অতিরিক্ত রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে যা করবেন


রাগ একটি স্বাভাবিক আবেগ। রাস্তায় চলাচল করার সময়, সামাজিক মাধ্যমে বা কোনো রাজনীতিবিদের সমালোচনা করার সময় মানুষের ক্ষোভ যেভাবে প্রকাশিত করে, তা থেকে মনে হবে পুরো পৃথিবীর মানুষ চিরস্থায়ী ক্রোধের মধ্যে ডুবে আছে।
অনিয়ন্ত্রিত বা মাত্রাতিরিক্ত রাগ শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক বা পারস্পরিক সম্পর্কে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। রাগ মানুষকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তোলে। হুট করে এমন রেগে গিয়ে খুন খারাবি ঘটনা ঘটে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনি জটিলতায় পড়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া রাগ থেকে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে গেলে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতো মারাত্মক মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
রাগ এমন পর্যায়ে চলে যাওয়ার আগেই সেটি নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। কেনই বা এত রাগ হয়? রাগ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব, আসুন জেনে নেওয়া যাক-
কেন রাগ হয়?
রাগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের মানসিক অবস্থার একটি বহিঃপ্রকাশ। বিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের মস্তিষ্কের এক বিশেষ অঞ্চল ‘লিম্বিক সিস্টেম’। মাস্টার গ্ল্যান্ড পিট্যুইটারি আর হাইপোথ্যালামাসের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে লিম্বিক হাইপোথ্যালামাস পিট্যুইটারি অ্যাক্সিস। এই অ্যাক্সিসের বৃদ্ধির কারণেই সৃষ্টি হয় রাগ। রাগ, দুঃখ, ভয় এসব কিছুর পেছনেই রয়েছে নিওরো-হরমোনের নির্দিষ্ট মাত্রার ওঠা-নামা। হরমোন দুটো হলো অ্যাড্রিনালিন ও এরঅ্যাড্রিনালিন। এদের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মানুষ রেগে ওঠে। রাগ অস্বাভাবিক কোনো মানসিক বা স্নায়ুতন্ত্রের কোনো রোগ নয়। প্রকৃত সুস্থ মানুষের সম্পূর্ণ স্বাভাবিক একটি আবেগ। সুস্থ মনের অত্যন্ত স্বাভাবিক উপাদান এই রাগ।
জিনগত কারণে
জিনগত কারণে কেউ কেউ চাপে পড়লেই মাত্রাতিরিক্ত রাগ, প্রতিহিংসা প্রকাশ করে।
বাইপোলার ডিজঅর্ডার
বাইপোলার ডিসঅর্ডার একটি মানসিক সমস্যা। এমন সমস্যা থাকলে হঠাৎ হঠাৎ মনের ভাব পাল্টে যায়। এর ফলে আনন্দের সময়েও মনে মনে রাগ হতে থাকে। অনেক সময়ে ঘিরে ধরে রাগের অনুভূতি।
মাদকাসক্তি
অতিরিক্ত মাদকদ্রব্য শরীরের প্রবেশ করলে মানুষ নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। অনেক সময়ে হিংস্র ভাব তৈরি করে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে রাগ দেখাতে শুরু করেন অনেকে। চিন্তাশক্তির ওপরে মাদকের প্রভাবই এমন হয় বলে ধারণা মনোরোগ চিকিৎসকদের।
সময়ের চাপ
অনেক কাজ একসঙ্গে এসে গেলে অথবা অল্প সময়ের মধ্যে অনেক কাজ শেষ করতে গিয়ে সেসব যদি ঠিকমতো না হয়, তাহলে অনেকের মধ্যে টেনশন বা হতাশা জমতে জমতে রাগ তীব্র আকার ধারণ করতে পারে।
পারিবারিক পরিবেশ
ছোটবেলায় যদি কেউ এমন পরিবেশে বড় হয়, যেখানে মা-বাবা বা অভিভাবকেরা অল্পতেই রেগে যান, সেই পরিবারে শিশুরাও একই ধরনের আচরণ শেখে। হীনম্মন্যতাবোধ, অতিরিক্ত কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব, সবকিছুতে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ, ব্যর্থতা মেনে না নেওয়ার মনোভাব ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের মানুষের মধ্যে রেগে যাওয়ার প্রবণতা থাকে।
রাগ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। তবে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রাগ নিয়ন্ত্রণের কিছু উপায় জেনে নেওয়া যাক-
নিঃশ্বাসের ব্যায়াম
রাগ উঠলে মাথা ঠান্ডা রাখতে গভীরভাবে শ্বাস নিতে হবে। রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিঃশ্বাসের ব্যায়াম বেশ পুরোনো ও পদ্ধতি। রাগ থেকে মনটাকে সরিয়ে নিঃশ্বাসের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বুক ভরে গভীর নিশ্বাস নিন, সেটাকে কিছুক্ষণ ধরে রাখুন, কিছুক্ষণ পর বাতাস ছেড়ে দিন। এটি রাগ কমাতে সহায়তা করে।
ক্ষমা করতে শিখুন
রাগকে নিজের মধ্যে পুষে না রেখে, ক্ষমা করতে শিখুন। ক্ষমা একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। আপনি যদি রাগ বা অন্যান্য নেতিবাচক অনুভূতিগুলোকে নিজের মধ্যে লালন করতে থাকেন তবে নিজের ভেতরের তিক্ততা আপনাকে আরও গ্রাস করবে।
মেডিটেশন চর্চা করুন
মেডিটেশন আপনার মনকে স্থির রাখতে সহায়তা করে। রাগ অনুভব করার আগে দৈনন্দিন জীবনে কিছুক্ষণ সময় বের করে মেডিটেশন করলে রাগ নিয়ন্ত্রণে আসবে।
উল্টো গণনা শুরু করুন
বহুকাল ধরে প্রচলিত এই প্রক্রিয়াটি রাগ নিয়ন্ত্রণে সত্যিই ভালো কাজ করে। কোনো ঘটনায় বিরক্ত হলে, ভেতরে ভেতরে রেগে যাচ্ছেন তখন পেছন দিক থেকে ১০০ গুনতে শুরু করুন। এটি সাময়িকভাবে আপনার মনোযোগকে সরিয়ে দেবে এবং কোনো নেতিবাচক চিন্তা করার আগে বেশ কিছুটা সময় পাওয়া যাবে রাগকে নিয়ন্ত্রণে আনার।
শারীরিক ব্যায়াম করুন
নিয়মিত ব্যায়াম করলে মন ও শরীর দুটোই সতেজ থাকে। এতে মানসিক চাপ কমে এবং রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। দৌড়ানো, হাঁটা, বা অন্য কোনো পছন্দের ব্যায়াম করুন, যা আপনার রাগ কমাতে সহায়ক হবে।
নিজের সঙ্গে কথা বলুন
রাগ হলে নিজেকে প্রশ্ন করুন রাগের কারণ কী ছিল? রাগের সময় আপনার আচরণ কেমন ছিল? রাগের ফলাফল কী? অনেক সময় আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন রাগের কারণ বা আপনার আচরণ ও ফলাফল সবই অগ্রহণযোগ্য। তখন যুক্তিযুক্ত আচরণ করতে পারবেন।
সমস্যার সমাধান খোঁজা
রাগান্বিত অবস্থায় কখনো সমস্যার সমাধান হয় না, এতে সমস্যা আরও বাড়ে। তাই অন্যের ওপর দোষারোপ করার আগে একটু ভেবে দেখুন ভুল আসলে কার? যার ওপর রাগ উঠেছে তার সঙ্গে শান্ত মাথায় গভীরভাবে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করুন। ভুল থাকলে স্বীকার করে নিন। দেখবেন রাগ নিয়ন্ত্রণে আসবে।
সৃজনশীল কাজে মনোনিবেশ করুন
কেউ যদি ছবি আঁকতে ভালোবাসেন, তাহলে খালি কাগজে আঁকিবুঁকি কাটতে পারেন বা ক্যানভাসে রং ছুড়তে পারেন।
এতে করে রাগ অনেকটা কমে যাবে। এছাড়া প্রয়োজনে রাগ নিয়ন্ত্রণ কৌশল আয়ত্ত করার জন্য মনোবিজ্ঞানী,মনোচিকিৎসক বা কাউন্সিলরের সাহায্য নিতে পারেন।