আপনার যে কথাগুলো সন্তানের আত্মবিশ্বাস ভেঙ্গে দিতে পারে


শিশুরা কেবল খাবার-পানি আর পড়াশোনার মাধ্যমে বড় হয় না। তাদের বেড়ে ওঠা এক গভীর আবেগীয় ও মনস্তাত্ত্বিক পথচলা। এই পথচলায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন বাবা-মা। কিন্তু আমরা অনেক সময় নিজেদের অজান্তেই এমন কিছু কথা বলি, যা শিশুদের মনে গভীর ক্ষত তৈরি করে দেয়।
শুধু কথা নয়, কথার ভঙ্গি, সময় আর প্রতিক্রিয়াও শিশুদের মানসিক বিকাশে বড় প্রভাব ফেলে। এমন বাক্যগুলো নিয়ে সচেতন হওয়া প্রতিটি অভিভাবকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কেননা শিশুরা নিজের মূল্য শেখে বাবা-মায়ের কাছে। তাই বাবা-মায়ের কাছে মূল্যহীন অনুভব করলে তাদের আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে না, বড় হয়েও এর প্রভাব থেকে যায়।
এর ফলাফল হিসেবে তারা সারাজীবন হয় হীনমন্যতায় ভোগেন, নাহয় অন্যের সঙ্গেও একই আচরণ করেন। তাই জেনে নিন এমন কিছু ক্ষতিকর বাক্য, যা আমরা সবাই অভিভাবকদের বলতে শুনি-
১. ‘তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না’
এই ধরনের কথাগুলো শিশুর আত্মবিশ্বাসকে গুঁড়িয়ে দেয়। সে নিজেকে অক্ষম ভাবতে শুরু করে। ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পায়। যেহেতু বাবা-মা প্রতিটি শিশুর জীবনে সবথেকে বিশ্বাসের মানুষ, তাই আপনার রাগের মাথায় বলা এই কথাটিও তারা মনের অজান্তেই বিশ্বাস করে ফেলবে। এজন্য নেতিবাচক উক্তি করবেন না।
২. ‘অমুক ছেলে বা মেয়েটা পরীক্ষায় কত ভালো নম্বর পায়, আর তুমি...?’
তুলনা কখনওই উৎসাহ বাড়ায় না। বরং সন্তান মনে করে, সে যতই চেষ্টা করুক, সে আপনার প্রিয় হবে না। এতে আপনার সন্তানের মনে হিংসা, অপূর্ণতা ও দুঃখ তৈরি হয়। সে সবসময় অন্যের চোখে নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। সামনে নিজের থেকে ভালো কেউ না থাকলে, নিজেকে উন্নত করার কোনো ইচ্ছা কাজ করবেনা তার মনে। সন্তান সবসময় নিজেকে একটা প্রতিযোগিতার মধ্যে রাখবে, যা তার মানসিক চাপ দিন দিন বাড়াতেই থাকবে। অন্যের ভালো খবরে খুশি হতে পারবেনা সে। তার মনে হবে, ‘বাবা-মা আবার এর সঙ্গে আমাকে তুলনা করবে এখন।’
৩. ‘কোনো কাজই ঠিকভাবে করতে পারো না তুমি, সবসময় ভুল করো’
সবারই ভুল হয়। কিন্তু যখন সন্তানের ভুলকে আপনি তার পরিচয়ের অংশ বানিয়ে ফেলবেন, তখন সে নতুন কিছু আর শিখতে চাইবে না। ভুল করার ভয় থেকে চেষ্টা করার প্রতি অনীহা চলে আসবে।
৪. ‘চুপ করো, ছোটদের এত কথা বলতে হয়না’
এই কথা শিশুর অনুভূতির ওপর নিষেধাজ্ঞা টেনে দেয়। সে মনে করে, তার কথা মূল্যহীন। ভবিষ্যতে সে নিজেদের আবেগ প্রকাশে সংকোচ বোধ করবে এই কথাটির কারণে।
৫. ‘তোমার জন্য সারাজীবন এতো কিছু করলাম, তুমি একটা কথা শুনতে পারছো না!’
এই কথাটি বাবা-মা সাধারণত সন্তান একটু বড় হওয়ার পর বলতে শুরু করে। এই বাক্যটি একটি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল। বাবা-মা সন্তানকে ছোট থেকে ভালবাসা, পরিশ্রম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে বড় করেন, এটি অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। সন্তানেরও উচিত তার বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করা। কিন্তু অভিভাবকরা ভুলে যান যে তার সন্তানও একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। তার নিজের পছন্দ-অপছন্দ ও স্বপ্ন আছে। অথচ সন্তানের প্রতি ভালোবাসা থেকে করা আত্মত্যাগের বিনিময়ে যখন তিনি সন্তানকে কিছু করতে বাধ্য করেন, তখন সন্তান ভাবে তাকে সবকিছুর মূল্য পরিশোধ করতে হবে। এই কথাটি বাবা-মায়ের অমূল্য ভালোবাসাকে ছোট করে দেয়।
৬. ‘তোমার জন্য আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি’
একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হিসেবে আপনি সন্তানের জন্য যেসব আত্মত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা বোঝার বয়স কি আপনার সন্তানের ছিলো? সে কি অবগত ছিলো? সাধারণত এই সিদ্ধান্তগুলো সন্তানের অনুপস্থিতিতেই হয়। ফলে আপনার সিদ্ধান্তের জন্য যদি আপনি অখুশি হয়ে থাকেন, তার দায়ভার নেওয়ার ক্ষমতা আপনার সন্তানের নেই। নিজের স্বপ্নের ভার যখন আপনি সন্তানের ঘাড়ে দিয়ে দেবেন, তখন তার নিজের স্বপ্নগুলোর জন্য আর জায়গা থাকবে না। সেও তখন একজন অখুশি মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠবে।
এই কথাগুলোর প্রভাব কী-
>> সন্তানের আত্মসম্মানবোধ ও আত্মবিশ্বাস ঠিকমতো গড়ে ওঠে না।
>> মনের মধ্যে ভয় বাসা বাঁধে। ফলে জীবনে নতুন নতুন কাজ করতে ও ঝুঁকি নিতে পারেনা।
>> আবেগ চাপা পড়ে যায়। নিজের কথা বলতে না পারার জন্য আবেগ জমা হতে হতে এক সময় মানাসিক অসুস্থতা তৈরি হতে পারে।
>> মানসিক চাপ বেড়ে যায়। নিজেকে কাছের মানুষের কাছে অবাঞ্চিত অনুভব করে।
>> অন্যদের সঙ্গেও ভুলভাবে কথা বলার অভ্যাস তৈরি হয়। অর্থাৎ খারপ ও আক্রমণাত্মক ব্যবহারকে সে স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করে।
এসব ক্ষতির হাত থেকে কীভাবে বাঁচাবেন আপনার আদরের সন্তানকে?
>> নেতিবাচক শব্দের বদলে ইতিবাচক কথা বলুন।
>> শিশুকে ভুল শোধরানোর সুযোগ দিন।
>> তুলনা নয়, ব্যক্তিগত উন্নতির কথা বলুন।
>> নরম গলায় কথা বলার চেষ্টা করুন।
>> আবেগ বোঝার সুযোগ দিন।
>> ছোটখাটো বিষয়ে হলেও, প্রশংসা করুন।
>> তার সঙ্গে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে আচরণ করুন।
মনে রাখবেন, বাবা-মায়ের প্রতিটি কথা শিশুর মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে। তাই যতটা সম্ভব, শিশুর সঙ্গে শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির ভাষায় কথা বলুন। একটি সুন্দর বাক্য একটি শিশুর আত্মবিশ্বাস গড়তে পারে। তেমনই, একটি ভুল বাক্য সারাজীবনের জন্য তার আত্মবিশ্বাস ভেঙে দিতে পারে।