‘জুলাই সনদ প্রশ্নবিদ্ধ এবং প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য আপত্তিজনক’


জুলাই সনদ প্রশ্নবিদ্ধ এবং প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য আপত্তিজনক ও অন্তঃসারশূন্য বলেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। রবিবার ১৯ অক্টোবর এক বিবৃতির মাধ্যমে তারা এ মন্তব্য করেছেন।
‘জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যে অলংকারিক বাহুল্য ও শ্রেষ্ঠত্ববাদী অহমিকার চর্বিতচর্বণ ছাড়া আর কিছুই নেই। তিনি তার বক্তৃতায় সনদের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে অনেক অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক বিষয় টেনেছেন। মোটাদাগে তার এই অন্তঃসারশূন্য বক্তব্য জাতিকে আশার আলো দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।’
রবিবার (১৯ অক্টোবর) এক বিবৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এসব কথা জানায়।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘প্রধান উপদেষ্টা এমন এক আপত্তিজনক ও বিতর্কিত বিষয়ের অবতারণা করেছেন, যা রাজনৈতিকভাবে তো বটেই, সমাজতাত্ত্বিক ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল। তিনি দুইবার তার বক্তৃতায় ‘বর্বরতা’ ও ‘সভ্যতা’র যে মেরুকরণ করেছেন, তা নিন্দনীয় ও বিদ্বেষমূলক হয়েছে বলে আমরা মনে করি।’’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘‘জুলাই সনদে নারী, লৈঙ্গিক পরিচয়ে সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ব্যাপারে কোনও আশার আলো নেই। এ সনদ স্বাক্ষর দিবসে সব রাজনৈতিক দল উপস্থিত না থাকলেও সরকার ও ঐকমত্য কমিশন সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এই আয়োজন করতে ব্যতিব্যস্ত ছিল বলে মনে হয়েছে। এমতাবস্থায় জুলাই সনদ ঐক্যের ডাক দিতে ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি প্রশ্নবিদ্ধও হয়েছে, যা অদূর ভবিষ্যতে নতুন রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করবে।’’
বিবৃতিতে শিক্ষক নেটওয়ার্ক বলেছে, ‘‘মহাসমারোহে ‘জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর’ আয়োজনের ঢাকঢোল পেটানো হলেও শুরু থেকেই জুলাই সনদ তৈরির প্রক্রিয়া ও পরিসর নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ছিল। তাই এই অনুষ্ঠান নিয়ে মানুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আগ্রহ ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন সংস্কার কমিশন ও ঐকমত্য কমিশন প্রতিষ্ঠা, সংস্কার নিয়ে আলাপচারিতা ও সর্বোপরি জুলাই সনদ প্রস্তুত করার লক্ষ্যে যেভাবে অগ্রসর হয়েছে, তা অভ্যুত্থানের বহু অংশীজনকেই আশাহত করেছে।’’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘‘সরকার এতটাই জনবিমুখ হয়ে পড়েছে যে— বহু অংশীজনের স্বর এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতসহ জনগণের আকাঙ্ক্ষা উঠে আসেনি সংস্কারের সুপারিশমালা ও চূড়ান্ত জুলাই সনদে। বিশেষত, নারী, লিঙ্গীয় পরিচয়ে সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ব্যাপারে এই সনদে কোনেও আশার আলো নেই।’’
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক বলেছে, ‘‘নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে খুশি করতে গিয়ে বিভিন্ন পক্ষকে এই সনদ চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় দূরে রাখা হয়েছে। অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় অংশীদার শিক্ষার্থীদের অভিপ্রায়কে (চাওয়া) গুরুত্ব না দিয়ে যে ‘ঐক্যে’র কথা প্রচার করা হয়েছে, সেখানে যে ফাঁক রয়েছে, তা সনদ স্বাক্ষরের দিনই দেখা গেছে। জুলাই যোদ্ধাদের একটি অংশ ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং পুলিশ তাদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা চালিয়েছে।’’
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক মনে করে, ‘‘ব্রিটিশ ও পশ্চিমা ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদীরা উপনিবেশিত জাতিগুলোকে ‘অসভ্য’ ও ‘বর্বর’ সাব্যস্ত করে তাদের ওপর তথাকথিত ‘মর্ডানিটি’ (আধুনিকতা) ‘এনলাইটমেন্ট’ (আলোকায়ন), ‘সিভিলাইজেশন’ (সভ্যতা), ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’ (শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ) চাপিয়ে দিয়েছিল। তেমনই প্রধান উপদেষ্টা ক্ষমতার মসনদে বসে অবিবেচনাপ্রসূত ঔপনিবেশিক অপরায়নের ছাঁচেই কথা বলেছেন। মনে রাখা দরকার, তিনি একটি সরকারের প্রধান নির্বাহী হলেও এটি তার অস্থায়ী পরিচয়। সারা বিশ্বেই তিনি একজন স্বনামধন্য অ্যাকাডেমিশিয়ান ও সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে সমাদৃত। এমন এক বর্ণিল অ্যাকাডেমিক পরিচয় থাকার পরও তিনি কী করে উপনিবেশজাত শব্দসম্ভারে তার বক্তৃতা রাখতে পারলেন, তা আমাদের কাছে বিস্ময়কর লেগেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এমন শব্দচয়নের বিরোধিতা করে তার এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে।’’