কথায় কথায় ঘৃণা ছড়ানো বাকস্বাধীনতা নয়


মানুষের চরিত্র, মানসিকতা ও মূল্যবোধ তার মুখের কথা ও শব্দচয়নের মধ্যদিয়ে প্রকাশ পায়। দুঃখজনকভাবে আজকের সমাজে ভাষা যেন অনেকের কাছে কেবল আগ্রাসন ও অপমানের অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। অশ্রাব্য শব্দ, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গভিত্তিক বিদ্বেষ আমাদের চারপাশে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে।
কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নেতিবাচক কথা ছড়ানো কিংবা অসম্মানজনক তথ্য প্রকাশ করাকে বলা হয় ‘হেট স্পিচ’ বা ঘৃণাসূচক কথা। জাতিসংঘ ২০২১ সালের জুলাই মাসে ঘৃণাসূচক কথা প্রতিরোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গ্রহণ করে। জুন মাসের ১৮ তারিখকে তারা আন্তর্জাতিক ঘৃণাসূচক কথা প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা করে। উদ্দেশ্য, বিশ্বজুড়ে এই হেট স্পিচের বিস্তার রোধ করা এবং আন্তঃধর্ম ও আন্তঃসাংস্কৃতিক সহনশীলতাকে উৎসাহিত করা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করা।
অনেক দেশে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানো নিয়ে কঠোর আইন আছে। দূর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশে অনেক মানুষ একে বাকস্বাধীনতা বলে মনে করেন। অথচ বাকস্বাধীনতা তো নয়ই, বরং অনেক সংস্কৃতিতে এটি অসভ্য আচরণ, ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধ।
আমরা প্রতিদিনই এমন কিছু শব্দ, শব্দবন্ধ ও বাক্যের মুখোমুখি হই, যেগুলো শুনে কেবল কষ্টই নয়, কখনো কখনো বিব্রত ও অপমানবোধ জাগে। কেউ তার ত্বকের রং নিয়ে বিদ্রুপের শিকার হন, কেউ পোশাক নিয়ে, কেউবা ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে বাঁকা কথায় মর্মাহত হন। এতকাল এসব হতো মুখোমুখি। এখন হয় অনলাইনে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেন এখন বিদ্বেষপূর্ণ ভাষা ছড়ানোর প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। একে বলা হচ্ছে অনলাইন বুলিং।
নোংরা কথায় ভরা আচরণগুলো হয়তো অনেকের কাছে কেবলই ‘মজা’ বা স্বাভাবিক আচরণের অংশ। অথচ যে শিশুটি বাড়ি বা স্কুলে নিয়মিত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হচ্ছে, যে কিশোরী-তরুণীরা নানান রকম কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ও হুমকির শিকার হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা। এসব ঘৃণাসূচক কথা একজন মানুষের আত্মবিশ্বাস ধসিয়ে দিতে পারে, মানসিকভাবে তাকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। যারা এমনটা করে, অনেক সময় তারা বোঝেন না যে, তার বলা কথাগুলো কতটা গভীরভাবে কাউকে আঘাত করতে পারে। চুপচাপ সহ্য করলেও ভেতরে ভেতরে তারা ভেঙে পড়েন। আত্মসম্মান হারিয়ে কেউ কেউ হতাশায় ডুবে যান, এমনকি আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটিয়ে ফেলেন।
এসব বক্তব্য শুধু ভুক্তভোগীর জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না, এটি সমাজে একটি বিভাজনের রেখা তৈরি করে। একটি জাতির ভাষা তার সংস্কৃতি ও পরিচয়ের অংশ। তাই যখন কেউ ঘৃণার ভাষা ব্যবহার করে, সে কেবল নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে নিজের মাতৃভাষাকেও কলঙ্কিত করে।
ঘৃণামূলক বক্তব্য প্রতিরোধে কী করা যায়?
বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিটি সচেতন নাগরিকের কর্তব্য ঘৃণাসূচক বক্তব্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। ব্যক্তি থেকে সমাজ – সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে এসব প্রতিরোধে। জেনে নিন কীভাবে আপনি এই পরিবর্তনে অংশ নিতে পারেন।
১. প্রতিবাদ করুন
যখন কেউ ঘৃণাসূচক বা কুরুচিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করে, তখন চুপ থাকার অর্থ, ওই বক্তব্যকে নীরবে স্বীকৃতি দেওয়া। তাই সাহস করে, যুক্তি দিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদ করতে হবে। শুধু অনলাইন বা পাবলিক প্ল্যাটফর্ম নয়, পারিবারিক ও বন্ধু-বান্ধবের ভেতরেও এ ধরণের আচরণের বিরোধিতা করুন।
২. সচেতনতা গড়ে তুলুন
ঘৃণাসূচক বক্তব্য কেন ক্ষতিকর, এটি কতটা গভীর প্রভাব ফেলতে পারে – এ বিষয় নিয়ে সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মক্ষেত্রে এ বিষয়ে মুক্ত আলোচনা, কর্মশালা, সেমিনার এবং প্রচারণার আয়োজন করা যেতে পারে। তরুণ প্রজন্মকে এ বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে, যেন তারা ভবিষ্যতে আরও মানবিক, সহানুভূতিশীল ও সহনশীল হয়ে উঠতে পারে।
৩. ডিজিটাল নীতিমালা মেনে চলা
অনলাইনে ঘৃণ্য বক্তব্য প্রতিরোধে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোরও দায়িত্ব আছে। রিপোর্ট অপশন, ফিল্টারিং সিস্টেম, কনটেন্ট রিভিউ – এসব আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করতে হবে। সরকারকেও ঘৃণাসূচক বক্তব্যবিরোধী নীতিমালার ব্যাপারে কঠোর হতে হবে।
৪. আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ
যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিয়মিত ঘৃণাসূচক কথা বক্তব্য ছড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব। তবে সেই আইনের প্রয়োগ হওয়া উচিত ন্যায়সঙ্গত ও যথাযথ, যাতে এটি রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত প্রতিশোধের হাতিয়ার হয়ে না ওঠে।
৫. স্বেচ্ছায় ইতিবাচক ভাষার ব্যবহার
একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের উচিত নিজে থেকেই সদাচরণ করা। পরিবার, বন্ধুদের মধ্যে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়াতে এমন ভাষা ব্যবহার করুন যা উৎসাহদায়ক, সহানুভূতিশীল ও সৌহার্দ্যপূর্ণ। ইতিবাচক কথার শক্তি অনেক, এটি কাউকে অনুপ্রাণিত করতে পারে, কাউকে বাঁচিয়েও দিতে পারে।
ঘৃণাসূচক বক্তব্য আমাদের সমাজে এমন এক আগুন, যা ধীরে ধীরে সব সৌন্দর্য, মানবিকতা ও সহানুভূতিকে পুড়িয়ে ফেলে। তাই আজকের দিনটি কেবল একটি দিবস নয়, হোক নিত্যদিনের ভাষা ব্যবহারে সচেতন থাকবো বলে অঙ্গীকারের দিন। ভাষা হোক ভালোবাসার, শ্রদ্ধার ও সম্মানের বাহক, ঘৃণার নয়।