ফরোয়ার্ড আন্তোয়ান গ্রিজমান। লা লিগায় ৫২০তম ম্যাচ খেলে ফেলেছেন তিনি। আর এতে করে টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা খেলোয়াড় বনে গেছেন সোনালি চুলের এই ফুটবল তারকা।

এই কীর্তি আছে মাত্র আর একজনের। আর্জেন্টিনা থেকে শৈশবে স্পেনে পাড়ি জমিয়ে সে দেশটিকেই নিজের ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলা লিওনেল মেসির। তবে শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও আর এক ম্যাচ মাঠে নামলে মেসিকে ছাড়িয়ে যাবেন গ্রিজমান।

সেইসঙ্গে চলতি মৌসুম তো বটেই আরও কয়েক বছর সিমিওনের অধীনে খেলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না এই আতলেতিকো কিংবদন্তির। সেক্ষেত্রে মেসিকে ছাড়িয়ে বহুদূর এগিয়ে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ জয়ী এই ফরাসি তারকা।

ম্যাচ শুরুর পর থেকেই এদিন একে অপরের রক্ষণে ত্রাস ছড়াতে থাকে দুই দল। এর পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় মিনিটেই সুযোগ আসে স্বাগতিকদের। তবে বক্সের ভেতরে ডান পাশ থেকে জুলিয়ানো সিমিওনের নেওয়া শট ক্রসবারের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়।

পঞ্চম মিনিটে অসাধারণ একটি গোলের সুযোগ তৈরি করে বার্সেলোনাও। প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের ভেতর দিয়ে ড্রিবল করে বক্সে ঢোকার মুখে ভেতরে থাকা লামিনকে পাস দেন দানি অলমো। এরপর বল ধরে বাঁ পাশের পোস্ট বরাবর শট বাঁকিয়ে দেন ১৭ বছর বয়সী স্প্যানিশ উইঙ্গার। তবে লামিনের সেই শটটি পোস্টে বাধা পেয়ে ফিরে এলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘরের মাঠের দর্শকরা।

চতুর্দশ মিনিটে জুল কুন্দের ক্রসে হেড দিয়ে লক্ষ্যভেদের চেষ্টা করেন লেভানডোভস্কি, কিন্তু বল ধরে ফেলেন আতলেতিকো গোলরক্ষক ইয়ান ওবলাক।

ম্যাচের শুরুতে দুই দলই একের পর এক আক্রমণে উঠতে থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সিমিওনের সুপরিচিত রক্ষণাত্মক ফুটবলের দিকে ঝোঁকে আতলেতিকো। তবে সুযোগ পেলেই দ্রুতগতিতে পাল্টা আক্রমণে গিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগও খুঁজতে থাকে তারা।

এভাবে সময় অতিবাহিত হওয়ার মাঝে প্রথমার্ধের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার এক মিনিট আগে আরও একবার গোল পাওয়ার সম্ভাবনা জাগায় বার্সেলোনা, কিন্তু শেষ মুহূর্তে লেভাকে চাপ দিয়ে জায়গা কমিয়ে দেয় আতলেতিকোর ডিফেন্ডাররা; ফলে ব্যর্থ হন তিনি।

এর ঠিক পরের মিনিটেই দারুণ এক আক্রমণে উঠে তা থেকে গোল আদায় করে নেয় স্বাগতিকরা।

ক্ষিপ্রগতিতে আক্রমণে উঠে বার্সার ডিফেন্স ভেঙে এগিয়ে যান জুলিয়ানো, তাকে সঙ্গ দিতে দিতে এগিয়ে যান হুলিয়ান আলভারেস। এরপর বক্সের সামনে থেকে জুলিয়ানো পাস বাড়ালে তা থেকে গোল আদায় করে নেন লা আরানিয়া।

ফলে বল দখলের লড়াইয়ে পিছিয়ে থাকলেও সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঠিকই এগিয়ে গিয়ে বিরতিতে যায় দিয়েগো সিমিওনের শিষ্যরা।

প্রথমার্ধে বার্সেলোনা ৬৩ শতাংশ সময় পজেশন ধরে রাখলেও চারটি করে শট নেয় দুই দলই, যার একটি করে শট লক্ষ্যে রাখতে সক্ষম হয় তারা। এর মধ্যে সাফল্য জোটে আতলেতিকো মাদ্রিদের।

এক গোলে এগিয়ে থাকায় স্বভাবসুলভ লো-ব্লক ডিফেন্স দিয়েই দ্বিতীয়ার্ধ শুরু করে মাদ্রিদের দলটি। তাদের দুই স্তরের ডিফেন্স ভেঙে বল নিয়ে আক্রমণ শাণাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছিল বার্সার খেলোয়াড়দের।

এর মধ্যেও ম্যাচের ৫০, ৫৩ ও ৫৯তম মিনিটে যথাক্রমে লামিন, রাফিনিয়া ও লেভানডোভস্কির তিনটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। আর আতলেতিকোর আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের সুযোগের অনুসন্ধান তো ছিলই।

এরই ধারাবাহিকতায় ৭০তম মিনিটে মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো বার্সেলোনার ঘাড়ে চেপে বসে বিতর্কিত এক গোল। এই সময়ে আলেকজান্ডার সোরলথ আতলেতিকোর ব্যবধান বাড়িয়ে দিলেও আক্রমণের শুরুতে পরিষ্কার হ্যান্ডবল থাকায় তা নিয়ে আপত্তি জানায় বার্সেলোনা।

মূলত পেদ্রির পাস রদ্রিগো দে পলের হাতে লেগে দিক পরিবর্তন করে কনর গ্যালাগারের দিকে চলে যায়। এরপর তা ধরে ছুটে গিয়ে বার্সার বক্সের সামনে থেকে সোরলথকে নিচু ক্রস দেন ইংলিশ মিডফিল্ডার, আর তা থেকে গোল আদায় করেন সোরলথ।

সঙ্গে সঙ্গে বার্সেলোনার খেলোয়াড়রা হ্যান্ডবলের দাবি নিয়ে রেফারিকে ঘিরে ধরলেও গোলটি বহাল রাখেন তিনি। এমনকি, টিভি রিপ্লেতে পরিষ্কার হ্যান্ডবল দেখা গেলেও ভিএআরও স্বাগতিকদের গোলটি দিয়ে দেয়। ফলে প্রবল আপত্তি স্বত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত হতাশ দ্বিতীয় গোল হজম করতে হয় বার্সেলোনার খেলোয়াড়দের।

একেই লস কোলচোনেরসদের রক্ষণ ভেদ করতে হিমশিম খাচ্ছিল বার্সেলোনার আক্রমণভাগ, তার ওপর দুই গোলে পিছিয়ে পড়ায় চোখে সর্ষের ফুল দেখতে শুরু করেন ফ্লিক। তবে হাল না ছেড়ে দলকে অল-আউট অ্যাটাকে ওঠার নির্দেশই বোধহয় দিয়েছিলেন তিনি। সে কারণেই সম্ভবত দ্বিতীয় গোল হজমের পর আরও উজ্জীবীত হয়ে ওঠে ব্লাউগ্রানারা।

৭০ মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর ১ গোলের লিড হারানোর শঙ্কা উড়িয়ে যখন দুই গোলে এগিয়ে যায় আতলেতিকো, তখন নির্ভার হওয়ার অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে দিয়েগো সিমিওনের চেহারায়। তবে এই স্বস্তি কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মিলিয়ে যায়। কোথা থেকে কেমন করে অতিমানবীয় এক গোল করে বসেন লেভানডোভস্কি।

৭২তম মিনিটে ডিফেন্ডার ইনিগো মার্তিনেসের কাছ থেকে প্রতিপক্ষের বক্সের সামনে বল ধরলে আতলেতিকোর তিন-চারজন ডিফেন্ডার লেভানডোভস্কিকে ঘিরে ধরেন। অসামান্য শরীরী সামর্থ্যের প্রদর্শনে তাদের প্রবল চাপ সামলে কিছুটা এগিয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন তিনি। এরপর বল যখন প্রায় তার কাছ থেকে নিয়েই নিয়েছে প্রতিপক্ষ, ঠিক তখনই লম্বা পা আরও প্রসারিত করে পড়ে যেতে যেতে বলে টোকা দেন ৩৬ বছর বয়সী এই পোলিশ স্ট্রাইকার। তিন যে অমনভাবে বলের নাগাল পেয়ে যেতে পারেন, তা বোধহয় ভাবনাতেও আনতে পারেননি ওবলাক। ফলে বল গোললাইন অতিক্রম করলেও হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় এই স্লোভেনিয়ান গোলরক্ষককে।

এই গোলে চলতি মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে মোট ৪০ ম্যাচ খেলে ৩৫ গোল করে ফেললেন লেভা। তাতে করে এমন এক কীর্তি তিনি গড়েছেন, যাতে ফের একবার উঠে এসেছে লিওনেল মেসির নাম।

বার্সেলোনার জার্সি গায়ে চাপানোর পর থেকে এক মৌসুমে এতগুলো গোল তিনি এই প্রথমবার করলেন তো বটেই, তাছাড়া ২০২০/২১ মৌসুমে মেসির পর বার্সেলোনার প্রথম কোনো খেলোয়াড় হিসেবে এক মৌসুমে তিনি ৩৫ বা তার বেশি গোল করলেন।

সেবার ৪৭ ম্যাচে ৩৮ গোল করেছিলেন আর্জেন্টাইন মায়েস্ত্রো। এবার তার চেয়ে কম ম্যাচ খেলেই এই সংখ্যা ছাড়িয়ে যেতে পারেন পোলিশ গোলমেশিন। অবিশ্বাস্য!

লেভার গোলে পায়ের তলায় যেন মাটি খুঁজে পায় ডুবতে থাকা বার্সেলোনা। বিপুল শক্তিতে সেই মাটিতে পদাঘাত করে ফের শ্বাস নেওয়ার যাত্রা শুরু করে তারা এবং প্রথম গোলের পাঁচ মিনিট পরই রাফিনিয়ার অ্যাসিস্টে দলকে সমতায় ফেরান ফেররান তোরেস।

আক্রমণের গতি ধরে রেখে বক্সের বেশ বাইরে থেকে বদলি নামা ফেররানের দৌড় লক্ষ করে গোলমুখে ক্রস উড়িয়ে দেন রাফিনিয়া, আর দারুণ এক হেডারে তা ঠিকানায় পাঠিয়ে দেন ‘হাঙর’ খ্যাত এই ফরোয়ার্ড।

সমতায় ফেরার পর তৃতীয় গোলের খোঁজে মরিয়া হয়ে ওঠে ফ্লিকের ফুটবলাররা। দুর্দান্ত গতি এবং এপাশ থেকে ওপাশে নিখুঁত সব পাসে একের পর এক আক্রমণ শাণিয়ে আতলেতিকোর রক্ষণ এলোমেলো করে দিতে থাকে তারা। তবে নিখুঁত ফিনিশিং ও ওবলাকের তৎপরতায় কোনোভাবেই ধরা দিচ্ছিল না সাফল্য।

এর মধ্যে ৮২তম মিনিটে আরও একটি ভয়ঙ্কর পাল্টা আক্রমণে উঠে আতলেতিকোকে ফের এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করেন সোরলথ, তবে শেষ মুহূর্তে তাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে বাধ্য করেন পাউ কুবারসি।

আক্রমণের পসরা সাজিয়ে নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট বাকি থাকতে এগিয়ে যাওয়ার আরও একটি সম্ভাবনা জাগায় বার্সেলোনা, তবে এবারও শেষ পাসটি দুর্বল হয়ে যাওয়ায় বিপদে পড়তে পড়তেও বেঁচে যান ওবলাক।

এভাবে নির্ধারিত সময় শেষ হলে ৬ মিনিট অতিরিক্ত খেলার সুযোগ দেন রেফারি। তাতে সমতা নয়, ম্যাচ যে যেকোনো দলের জন্য ফল নিয়ে হাজির হবে, তা বোঝা যাচ্ছিল অনেকটাই। আর অতিরিক্ত সময়ের প্রথম মিনিট যেতে না যেতেই সেটি সত্যি হয়ে ধরা দিল।

ডান পাশে পেদ্রির বাড়ানো পাস ধরে ড্রিবল করে এগিয়ে গিয়ে ‘মেসি জোন’ থেকে কাছের পোস্ট লক্ষ্য করে শট নেন লামিন, তবে তা আতলেতিকো ফুলব্যাক রেইনিল্দো মান্দাভার পায়ে লেগে দিক পরিবর্তন করে বাঁ পাশ দিয়ে গিয়ে জালে আছড়ে পড়ে।

ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা লামিন শেষমেষ ছিন্নভিন্ন করে দেন আতলেতিকোর জমাট রক্ষণ, আর উদযাপন করতে থাকা প্রাণোচ্ছল মেত্রোপলিতানোর গ্যালারিতে ছড়িয়ে পড়ে নীল নীরবতা।

অন্যদিকে, ডাগআউটের পেছনে গ্যালারির ছোট্ট অংশটুকুতে তখন শুরু হয়েছে আতশবাজির মতো করে আনন্দের বিচ্ছুরণ। মাঠের ভেতর ও বাইরে থাকা বার্সেলোনার খেলোয়াড়, স্টাফরা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন।

ম্যাচের একেবারে অন্তিম লগ্নে পিছিয়ে পড়ে যখন কোনোমতে সমতা টেনে সান্ত্বনার উপলক্ষ খুঁজছে আতলেতিকো, তেমন সময় ফের এক গোল করে আতলেতিকোর ঘাড়ে মরণ কামড় বসিয়ে দেন ‘দ্য শার্ক’। এবারও সেই গোলের কারিগর রাফিনিয়া।

ফলে বদলি নেমে জোড়া গোল করে যখন উদযাপনে ব্যস্ত ফেররান, তখন জোড়া অ্যাসিস্টে নিভৃতে নিজের কাজ সেরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন আগামী বছরের ব্যালন দ’রের অন্যতম দাবিদার রাফিনিয়া।

এর ফলে চলতি মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৪২ ম্যাচে ২৭ গোলের পাশাপাশি ২১ অ্যাসিস্ট হয়ে গেল নিজেকে বারবার প্রমাণ করে চলা এক অখ্যাত সুপারহিরোর।

আর ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েও ছয় ছয় মিনিটের মধ্যে জোড়া জোড়া গোল খেয়ে ৪-২ ব্যবধানে হেরে মাঠ ছাড়ে শিরোপার আশায় গত গ্রীষ্মে কাড়ি কাড়ি অর্থ খরচ করে দল গোছানো আতলেতিকো মাদ্রিদ।