প্রশাসনের শীর্ষ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সর্বোচ্চ, কাজে স্থবিরতা


বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে প্রশাসনের শীর্ষ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। জনপ্রশাসনে শীর্ষ কর্মকর্তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ থামছে না। মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থায় শীর্ষ পদে বা সচিব ও সমমর্যাদার পদে ধারাবাহিকভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
এতে নিয়মিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে পদোন্নতির সুযোগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পদোন্নতির স্বাভাবিক ধারা ব্যাহত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হচ্ছে এবং কর্মস্পৃহা ও উদ্দীপনা কমে যাচ্ছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে চুক্তিতে থাকা কর্মকর্তাদের নিয়োগ বাতিল করলেও বর্তমান সরকার নিজেরাই একের পর এক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে চলেছে। বাড়ছে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) সংখ্যা, যার ফলে সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে, নিয়মিত কর্মকর্তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ জমছে।
প্রেক্ষাপট
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। ওই দিনই মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত হয়। পরদিন, ৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি। এরপর ৮ আগস্ট শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এর পর থেকেই প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যারা দীর্ঘদিন চাকরি থেকে বাইরে ছিলেন, দীর্ঘ ৭/৮ বছর পর তাদের হঠাৎ চুক্তিতে ফিরিয়ে আনা হলে কাজ বোঝার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। ফলে মন্ত্রণালয়ের স্বাভাবিক কাজের গতি কমে গেছে। এছাড়াও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে সচিব, সিনিয়র সচিব ও সমমর্যাদার পদ রয়েছে ৮৪টি। এর মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিবসহ সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে ১৭ জন কর্মকর্তা চুক্তিতে রয়েছেন। এর আগে শীর্ষ পদে একসঙ্গে এতসংখ্যক কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাননি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে, সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে মোট ওএসডি আছেন ১২ জন। তবে বর্তমানে অন্যান্য পদে প্রশাসনে সবমিলিয়ে প্রায় ৫ শতাধিকের উপরে ওএসডি কর্মকর্তা রয়েছেন।
বর্তমানে শীর্ষ পদে যারা চুক্তিতে আছেন
৫ আগস্টের পর যারা চুক্তিতে, যেসকল কর্মকর্তা রয়েছেন তাদের মধ্য, মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশিদ, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমুল গনি, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সিনিয়র সচিব) এমএ আকমল হোসেন আজাদ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হক, নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. নেয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়া, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এএসএম সালেহ আহমেদ, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ।
এ ছাড়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী, ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান (সচিব) এজেএম সালাহউদ্দিন নাগরী, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) কাইয়ুম আরা বেগম, বিশ্বব্যাংকে বিকল্প নির্বাহী পরিচালক শরীফা খান, সচিব মর্যাদায় পর্তুগালে বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত মো. মাহফুজুল হক চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন।
চুক্তি বাড়ার কারণ হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা ইউএনবিকে জানান, আওয়ামীলীগ সরকারের দীর্ঘ সময় শীর্ষ পদে থাকা বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে ওএসডি থাকতে হচ্ছে। তাদের বছরের পর বছর পদোন্নতি দেয়নি। তাদের সময়ে সময়ে দলীয়করণ ও নিয়ম-নীতিহীন পদায়ন-পদোন্নতির কারণে নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে গত সরকারের সময়ে বঞ্চিত আমলাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হয়। যে কারণে পট পরিবর্তনের পর পরিস্থিতির প্রয়োজনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বেড়েছে।তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ কমে যাবে
এসব কর্মকর্তা আরও জানান, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী আমলাদের ওএসডি করা হয়, অনেককে আবার বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ বিষয়ে- ‘বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম’- এর সভাপতি সাবেক সচিব এবিএম আবদুস সাত্তার ইউএনবিকে বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ভারে প্রশাসন ন্যুব্জ। ফ্যাসিস্ট আমলেও মতোই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ধারা অব্যাহত রেখেছে।
‘এমনকি ফ্যাসিস্ট সরকারের দেওয়া চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হবে এই মর্মে ঘোষণা দিয়েও কোনো কোনো কর্মকর্তার চুক্তি অব্যাহত রেখেছে। চুক্তি বাতিল করে আবার নতুন করে একই ব্যক্তিকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে,’ যোগ করেন তিনি।
‘কোনো কোনো পদে পূর্ব পরিচয়, বিশেষ যোগসূত্র বা অজ্ঞাত কারণে কোনো প্রক্রিয়ায় অনুসরণ ব্যতিরেখে ভিনদেশী নাগরিককেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে বর্তমান সরকার। আবার কোনো কোনো পদে ফ্যাসিস্ট সহযোগী, বিতর্কিত ও ১/১১ এর দোসর কর্মকর্তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’
সাবেক এই সচিব বলেন, এসব কর্মকর্তা দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির করার কাজে সচেষ্ট আছে। শুধু তাই নয়, ক্ষেত্রে বিশেষ উপদেষ্টাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। তাদের লক্ষ্য প্রশাসন ও সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে নির্বাচন বিলম্বিত করা ও অনৈতিক ফয়দা লাভ করা। কাজেই অবিলম্বে সকল চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রশাসনকে গতিশীল করা ও আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু-নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সকল চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। সিভিল প্রশাসনে কর্মরত ক্যাডার, নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যারা ফ্যাসিস্টদের দোসর ও দুর্নীতি পরায়ন তাদেরকে অবিলম্বে চাকরি থেকে অপসারণ এবং আইনের আওতায় আনতে হবে।
একই বিষয়ে সাবেক সচিব একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার ইউএনবিকে বলেন, ‘চুক্তিতে বেশি নিয়োগ দিলে যারা নিচ থেকে ওপরে উঠে আসার জন্য অপেক্ষা করছেন, তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। তাই চুক্তি কমিয়ে আনতে হবে। অন্যদিকে ওএসডি ব্যবস্থা, সেটি পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। এটি শুধু আমাদের দেশে। আর ওএসডি সরকারের একটি মহা অপচয়। ওএসডি ব্যবস্থায় মূলত কোনো কাজ করানো ছাড়াই এই বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিতে হচ্ছে সরকারকে। এই ব্যয় এক ধরনের অপচয়ের শামিল।
১২ জন ওএসডি সচিব
১২ জন ওএসডি সিনিয়র সচিবদের মধ্যে রয়েছেন মো. মোস্তফা কামাল, মো. মশিউর রহমান ও মো. মনজুর হোসেন। সচিব হিসেবে ওএসডি আছেন মো. সামসুল আরেফিন, মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, মো. আজিজুর রহমান, মো. নুরুল আলম, মো. খায়রুল আলম শেখ, ফরিদ উদ্দিন আহমদ, রেহানা পারভীন, শফিউল আজিম ও একেএম মতিউর রহমান।
সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) ওএসডি
আওয়ামী লীগের আমলে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারদের (এসপি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ৩৩ কর্মকর্তাকে গত ১৯ জানুয়ারি ওএসডি করা হয়, যারা যুগ্মসচিব হিসেবে বিভিন্ন দপ্তরে দায়িত্ব পালন করছিলেন। একই কারণে এর আগে ১২ কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়। আর বিতর্কিত নির্বাচনে ডিসি ও এসপি থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছর বা এর বেশি, তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। সেই অনুযায়ী ২০ জানুয়ারি ২২ জন সাবেক ডিসিকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নিয়োগ পদোন্নতি শাখা থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার আমলে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে বিএনপি-জামাত ট্যাগ লাগিয়ে বহু কর্মকর্তাকে বছরের পর বছর ওএসডি করে রাখা হয়। অনেককেই ওই অবস্থায়ই নীরবে চোখের জল ফেলে চাকরি থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৬ বছরে কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যেখানে চাকরির মেয়াদ শেষে আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের পুরস্কার ছিল এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ।