উপদেষ্টাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন এনসিপির


অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি)। দলটির অভিযোগ, জনপ্রশাসনে বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে ভাগ-বাটোয়ারা হচ্ছে। তাতে উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকে সহায়তা করা হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সরকারপ্রধানের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে নবগঠিত দলটি। তারা সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ দাবি করেছে। এ ছাড়া সাংবিধানিক আদেশ জারির মাধ্যমে জুলাই সনদের ওপর গণভোটের দাবি জানিয়েছে।
গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে এ অবস্থান জানায় এনসিপি। বৈঠক শেষে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা তাদের জুলাই সনদে সই করার আহ্বান এবং এনসিপির বিষয়গুলো বিবেচনা করবেন বলে জানিয়েছেন।
বৈঠকের পর প্রেস উইংয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা নেতাদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করতে সরকার প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
এর আগে মঙ্গলবার যমুনায় বৈঠকের পর বিএনপি নেতারা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে এই মুহূর্ত থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় যেতে হবে। গতকাল এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, গণভোটের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুযোগ নেই। জুলাই সনদে রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান। গণভোটে জুলাই সনদ অনুমোদিত হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়া সম্ভব। এর আগে অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রূপান্তরের সুযোগ নেই। যারা এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেছেন, তাদের দুরভিসন্ধি রয়েছে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আছে, সেগুলো বিবেচনা করে তারা যেন নিজেদের পুনর্গঠন করে নেন। ছাত্র উপদেষ্টাদের বিষয়ে বারবার বলা হয়। তারা কোনো দলের প্রতিনিধি নন; গণঅভ্যুত্থানের প্রতিনিধি হয়ে সরকারে গিয়েছেন। ফলে অন্য উপদেষ্টারা যেমন, তারাও তেমন। অন্য উপদেষ্টাদেরও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ বিষয়গুলোও সরকারকে বিবেচনা করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার ছেড়ে এনসিপির দায়িত্ব নেওয়া নাহিদ বলেছেন, যখন সরকার গঠিত হয়, তখন বিভিন্ন দলের সুপারিশে উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি কোন কোন উপদেষ্টা কোন কোন দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কারা কারা প্রশাসনিক ভাগ-বাটোয়ারায় জড়িত।
বড় রাজনৈতিক দলগুলো জেলা প্রশাসক-পুলিশ সুপারের মতো পদ ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। এনসিপি আহ্বায়ক বলেন, বড় দলগুলো এসপি-ডিসি পদ ভাগ-বাটোয়ারা করছে। এভাবে চলতে থাকলে সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হবে। সরকার যাতে নিরপেক্ষভাবে চলে এবং উপদেষ্টা পরিষদের যাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, তাদের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছি।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের দরকার উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম প্রশ্ন তোলেন, জনপ্রশাসনের যে পদায়ন হচ্ছে, তা কীসের ভিত্তিতে হচ্ছে? নিরপেক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে?
এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনা হয়েছে। এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছি। এর মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় এক ধাপ আমরা এগোলাম। কিন্তু সারাদেশে জুলাই শহীদ পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে যে মামলাগুলো হয়েছে, সেগুলোর আসামিরা জামিনে মুক্ত হয়ে হুমকি দিচ্ছে। নির্বাচনের আগে এই মামলাগুলোর বিচারের একটা রোডম্যাপ চেয়েছি।
জুলাই সনদ বিষয়ে নাহিদ বলেন, সনদ বিষয়ে অবস্থান সরকারের কাছে তুলে ধরেছি। জুলাই সনদের কাগুজে মূল্যে এনসিপি বিশ্বাসী নয়। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা পাওয়ার পরই স্বাক্ষর করবে। একটি সাংবিধানিক আদেশের কথা বলেছি। আদেশ জারি করবেন প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার মাধ্যমে ড. মুহাম্মদ ইউনূসেরই একমাত্র সেই বৈধতা আছে; রাষ্ট্রপতির নেই। এই আদেশ সংবিধান-বহির্ভূতভাবেই দিতে হবে।
জুলাই সনদের সংস্কার প্রস্তাবে বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) বিষয়ে তিনি বলেন, নোট অব ডিসেন্টের কার্যকারিতা রাখা যাবে না। যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হয়েছে, তা গণভোটে যাবে। গণভোটে অনুমোদিত হলে পরবর্তী সংসদ কন্সটিটুয়েন্ট (গাঠনিক) ক্ষমতাবলে সংবিধান সংস্কার করবে। এই পুরো প্রক্রিয়ায় সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়, তা দেখে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব।
বৈঠকে নির্বাচন কমিশন বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, তাদের আচরণ নিরপেক্ষ মনে হচ্ছে না। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কমিশনের যেভাবে কাজ করার কথা ছিল, তা করছে না। কিছু কিছু দলের প্রতি কমিশনের পক্ষপাতিত্ব দেখা যাচ্ছে। এনসিপিকে কেন শাপলা প্রতীক দেওয়া হবে না– নির্বাচন কমিশনকে এর আইনি ব্যাখ্যা দিতে হবে। ব্যাখ্যা না পাওয়া পর্যন্ত অন্য প্রতীক নেব না। যদি প্রতীকের মতো ছোট বিষয়ে ন্যায়বিচার না মেলে, তাহলে এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ভোট হতে পারে না।
গতকাল বিকেল ৫টায় যমুনায় পৌঁছান এনসিপির শীর্ষ চার নেতা। প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলের উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ও যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান সরকারের পক্ষ থেকে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।