রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল অপারেটর টেলিটক ২০ বছর পার করলেও অন্যান্য অপারেটর থেকে এখনো পিছিয়ে


রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল অপারেটর কোম্পানি টেলিটক ২০ বছর পার করলেও অন্যান্য অপারেটর থেকে এখনো পিছিয়ে আছে।শতবাগ ফোর-জি নেটওয়ার্কে এখনো পৌঁছাতে পারেনি। দিন দিন বাড়ছে নেটওয়ার্ক সমস্যা, কমছে গ্রাহক সংখ্যা।
অন্যদিকে টেলিটকের টাওয়ারগুলোর পর্যাপ্ত ব্যাটারি ব্যাকআপ না থাকায় বিদ্যুৎ চলে গেলে ৮৩০ টাওয়ারের গ্রাহকরা নেটওয়ার্ক পান না। এক ঘণ্টার বেশি সময় বিদ্যুৎ না থাকলে টেলিটকের প্রায় ৪০ শতাংশ টাওয়ার সংযোগ দিতে পারে না। কারন বেস ট্রান্সসিভার স্টেশন (বিটিএস) প্রয়োজন ১৫ হাজারের বেশি কিন্তু তাদের আছে মাত্র ৫৬৬১ টি বিটিএস।
২০০৪ সালে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টেলিটক প্রথম প্রতিষ্ঠা হয়।দেশে টেলিকমিউনিকেশন সেবা নিশ্চিত, একইসঙ্গে খাতটিতে সুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি করতে এ মোবাইল ফোন অপারেটরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠার ২০ বছর পরও সরকারের পক্ষ থেকে প্রচুর সুবিধা পেয়েও এ মোবাইল ফোন অপারেটরটি অন্যান্য অপারেটরদের সাথে
প্রতিযোগিতায় দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। গ্রাহক সংখ্যা মাত ৬৫ লাখ।
টেলিটক কর্তৃক দাবী করছে ইনভেস্ট ছাড়া বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব না। বেসরকারি মোবাইল কোম্পানিগুলো ৩০/৪০ হাজার কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছে অথচ টেলিটকের ইনভেস্ট মাত্র ৫ হাজার কোটি টাকা।
টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৯-২০ সালের মধ্যে ৫৮৫০টি বেস ট্রান্সসিভার স্টেশন (বিটিএস), ২০২০-২১ সালের মধ্যে ৯৫১০টি, ২০২১-২২ সালের মধ্যে ১২৫১০টি, ২০২২-২৩ সালের মধ্যে ১৩৩১০টি এবং ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে ১৫৫১০টি বিটিএস স্থাপন করার কথা ছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের মধ্যে এই টার্গেট ফিলাপ করতে পারেনি। বর্তমানে বিটিএস আছে মাত্র ৫৬৬১ টি।
অন্যদিকে টেলিটকের গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধির টার্গেট ছিল : ২০২০ সালে তা ৭০ লাখ, ২০২১ সালে ১ কোটি, ২০২২ সালে ১ কোটি ৫০ লাখ এবং ২০২৪ সালে ২ কোটি গ্রাহক বৃদ্ধি করার লক্ষ্য মাত্রা ছিল। কিন্তু বর্তমানে টেলিটকের গ্রাহক আছে ৬৫ লাখ।
টেলিটক সিম ব্যবহারকারী নুরুল ইসলাম খোকন ইউএনবিকে জানান, সম্প্রতি আমার ফোনটি ছিনতাই হয়ে যায়। পরেরদিন টেলিটকের সার্ভিস সেন্টারে যোগাযোগ করি সিম রিপ্লেসমেন্ট করার জন্য। টেলিটকের সার্ভিস সেন্টার থেকে জানানো হলো আরও ২/১ দিন পরে আসুন। কারন জানতে চাইলে তারা বলেন, ট্যাকনিকেল/ সার্ভারে সমস্যা আছে।
তিনি আরও বলেন, একটা সিম রিপ্লেসমেন্ট করতে যদি এত সময় লাগে, তাহলে গ্রাহক সেবা কিভাবে দিবে। আমি মনে টেলিটক গ্রাহকদের এরকম অনেক অভিযোগ রয়েছে।টেলিটকের সার্ভিস খুবই খারাপ। গ্রামে গেলে ঠিকমত ফোর-জি নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। কল ড্রপ তো আছেই। রাস্ট্রীয় একটা প্রতিষ্ঠানের এই অবস্থা হতে পারে না।
এ বিষয়ে টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল মাবুদ চৌধুরী ইউএনবিকে বলেন, টেলিটকের গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য দেশের সকল পোস্ট অফিসের মাধ্যমে সিম বিতরন করবো, একটা প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। পোস্ট অফিসের সাথে এমইও সাইন হয়েছে। পাইলট বেসেজ রাজশাহীতে চালু করেছি॥ পর্যায়ক্রমে সব জায়গায় সিম সরবরাহ করা হবে।
তিনি আরও জানান, দুই ভাবে সিম দেয়া হবে, কেহ চাইলে অনলাইনে নিতে পারবে, তাহলে আমরা বাসায় পৌঁছে দিব, আরেকটি হলো সরাসরি পোস্ট অফিস থেকে নিতে পারবে।
বর্তমানে ডিলার আছে ৭০-৮০ জন । তাদের অধীনে রিটেইলার আছে।৪/৫ হাজার রিটেইলার আছে। এছাড়াও ৯০ টি কাস্টমার কে কেয়ার আছে। এখানে গ্রাহকে যত সেবা আছে দিচ্ছি।
ডিলার রিটেইলটাররা গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে পারছে না, এটি জানার পর তাদের পারফরম্যান্স অনুযায়ী প্রনোদনা দেয়া হবে, উৎসাহ দেয়ার জন্য।
এমডি বলনে, অন-গয়িং প্রজেক্ট গুলোতে আমার জোর দিচ্ছি। ব্যাটারী ডাউন হয়ে গেলে সমস্যা হয়, এই অভিযোগ আছে, পেপার পত্রিকায় আসে। এজন্য একটা ৫০ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছি। গত সেপ্টেম্বর মাসে প্ল্যানিং কমিশনে অনুমোদন করিয়েছি। পিডি নিয়োগ দিয়েছি। কাজ অনেক এগিয়েছে। অর্থ ছাড় পেলে জুন ২০২৫ মধ্যে শেষ করতে পরবো। এর ফলে আমাদের ১০০০ সাইটের পাওয়ার সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।
এর ফলে গ্রাহক সেবা নিশ্চিত হবে। কোন কারনে পাওয়ার না থাকলেও তখন সেবা পাবে।
পাশাপাশি আমাদের একটা ৫ জি প্রজেক্ট চলেতেছে। এই প্রজেক্টে ৩ হাজার বিটিএস, তারমধ্যে ১০০০ বিটিএস ফোর জি নতুন সংযোগ করছি, ২০০০ বিটিএসে ফোর জি টা আপগ্রেড করে দিচ্ছি। দ্রুত কাজ চলছে। অলরেডি ২০০০ সাইট করে ফেলেছি, বাকী ১০০০ সাইট দ্রুত শেষ হবে। সাথে নতুন বিটিএস আছে ৩০০০ । তারমধ্যে ৭০০ বিটিএস আমরা নিজেরা করবো, আর ২৩০০ বিটিএস আমরা ভারায় মাধ্যমে করবো ইনফাক্টচার কো: মাধ্যমে করবো।
তিনি বলেন, আরেকটি প্রকল্প আছে, চায়না সরকারের সাথে জি টু জি ।ইতিমধ্যে টেন্ডারে তিনজন ভিডার ড্রপ করেছে। এখানে চায়না একটা একটা ঠিকাদার কোম্পানী ঠিক করে দিবে।আমাদের প্রক্রিয়াগত কাজ শেষ করে অনুমোদনের জন্য একনেকে পাঠাবো। একনেক অনুমোদন দিলে তাদরে সাথে চুক্তি হবে। চুক্তি হলে গেলে এখানেও আমরা ২০০০ বিটিএস স্থাপন করতে পারবো।
আরেক প্রশ্নে তিনি পুরো দেশ টা যদি ভাল নেটওয়ার্ক দিয়ে কাভারেজ করতে হয় তাহলে আমাদের লাগবে ১৫০০০ বিটিএস। আমাদের আছে মাত্র ৫৬৬১ টি। অনগয়িং ৩০০০ আর চায়না সাথে জি টু জি টা যদি হয়ে যায়, তাহলে আমাদের প্রায় ১০,০০০ বিটিএস হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের ঘাটতি থাকবে ৫০০০ বিটিএস। এই ৫০০০ বিটিএসের জন্য আরেক টি প্রকল্প নিচ্ছি ।তারমধ্যে ১৬০০ বিটিএস ফাইভ- জি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। সেটি শুরু হবে ফাইভ- জি দিয়ে।ইতিমধ্যে ভুয়েটের মাধ্যমে ফিজিভিলিটি স্টাডি হয়েছে। এটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি। এরপর এটি একনেকে যাবে। একনেকে অনুমোদন হলেই কাজে যেতে পারবো।
এসব প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন কি সুবিধা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই প্রকল্প গুলো বাস্তবায়ন হলে আমরা অন্যান্য মোবাইল অপারেটর সাথে প্রতিযোগিতায় যেতে পারবো।
টেলিটক রাস্ট্রীয় ও দেশীয় কোম্পানি হওয়ায় পরও কেন বিদেশী বা প্রাইভেট কোম্পানির সাথে টিকে থাকতে পারছে না। দেশের অনেক টাকা বিদেশী কোম্পানি নিয়ে যাচ্ছে। এখানে আমাদের কোথায় ঘাটতি আছে। এমন প্রশ্নে এমডি বলেন, একদাগে বলতে গেলে আমাদের ইনভেস্টমেন্ট সেভাবে হওয়ার কথা ছিল সেভাবে আসলে হয়নি। প্রাইভেট কোম্পানি যেমন গ্রামীন ফোন ৪০ হাজার কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছে। আমাদের চেলিটকে সরকার দিয়েছ সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা, আর আমরা দিয়েছি ১৫০০ কোটির মতো।সব মিলিয়ে ৫০০০ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে ৪০ হাজার কোটির সাথে পারার কোন কারনেই নাই। আরেকটি হচ্ছে তো প্রকিউরম্যান পলিসি মেইনটেইন করতে হয় না। আমাদের তো অনেক পলিসি মেইনটেইন করতে হয়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের একটা প্রকল্প পাস হতেই বছর ২ লেগে যায়। সেটি বাস্তবায়ন করতে ২/৩ বছর লেগে যায়। অতএব আমরা একটা প্রকল্প ইনক্লিমেন্ট করতে ৫ বছর সময় লেগে যায়। সেটা তারা ৫/৬ মাস বা ১০ মাসে করে ফেলতে পারে। এই জন্য তারা এগিয়ে যায়। কারন তারা তো নিজস্ব ব্যক্তি মালিকানাধীন। তারা ইজিলি মেইন্টেইন করতে পারে।
তিনি বলেন, পাবলিক মানি মানেই আমাদের জবাবদিহিতা থাকবেই । এই সেক্টরে জানেন টেকনোলজি টা দ্রুত চেইন্জ হয়ে যায়। আমরা যখন টু-জি আনছি, তখন কিন্তু আমরা অন্যান্য অপারেটর তুলনায় সক্ষম ছিলাম। যখন থ্রিজি আসছে, তখন আমরা পাইয়নিয়ার ছিলাম। তারা থ্রিজি করে-ফোর জি করে ফেলছে, আমরা ফোর জি তে পিছিয়ে পড়েছি। চলমান প্রজেক্ট করতে পারলে আমরা ফোর জি তাদের মতো যেতে পারবো
অন্যান্য অপারেটর সাথে তাল মিলিয়ে কবে নাগাদ ফোর জি তে সক্ষমতা অর্জন করতে পারবো । এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, চায়নার সাথে জি টু জি প্রকল্প মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত। আমাদের তো ফোর জি আছে। তবে আশা করছি অন্যান্য অপারেটর সমপর্যায়ে ফোর-জি তে যেতে পারবো ২০২৬ সালের মধ্যে।
আর ফাইভ-জি প্রজেক্ট যদি পেয়ে যায়, তাহলে কিছু জায়গায় ফাইভ-জি আমরা চালু করতে পারবো।
গ্রাহক সংখ্যা কি কমছে না বাড়ছে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন,জুন মাসের পর গ্রাহকের মধ্যে যে একটা টানাপোড়ন ছিল, যেমন
অন্যান্য অপারেটরদের প্রায় ৪৯ হাজার গ্রাহক কমেছে এমন একটা নিউজ হয়েছিল, কিন্তু তখন আমাদের গ্রাহক কমে নাই।
মোট গ্রাহক সংখ্যা কত? জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোট ৬৫ লাখ। তারমধ্যে সবাই প্রায় ফোর -জি পাচ্ছে। কিন্তু কিছু জায়গায় নেটওয়ার্ক হয়ত থ্রিজি পাচ্ছে না, সেখানে হয়ত একটু সমস্যা হচ্ছে।
তিনি বলেন, টেলিটকের স্টাফ আছে ৫০০ মতো। আর আউসোসিং মিলিয়ে ১০০০ মতো হবে। সে হিসেব অন্যান্য অপারেটরের স্টাফ বেশি, তারা থার্ট পার্টি দিয়েও অনেক কাজ করে। তাছাড়া তাদের স্টাফদের বেতন আমাদের থেকে অনেক বেশি।
অন্যান্য অপারেটর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আরও কত সময় লাগবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০২৬ সালের মধ্যে আমাদের সকল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারলে অন্যান্য অপারেটরদের সাথে অনেকটাই তাল মিলিয়ে চলতে পারবে চেলিটক।
তিনি আরও বলেন, অন্যান্য অপারেটর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে প্রাইভেট অপারেটরদের মতো আমাদের ইনভেস্টমেন্ট থাকলে থাকতে হবে। ইনভেস্ট ছাড়া বাজারে প্রতিযোগিতায় থাকা সম্ভব না।
অন্যান্য অপারেটর থেকে টেলিটকের কলড্রপ অনকে কম বলে দাবী করেছেন এই এমডি।