একদিকে সর্বস্ব হারানোর বেদনা, অন্যদিকে শীত ও খাদ্যের অভাব
এক নিমেষে সব শেষ। মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) সন্ধ্যার লেলিহান শিখা কেড়ে নিল কড়াইল বস্তির হাজারো মানুষের আশ্রয় আর স্বপ্ন। যে বস্তিতে দেড় সহস্রাধিক ঘর ছিল জীবনের শেষ সম্বল, আজ সেখানে শুধুই পোড়া কাঠ, ছাই আর বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর কড়াইল বস্তির মানুষ এখন চরম এক মানবিক বিপর্যয়ের মুখে, যেখানে শীত আর ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে চলছে বেঁচে থাকার কঠিন সংগ্রাম।
বুধবার (২৬ নভেম্বর) সকালে ঘটনাস্থলে দেখা মিলল এক করুণ দৃশ্যের। তখনও ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠছে ধোঁয়া, আর সেই ধোঁয়ার গন্ধ যেন মিশে আছে স্বজন হারানোদের বোবা কান্নায়। ভিটেমাটি হারানো মানুষগুলো তাদের পোড়া ঘরের আশপাশে বসে আছেন, কেউ কেউ ছেঁড়া কাপড় আর পলিথিন বিছিয়ে তৈরি করেছেন অস্থায়ী আশ্রয়। খোলা আকাশের নিচে এই কষ্টের রাত কাটানো মানুষগুলোর চোখে এখন শুধুই শূন্যতা।
সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছেন অসহায় শিশু ও বৃদ্ধরা। যারা এক মুহূর্তে নিজেদের সামান্য উষ্ণতাটুকুও হারিয়েছেন। তাদের ভেজা কাপড় শুকিয়ে নেওয়া আর পুড়ে যাওয়া মালামালের স্তূপে ক্ষীণ আশায় শেষ সম্বল খোঁজার দৃশ্য হৃদয় বিদারক।
ভ্যানচালক মফিজুল ধ্বংসস্তূপের ভেতর খুঁজছিলেন কিছু একটা। বাংলাপোস্টকে তিনি জানান, ‘সব তো পুইড়া শেষ, কিছুই নাই। কিছুই বাইর করতে পারি নাই। দেখি পোলাপাইন তো শীতে কষ্ট পাইতাসে, দেখি মোটা কিছু পাই নি।’
দিনমজুর রাইসু কথা বলতে গিয়ে ভেঙ্গে পড়েন কান্নায়। ‘কিস্তির ট্যাকা রাখসিলাম ঘরের ভিতরে, ঘরই তো নাই আর, এই ট্যাকা এখন কেমনে দিমু? আমার সব শ্যাষ হইয়া গেলো।’
গৃহকর্মী রোজিনা একপ্রকারে ক্ষোভের সুরেই বলেন, ‘হারাডা রাইত ঘুমাইবার পারি নাই, খাই নাই, কেউ একবার আইসা জিগায়ও না খাইসি দাইসি কি না। খালি আহে, ফডো তুইলা নিয়া যায়। আমাগো কষ্ট দেহার কেউ নেই।’
ভ্যানচালক মফিজুল কিংবা গৃহকর্মী রোজিনা। তাদের বলার ভাষা ভিন্ন হলেও তাদের মতো একই হাল বাকি বস্তিবাসীদেরও। একদিকে সব হারানোর অসহনীয় বেদনা, অন্যদিকে হাড় কাঁপানো শীত আর একমুঠো খাবারের অভাব তাদের জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ।
এর আগে গতকাল বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে বস্তির বৌবাজারের একটি ঘরে আগুনের সূত্রপাত হয়। ঘিঞ্জি এলাকা এবং শুকনো বাতাসের কারণে আগুন দানবের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট আপ্রাণ চেষ্টা করেও সংকীর্ণ পথ আর পানির অভাবে শুরুতে অসহায় হয়ে পড়ে। অবশেষে লেক থেকে পাইপ টেনে এনে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা দুঃসাহসিক লড়াইয়ের পর রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে সেই বিভীষিকাময় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আর ১৬ ঘণ্টা পর নিভে ভয়াবহ সেই আগুন।
এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আরও একবার আগুন লেগেছিল কড়াইল বস্তিতে। এই ঘটনা মনে করিয়ে দেয় কেবল একটিই কথা। আগুন আর কড়াইল বস্তি যেন একই সূতায় গাঁথা।
