সুন্দরবনের আগুন নেভাতে জোয়ারের পানিই ভরসা, বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট প্রতিবেদক
প্রকাশিত:২৮ মার্চ ২০২৫, ১১:২৪ এএম
সুন্দরবনের আগুন নেভাতে জোয়ারের পানিই ভরসা, বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ

সুন্দরবনে নদ-নদী ও খাল জালের মতো বিস্তৃত। জোয়ারে পানি বাড়লে উপচে পড়ে নদী-খালের পানি, প্রবেশ করে সুন্দরবনে। কিন্তু সেই সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে পর্যাপ্ত পানি মেলে না। কাছাকাছি পানির উৎস না থাকায় একের পর এক বনভূমি পুড়তে থাকে। এমতাবস্থায় আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিস ও বনকর্মীদের। অনেক সময় আগুন নেভানোর জন্য ভরসা করতে হয় জোয়ারের পানির ওপর—কখন জোয়ার হবে। এমনকি ভাটার সময় নদীতে পানি না থাকলে, বন্ধ হয়ে যায় আগুন নেভানোর কাজও। এ অবস্থায় পানির উৎস তৈরি করতে সুন্দরবনের মধ্যে বড় বড় পুকুর খনন করার পরিকল্পনা নিচ্ছে বন অধিদপ্তর। একই সঙ্গে পানি প্রবাহ বাড়াতে সুন্দরবনের নদী-খাল খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে সুন্দরবনে জরুরি প্রয়োজনে পানির চাহিদা মিটবে। পাশাপাশি বন্যপ্রাণী তাদের পানির চাহিদাও মেটাতে পারবে সহজে।

জানা গেছে, সম্প্রতি সুন্দরবনের শাপলার বিলে জ্বলতে থাকা আগুন নেভাতে বন বিভাগ এবং ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের হিমশিম খেতে হয়েছে—কাছাকাছি পানির উৎস না থাকায়। পানির জন্য প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরের ভোলা নদীতে পাম্প মেশিন বসিয়ে পাইপ লাইন স্থাপন করা হয়। তবুও চাহিদা মাফিক সার্বক্ষণিক পানি মেলেনি ভোলা নদীতে। জোয়ারের পানির জন্য ফায়ার সার্ভিসের এবং বন কর্মীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। জোয়ারে সময় পানি মিললেও ভাটার সময় নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় বন্ধ থাকে আগুনে পানি ছিটানোর কাজ—দীর্ঘায়িত হয় আগুন নেভানোর কাজ। পুনরায় জোয়ারের জন্য তাদের কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। ভোলা নদীর তলদেশ পলিমাটি জমে ভরাট হওয়ার কারণে জোয়ারের সময়েও পর্যাপ্ত পানি প্রবেশ করে না। আর ভাটার সময়তো  নদীতে পানি থাকে না। ভোলা নদীতে পর্যাপ্ত পানি থাকলে অনেক আগেই শাপলার বিলের আগুন সম্পূর্ণভাবে নেভানো সম্ভব হতো বলে জানিয়েছে বন বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

আরও পড়ুন: সুন্দরবনের ৪ একর বনভূমি পুড়ে ছাই, আগুন নিয়ন্ত্রণে

শুধু সুন্দরবনের শাপলার বিলের আগুন নেভানোর কাজে বেগ পেতে হয়েছে—এমন নয়। বনের এই অংশ বিভিন্ন সময় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে কাছাকাছি পানির উৎস না থাকায় একই অবস্থা তৈরি হতে দেখা গেছে অতীতেও। দ্রুত পানি দিতে না পারায় আগুনের ব্যাপকতা বেড়েছে। কয়েক কিলোমিটার দূরে নদীতে পাইপলাইন স্থাপন করে পানি নিয়ে আগুনে ছিটানো হয়। কাছাকাছি পানির উৎস থাকলে সহজে আগুন সম্পূর্ণ নেভানো যেত। কাছাকাছি পানির উৎস না থাকায় প্রায় প্রতিবার আগুন নেভাতে হিমশিম খেতে হয়।

কয়েকটি সূত্র জানায়, শুধু ভোলা নদী নয়। সুন্দরবনের মধ্যে খড়মা, আড়ুয়ারবের নদীসহ বিভিন্ন নদী এবং খাল পলিমাটি জমে ভরাট হয়ে গেছে। জোয়ারে পর্যাপ্ত পানি নদী-খালে প্রবেশ করতে পারে না। আর ভাটার সময় অনেক নদী-খাল পানিশূন্য থাকে। নদী-খালে পানি না থাকলে বনসংলগ্ন গ্রামের মানুষ অহরহ সুন্দরবনে প্রবেশ করে। একই সঙ্গে অনেকে আবার তাদের গবাদি পশু সুন্দরবনে চড়ায়। নদী-খালে পানি প্রবাহ থাকলে মানুষ যত্রতত্র সুন্দরবনে প্রবেশ করতে পরবে না। আর গবাবি পশু নদী-খাল পাড়ি দিয়ে সুন্দরবনে বিচরণ সম্ভব হতো না। আর সুন্দরবনে আগুনের মতো ঘটনা ঘটলে নদী-খাল থেকে পানি নিয়ে আগুন নেভানো সহজ হতো। যুগযুগ ধরে সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী-খাল পলিমাটি জমে ভরাট হয়ে আছে। ফলে দীর্ঘদিন ধরে দাবি ছিল নদী-খাল খননের।

সুন্দরবন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনে প্রায় ৪৫০টি নদ-নদী ও খাল রয়েছে। এসব নদ-নদী ও খাল সমগ্র সুন্দরবনে জালের মতো ছড়িয়ে আছে। অধিকাংশ নদ-নদী ও খাল দীর্ঘদিন ধরে পুনঃখনন না করায় তলদেশ পলিমাটি জমে ভরাট হয়ে গেছে। এসব নদ-নদী ও খাল পুনঃখনন করা হলে পানি সংকট দূর হবে। পাশাপাশি বন সংলগ্ন গ্রামের মানুষ যত্রতত্র সুন্দরবনে প্রবেশ করতে পারবে না। আর সুন্দরবনে গবাদি পশুর বিচরণ ঠেকানো যাবে।

বাগেরহাট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) সাকরিয়া হায়দার জানান, সুন্দরবনের শাপলার বিল এলাকায় রবিবার দুপুরে জ্বলতে দেখা আগুন নেভানোর কাজে ৮টি ফায়ার স্টেশন, বন বিভাগ এবং স্থানীয় লোকজন অংশ নেয়। কাছাকাছি পানির উৎস না থাকায় প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে ভোলা নদীতে পাইপ লাইন স্থাপন করে পানি দিয়ে আগুন নেভানোর কাজ করা হয়। শুধুমাত্র জোয়ারের সময় ভোলা নদীতে পানি পাওয়া গেছে। ভাটার সময় নদীতে পানি না থাকায় আগুন নেভানোর কাজ বন্ধ রাখতে হয়। পুনরায় জোয়ারের পানির জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। ভোলা নদীতে সার্বক্ষণিক পর্যাপ্ত পানি পাওয়া গেলে একদিনের মধ্যে আগুন সম্পূর্ণভাবে নেভানো যেত।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নুরুল করিম জানান, সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের ওই এলাকার কাছাকাছি পানির উৎস নেই। একারণে ৩ কিলোমিটার দূরে ভোলা নদী থেকে পানি নিয়ে আগুনে ছিটানো হয়। শুধুমাত্র জোয়ারের সময় পানি মিলেছে ভোলা নদীতে। পানির অভাবে ভাটার সময় আগুনে পানি ছিটানো যায়নি। সার্বক্ষণিক পানি থাকলে অনেক আগেই আগুন সম্পূর্ণভাবে নেভানো সম্ভব হতো।

ডিএফও কাজী মুহাম্মদ নুরুল করিম আরও জানান, সুন্দরবনের ভোলা, আড়ুয়ারবের এবং খড়মা নদীসহ বিভিন্ন নদী-খাল পলিমাটি জমে ভরাট হয়ে আছে। এ কারণে নদী-খালে পানি সংকট দেখা দিয়েছে। ভাটার সময় নদী-খালে পানি না থাকায় বনসংলগ্ন গ্রামের মানুষ অবৈধভাবে অহরহ সুন্দরবনে প্রবেশ করছে। সেই সঙ্গে আইনভঙ্গ করে মানুষ তাদের গবাদি পশু সুন্দরবনে বিচরণ করাচ্ছে। নদী-খালে পানি প্রবাহ থাকলে মানুষ এবং গবাদি পশু এইভাবে সুন্দরবনে প্রবেশ করতে পারবে না।

বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন পিসি বারুইখালী গ্রামের ধানসাগর টহল ফাঁড়ি ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিমের লিডার লুৎফর রহমান জানান, সুন্দরবনের শাপলার বিলে জ্বলতে থাকা আগুন নেভানোর কাজে অন্যদের সঙ্গে সে নিজেও অংশ নিয়েছে। ভোলা নদীর জোয়ারের পানি আগুন নেভানোর একমাত্র ভরসা ছিল। জোয়ারের সময় আগুনে পানি দিতে পারলেও ভাটায় সময় নদীতে পানি না থাকায় আগুন নেভানোর কাজ বন্ধ ছিল। নদী-খাল ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে বনসংলগ্ন গ্রামের মানুষ যত্রতত্র সুন্দরবনে প্রবেশ করে। কেউ কেউ তাদের জ্বালানি কাঠ সুন্দরবন থেকে সংগ্রহ করে। দ্রুত নদী-খাল খনন করার দাবি জানান লুৎফর রহমান।

প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, সুন্দরবনে শাপলার বিল এলাকার কাছাকাছি পানির উৎস না থাকায় আগুন নেভানোর কাজে বেগ পেতে হয়। একারণে সুন্দরবনের মধ্যে পানির উৎস তৈরি করতে ফাঁকা স্থানে বড় বড় পুকুর খননের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। একই সাথে পানি প্রবাহ বাড়াতে সুন্দরবনের ভোলা, খড়মা ও আড়ুয়ারবের নদী এবং খাল পুনঃখননের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে জোয়ারের পানি যাতে সহজে বনভূমিতে প্রবেশ করতে পারে, সে জন্য নদীর উঁচু পার নিচু করা হবে। সুন্দরবনের মধ্যে পানির উৎস সৃষ্টি এবং পানি প্রবাহ বৃদ্ধি করা গেলে জরুরি প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি বন্যপ্রাণী তাদের পানির চাহিদা মেটাতে পারবে।