বজ্রপাতে মানুষ মরে হাওরে, যন্ত্র বসেছে সাবেক এমপির বাড়ির সামনে

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট প্রতিবেদক
প্রকাশিত:১৩ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫০ এএম
বজ্রপাতে মানুষ মরে হাওরে, যন্ত্র বসেছে সাবেক এমপির বাড়ির সামনে

হবিগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে হাওর ও বনাঞ্চল বেষ্টিত। ফলে এসব হাওর এলাকায় বর্ষা মৌসুমে বজ্রপাত এক আতঙ্কের নাম। বজ্রপাতে জেলায় প্রতি বছর ১৪ মানুষ মারা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বজ্রপাত রোধে জেলায় ৩৩টি বজ্র নিরোধক বা লাইটিং অ্যারেস্টার বসানো হয়েছে। অথচ উপজেলা অফিস ও সাবেক এমপির বাড়ির সামনে বসানো এসব যন্ত্র আদৌ কোনো কাজ করে কি না বলতে পারছে না কেউ।

জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যালয়ের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, জেলায় গত ছয় বছরে (চলতি মৌসুমসহ) বজ্রপাতে মারা গেছে ৮৪ জন। প্রতি বছর গড়ে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। এর মাঝে চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মারা গেছে ১১ জন। আহত হয়েছে ৩ জন। সবচেয়ে বেশি মারা গেছে ২০২২ সালে ২২ জন। আহত হয় ৩ জন। এছাড়া ২০২০ সালে মারা যায় ১৫ জন, আহত হয় ৪ জন। ২০২১ সালে মারা যায় ১২ জন, আহত হয় ২ জন। ২০২৩ সালে মারা যায় ১২ জন, আহত হয় ১ জন। ২০২৪ সালে মারা যায় ১২ জন, আহত হয় ২ জন।

এ অবস্থায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ২০২১-২২ অর্থবছরে জেলায় বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র স্থাপনে ২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ১৫ লাখ, নবীগঞ্জে ৩০ লাখ, বানিয়াচংয়ে ৪৫ লাখ, আজমিরীগঞ্জে ৩০ লাখ, হবিগঞ্জ সদরে ১৫ লাখ, লাখাইয়ে ২৫ লাখ, শায়েস্তাগঞ্জে ১০ লাখ, চুনারুঘাটে ১৫ লাখ ও মাধবপুরে ১৫ লাখ টাকা। ওই টাকা দিয়ে ৯টি উপজেলায় ৩৩টি লাইটিং অ্যারেস্টার মেশিন স্থাপন করা হয়। এর মাঝে নবীগঞ্জে ৬টি, বাহুবলে ২টি, বানিয়াচংয়ে ৭টি, আজমিরীগঞ্জে ৬টি, হবিগঞ্জ সদরে ৩টি, লাখাইয়ে ৩টি, শায়েস্তাগঞ্জে ২টি, চুনারুঘাটে ২টি ও মাধবপুরে ২টি। এগুলো ২০২৩ সালের বর্ষা মৌসুমের আগেই স্থাপন করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলায় মোট হাওর আছে ১ হাজার ৯৫ বর্গ কিলোমিটার। পুরো হাওর লাইটিং অ্যারেস্টার বা বজ্র নিরোধক যন্ত্রের আওতায় আনতে হলে মোট ৩০ হাজার ৬৬০টি যন্ত্রের প্রয়োজন (প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ২৮টি করে)। এতে ব্যয় দাঁড়াবে ২ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, আজমিরীগঞ্জে বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র বসানো হয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের পাশে। কোনোটি বসানো হয়েছে বাড়িঘরের কাছাকাছি। বানিয়াচং উপজেলার কবিরপুরে বসানো হয়েছে সাবেক এমপি (বর্তমানে কারান্তরীণ) আব্দুল মজিদ খানের বাড়ির সামনে। একটি যন্ত্রের কোথাও বাতি জ্বলতে দেখা যায়নি। কোথাও একটি যন্ত্রও হাওরে স্থাপন করতে দেখা যায়নি।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আজাদুর রহমান বলেন, এই যন্ত্রগুলো আমি এখানে যোগদানের আগে বসানো হয়েছে। এটি সম্পর্কে আমাদের কারো কোনো ধারণা নেই। যে কোম্পানি এগুলো স্থাপন করেছে তারাই এ বিষয়ে বলতে পারবে। তবে কোম্পানির সঙ্গে আমি যোগাযোগ করেছি, তারা একজন আরেকজনকে দেখায়। ফোন দিলে ধরে না।

তিনি জানান, এটি চতুর্পাশে ১০৭ মিটার করে কাভার করার কথা। কিন্তু কোনো কাজ করে কি না তা জানা নেই। এর মধ্যে ব্যাটারি আছে। সেগুলোর চার্জ আছে কি না সেটাও দেখার কোনো উপায় নেই। এটিও আমরা জানি না। এছাড়া এগুলো হাওরে স্থাপন করলে মেইনটেইনেন্স করা সম্ভব নয়। তাই হাওরে এটি দিয়ে কোনো কাজ হবে না। বরং হাওরে যদি আশ্রয় কেন্দ্র করা যায়, সেক্ষেত্রে বেশি কার্যকর হবে। মানুষও বজ্রপাত থেকে বাঁচতে পারবে।

বানিয়াচং উপজেলার কবিরপুর গ্রামের আব্দুল মতিন বলেন, সাবেক এমপি মজিদ খান তার বাড়ির সামনে বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র বসিয়েছেন নিজে বাঁচার জন্য। আর হাওরে মানুষ বজ্রপাতে মরে। কী লাভ হলো, এখন তিনি নিজেই কারাগারে আছেন।

একই গ্রামের আব্দুল মোতালিব বলেন, এগুলোতে বাতি জ্বলার কথা। কিন্তু কখনো কোনো বাতি জ্বলতে দেখিনি। এটি কোনো কাজ করে কি না তা কেউ জানে না। যন্ত্রের পাশেই আমার বাড়ি, কিন্তু ক’দিন আগেই আমার বাড়িতে বজ্রপাত হয়েছে। অল্পের জন্য আমরা রক্ষা পেয়েছি। তাহলে টাকা খরচ করে এসব বসিয়ে লাভ কী? আসলে যন্ত্র বসানোর নামে ধোকা দিয়ে টাকা লুটপাট করা হয়েছে।

হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে কাজ করা তারেক খান বলেন, বজ্রপাতে বেশিরভাগ মানুষই মারা যান হাওরে। কিন্তু দেখা গেলো কী, একটি যন্ত্রও হাওরে বসানো হয়নি। সবগুলোই কোনো সরকারি অফিসের আশপাশে, বাড়ির আশপাশে, সাবেক এমপিদের বাড়ির পাশে বসানো হয়েছে। তাতে হাওরবাসীর কী লাভ হলো? তাছাড়া মেশিনগুলোও মনে হচ্ছে অকার্যকর। অনেক স্থানেই দেখা যাচ্ছে মেশিনের পাশেই বজ্রপাতে মানুষ মারা যাচ্ছে। এটি লুটপাটের ফন্দি ছাড়া কিছুই নয়।

হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. সৈয়দ সায়েম উদ্দিন আহম্মদ বলেন, বজ্রপাত মূলত বর্ষা মৌসুমের শুরু এবং শেষাংশে হয়। আর বজ্রপাত যখন হয় তখন এটি কাছাকাছি বিদ্যুৎ পরিবাহী যা পায় তা দিয়েই মাটিতে স্পর্শ করে। এক্ষেত্রে উঁচু গাছ হিসেবে তাল গাছ অত্যন্ত কার্যকরি। কিন্তু এটিতো বাড়তে দীর্ঘ সময় লাগে। নার্সারি গাছগুলোও দেখা যায় বাঁচে না। আবার লাইটিং অ্যারেস্টার খুবই ব্যয়বহুল। তাছাড়া এটি রক্ষণাবেক্ষণও কঠিন। এক্সপার্ট প্রয়োজন। কার্যকারিতা কতটুকু সে সম্পর্কেও বুঝতে হবে। তাই এটির পরিবর্তে প্রয়োজন জনসচেতনতা বাড়ানো। স্বল্প ব্যয়ে যাতে বেশি সুবিধা পাওয়া যায় সেই পদ্ধতি বের করতে হবে।