প্রশাসনে স্বচ্ছতার জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দ্রুত সংস্কারের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
প্রশাসনে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা আনতে হলে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও পদায়ন পদ্ধতি সংস্কারে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা।
অন্যদিকে, জনপ্রশাসন সংস্থার কমিশন বলেছে, জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন ব্যবস্থা করাই এই কমিশনের মুল লক্ষ্য। এ বিষয় নিশ্চিত করতে বেশ কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা। নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতির ক্ষেত্রে আইনগত ও কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে বলেও মনে করেন তারা।
রাষ্ট্রের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে রয়েছে জনপ্রশাসন।
গত ৩ অক্টোবর আট সদস্যের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ কমিশনের প্রধান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। জনমুখী, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক, নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এ কমিশন গঠন করা হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়। ৯০ দিনের (৩ মাস) মধ্যে প্রস্তুত করা প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হবে।
সাবেক সচিব মোহাম্মদ তারেক এবং মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. হাফিজুর রহমান এবং রিজওয়ান খায়ের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এ ফিরোজ আহমেদ এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবে রয়েছেন।
এ বিষয়ে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান ইউএনবিকে বলেন, প্রশাসনে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা আনতে হলে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও পদায়ন পদ্ধতি সংস্কারে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, পদায়ন, পদোন্নতি- এগুলো ঠিক করতে পারলে, স্বচ্ছতা আনতে পারলে সব ঠিক হয়ে যাবে। জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ প্রশাসণ করতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে কঠিন নীতিমালা ও কার্যকরী ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘প্রশাসনে নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, পদায়ন, পদোন্নতি- এসব ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে এবং তা কার্যকর করতে হবে। এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে নীতিমালা রয়েছে, তবে এটি যে যার ইচ্ছামতো ব্যবহার করে। যে ব্যাচ নীতিমালা তৈরির সময়ে থাকে, তারা লাভবান হয়। যে ব্যক্তি নীতিমালা তৈরির সঙ্গে থাকে তার ব্যক্তি চিন্তা থাকে, সে যেন লাভবান হয়। এটা যেন ভবিষ্যতে না হয়, সে বিষয়ে সংস্কার কমিশনকে খেয়াল রাখতে হবে।’
সাবেক সচিব বলেন, ‘পদায়ন, বদলি ও প্রশিক্ষণের জন্য নীতিমালা আছে। কিন্তু এগুলোর ফাঁক-ফোকরও আছে, সেটাও আমরা জানি। তদবির কীভাবে সব পরিবর্তন করে দেয় সেটাও আমরা জানি। এজন্য পদায়ন ও বদলির ক্ষেত্রে একেবারে সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে।’
সাবেক এই সচিব বলেন, ‘জনগণকে সেবা দিতে হবে, যারা চাকরি করবেন তাদের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হবে যে তাদের কাজ হলো জনকল্যাণ। রাষ্ট্রের মালিক হবেন না। সংবিধান অনুযায়ী মানুষের সেবা করাই হবে তাদের কাজ। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে, তদারকির মাধ্যমে এটা করতে হবে।’
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া ইউএনবিকে বলেন, ‘পদোন্নতির বর্তমান প্রক্রিয়াটাই মান্ধাতার আমলের। এমন প্রক্রিয়া পৃথিবীর অনেক দেশেই নেই। এক্ষেত্রে যদি পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনা হয়, তাহলে রাজনৈতিক বিবেচনায়ও কাউকে পদোন্নতিবঞ্চিত করতে পারবেন না।’
তিনি বলেন, ‘এখন জনবল কাঠামো যেভাবে আছে, সেটা অনেক পুরোনো, সঠিকভাবে নেই। সংস্কারের জন্য আইনগত ও কাঠামোগত দুটি পরিবর্তনই প্রয়োজন হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক নতুন পদের প্রয়োজন হতে পারে। তাই সার্বিকভাবে প্রশাসনের কাঠামোটা পরিবর্তন করতে হবে।’
সাবেক অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব থাকা উচিত নয়। পিএসসিতে (সরকারি কর্ম কমিশন) রাজনৈতিক বিবেচনায় চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়। সার্চ কমিটির মাধ্যমে যোগ্যদের এখানে বসাতে হবে।’
জনপ্রশাসন সংস্থার কমিশনের চেয়ারম্যান প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী ইউএনবিকে বলেন, ‘গত ১৪ অক্টোবর সচিবালয়ে কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীসহ মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি- আলোচনা করব, বিভিন্ন এলাকায় যাব। জনগণের কথা শুনব। স্থানীয় যারা চাকরি-বাকরি করে তাদের কথা শুনব। চেম্বারের সঙ্গে আলোচনা করব। এসব আলোচনা করেই আমরা প্রকৃত কাজটি শুরু করব।'
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই এই কমিশনের মূল লক্ষ্য। আমরা সেভাবেই কাজ করব।’
কমিশন প্রধান বলেন, 'আজকে আমরা আলোচনা করেছি সার্বিক বিষয়ে কী হতে পারে। এখন আমরা এটাকে আস্তে আস্তে প্রক্রিয়াজাত করব, এগিযে যাব। তিন মাসের মধ্যে করার কথা, কাজেই দুই মাস পরে গিয়ে তখন সত্যিকার অর্থে একটা রূপরেখা পাব। আমাদের মধ্যে আলোচনা করতে হবে, আমরা তো এটা আলোচনা করে করেই এগোব।'
কমিশনের অগ্রাধিকার কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সরকার যেটা ঠিক করে দিয়েছে সেটাই আমাদের অগ্রাধিকার। আমাদের অগ্রাধিকার কী হবে সেটাই নির্ধারণ করতে আমাদের আরও সময় লাগবে।’
তিনি বলেন, জনপ্রশাসন সংস্কার করতে পারলে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও পদায়নে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি কমে আসবে।
তিন মাসের মধ্যে সংস্কারের সুপারিশ প্রতিবেদন দাখিল করতে পারবেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকার তিন মাস সময় দিয়েছে। আমাদের অবশ্যই চেষ্টা থাকবে তিন মাসের মধ্যেই করার।’