বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটি ও শিডিউল বিপর্যয়ের ঘটনায় যাত্রীসেবা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন উড়োজাহাজ কেনা বা ইজারা নেওয়ার আগে বিমানের ব্যবস্থাপনা সংস্কার, দক্ষ পাইলট-ইঞ্জিনিয়ার ও কেবিন ক্রু তৈরি করা জরুরি। তারা মনে করেন, অদক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিমান চালালে আরও সংকটে পড়বে প্রতিষ্ঠানটি।
অ্যাডহক বেসিস কিংবা আমলাতন্ত্রের অদক্ষ লোক দিয়ে বিমানের কার্যক্রম পরিচালনা করলে হবে না। স্থায়ী, দক্ষ ও কমার্শিয়াল লোকজন দিয়ে তা করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এয়ারক্রাফট কেনার ক্ষেত্রে ছোট এয়ারক্রাফট বা রিজনাল এয়ারক্রাফট ক্রয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ রিজনাল এয়ারক্রাফটে মেইনটেন্স খরচ কম।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনা ঘটছে। কোনো উড়োজাহাজ মেরামতের পর উড্ডয়ন করছে, কোনোটা গ্রাউন্ডেড করা হচ্ছে। নিয়মিত শিডিউল বিপর্যয়ের পাশাপাশি বাতিল হচ্ছে ফ্লাইট। এর খেসারত দিতে হচ্ছে যাত্রী ও বিমান কর্তৃপক্ষকে।
গত এক মাসে দেশি-বিদেশি রুটে অন্তত ৯টি উড়োজাহাজে বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি শনাক্ত হয়েছে। যদিও বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো গেছে, তবে এসব ঘটনায় যাত্রীসেবা ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
বিমান সুত্রে জানা যায়, যাত্রী ভোগান্তি কমাতে দুটি উড়োজাহাজ লিজ (ইজারা) নেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এর পাশাপাশি নতুন উড়োজাহাজ কেনার পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং বাড়তি শুল্ক প্রত্যাহারে কূটনৈতিক আলোচনার অংশ হিসেবে মার্কিন উড়োজাহাজ নির্মাতা কোম্পানি বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। বিমান ক্রয়ের বিষয়টি সরকার ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করবে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র থেকে জানা গেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এমন সিদ্ধান্ত জানালেও বিমান বাংলাদেশ এখনো কোনো চুক্তি করেনি বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।
এ বিষয়ে বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ও এভিয়েশন বিশ্লেষক কাজী ওয়াহিদুল আলম ইউএনবিকে বলেন, ‘নতুন উড়োজাহাজ ক্রয় ও লিজ নেওয়ার আগে ম্যানেজমেন্ট ঠিক করতে হবে। বিমানের ব্যব্যবস্থাপনা আরও গতিশীল করতে হবে। পাশাপাশি অভিজ্ঞ পাইলট, ইঞ্জিনিয়ার ও কেবিন ক্রু তৈরি করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের এয়ারক্রাফট সংকট আছে। অনেক এয়ারক্রাফট লাগবে, এটা ঠিক। তবে বিমানে পরিচালনা-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতাও লাগবে। আগে প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে হবে, তারপর এয়ারক্রাফট কিনতে হবে।’
এই এভিয়েশন বিশ্লেষক বলেন, ‘আমাদের দক্ষ পাইলট, ইঞ্জিনিয়ার ও কেবিন ক্রু তৈরি করতে হবে। দেশের বাইরে থেকে পাইলট, ইঞ্জিনিয়ার ও কেবিন ক্রু আনতে গেলে অনেক টাকার প্রয়োজন। বিদেশ থেকে নিয়োগ দিলে তাদের বেতন দিতে হবে প্রায় ১০ হাজার ডলার। তাই দেশেই দক্ষ জনবল তৈরী করতে হবে আগে।’
তিনি বলেন, ‘অ্যাডহক বেসিস বা ব্যুরোক্রেসির অদক্ষ ম্যানেজমেন্ট দিয়ে বিমান চালালে হবে না। স্থায়ী দক্ষ ও কমার্শিয়াল লোকজন দিয়ে বিমান চালাতে হবে।’
‘আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এয়ার ক্রাফট ক্রয় করার ক্ষেত্রে ছোট এয়ারক্রাফট বা রিজনাল এয়ারক্রাফট ক্রয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ আমাদের লং রুট কম, শর্ট রুট বেশি। তাছাড়া ছোট বা রিজনাল এয়ারক্রাফটে মেইনটেন্স খরচও কম, বড় এয়ারক্রাফটে যা অনেক বেশি।’
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের জন্য কী ধরনের বিমান দরকার, সেটি আগে স্টাডি করে তারপর বিমান কিনতে যাওয়া উচিৎ। মনে রাখতে হবে, আমাদের লং রুট মাত্র ৪/৫টি দেশের সঙ্গে। শর্ট রুটই বেশি আমাদের। ১২টি ছোট এয়ারক্রাফট কিনলে ৮টি বড় এয়ারক্রাফট কেনা যেতে পারে। ছোটর মধ্যে ৭৩৭, আর বড় কিনলে ৭৭৭/৭৮৭ এয়াক্রাফট।’
একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বহরের বেশিরভাগ উড়োজাহাজ অনেক পুরনো হওয়ায় সমস্যা নিয়মিত দেখা দিচ্ছে। আরও তদারকি বাড়াতে হবে। তবে এসব ত্রুটি প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’
‘যেহেতু উড়োজাহাজগুলো পুরনো, তাই নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষা করতে হবে। ইঞ্জিনিয়ার ও পাইলট নিয়োগে স্বজনপ্রীতি করা যারে না। যোগ্য লোক নিয়োগ দিতে হবে।’
বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে রয়েছে ১৯টি উড়োজাহাজ। এর মধ্যে ১৪টি যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং এবং ৫টি কানাডার ড্যাশ-৮ কিউ৪০০ মডেলের। বোয়িংয়ের উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে রয়েছে ৪টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০, ৪টি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, ৪টি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার ও দুটি বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার।