শখ বাঁচিয়ে রাখা কেন জরুরি


জীবনের ব্যস্ততা, দৌড়ঝাঁপ আর দায়িত্বের ভিড়ে আমরা প্রায়ই নিজের পছন্দ-অপছন্দ, ভালোলাগা কিংবা শখকে ভুলে যাই। অথচ শখ কোনো বিলাসিতা নয়; এটি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটি এক ধরণের আত্মিক প্রয়োজন। ব্যক্তি যত বেশি নিজের শখের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তত বেশি গভীরভাবে তিনি জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
শখ মানে শুধু ছবি আঁকা, গান শোনা বা ভ্রমণ নয়। কেউ কেউ বই পড়েন, কেউ রান্না করেন, কেউ গাছ লাগান, আবার কেউ কাগজ কেটে নকশা তৈরি করেন – এসবই শখের অংশ হতে পারে। শখ হচ্ছে এমন একটি কাজ, যা মানুষ নিজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে করেন, আনন্দের জন্য করেন, এবং যা থেকে প্রাপ্ত আত্মতৃপ্তি তাকে মানসিকভাবে চাঙা করে তোলে। তাহলে চলুন জেনে নেই কেনো শখ এতো জরুরি-
১. মানুষ যখন কোনো পছন্দের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে, তখন তার মস্তিষ্কের স্নায়ুবিক চাপ কমে যায়। ২০২৩ সালে 'নেচার মেডিসিন' জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় ১৬টি দেশের ৯৩,২৬৩ জন ৬৫ বছর বা তার ঊর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তির উপর সমীক্ষা চালানো হয়। এই গবেষণায় দেখা যায়, যারা নিয়মিত শখে যুক্ত থাকেন, তাদের মধ্যে বিষণ্ণতা ও মানসিক চাপের লক্ষণ কম দেখা যায় এবং তারা নিজেদের স্বাস্থ্যের প্রতি বেশি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। শখ একধরনের থেরাপির মতো কাজ করে, যা মনকে প্রশান্ত করে এবং জীবনের প্রতি একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে।
২. শখ নিজেকে জানতে সাহায্য করে। অনেকেই তার নিজের প্রতিভা, আগ্রহ বা দক্ষতার কথা জানেন না। শখের চর্চার মধ্য দিয়েই সেগুলো আবিষ্কার হয়। একজন স্বল্পভাষী মানুষ হয়তো লেখালেখির মাধ্যমে নিজের ভাব প্রকাশ করতে পারেন, আবার কেউ হয়তো গানের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। শখের মাধ্যমে আত্মপরিচয়ের একটি স্পষ্টতা তৈরি হয়।
৩. শখ সৃজনশীলতার পথ খুলে দেয়। একটি সাধারণ ছবি আঁকার অভ্যাস থেকে কেউ একজন হয়ে উঠতে পারেন পেশাদার চিত্রশিল্পী। গাছ লাগানোর ভালোবাসা থেকে কেউ একজন হয়ে উঠতে পারেন একজন পরিবেশকর্মী। শখের ধারা যখন পেশায় রূপ নেয়, তখন সেটি হয়ে দাঁড়ায় জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় অধ্যায়।
৪. একঘেয়ে রুটিন জীবনের মাঝে শখের চর্চা নতুন উদ্দীপনা এনে দেয়। অফিস বা পড়াশোনার চাপের মাঝে সপ্তাহে কিছুটা সময় নিজস্ব আনন্দের জন্য বরাদ্দ করা মানেই নিজের যত্ন নেওয়া। তা সে দুপুরে এক কাপ কফি হাতে বই পড়া হোক কিংবা বিকেলে ছাদে গাছের যত্ন নেওয়া। এই ছোট ছোট কাজই জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়।
৫. শখ শুধু ব্যক্তিগত পরিসরেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি পরিবার ও সমাজের সঙ্গেও একটি সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলেমিশে গান গাওয়া, রান্না করা কিংবা বাগান করা এসবই মানসিক দূরত্ব কমায়। তেমনি সমাজে কেউ যদি নিজের হাতে তৈরি কারুশিল্প অন্যদের উপহার দেন কিংবা বিনিময় করেন, তাতে সামাজিক সম্প্রীতিরও উন্নতি ঘটে।
শখ বাঁচিয়ে রাখা কেন জরুরি
৬. প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাই মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রেখে। অথচ সেই সময়ের কিছুটা যদি আমরা নিজের শখে ব্যয় করি, তবে আমরা আরও উৎপাদনশীল ও আনন্দিত থাকব। শখ পালনের জন্য আলাদা করে সময় বের করুন, সপ্তাহে অন্তত কিছুটা সময় নিজের জন্য রাখুন। এই সময়টাই আপনাকে জীবনের ভারসাম্য ফিরিয়ে দিতে পারে।
শখ বাঁচিয়ে রাখা মানে নিজের অস্তিত্ব, চাওয়া-পাওয়া, আর জীবনের রঙ বাঁচিয়ে রাখা। যান্ত্রিক জীবনে একটু হাসি, একটু প্রশান্তি, একটু নিজের মতো করে বাঁচার নামই শখ। তাই শখকে গুরুত্ব দিন, যত্ন করুন, চর্চা করুন। মনে রাখবেন শখের মধ্যেই লুকিয়ে আছে জীবনের আসল রঙ।