এবার কি হাসিনাকে ফেরত দেবে ভারত, কী বলছে আইন, কী আছে চুক্তিতে?
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফাঁসির সাজা শুনিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সহিংসতায় উসকানি, হত্যার নির্দেশ এবং দমনপীড়ন আটকানোর ক্ষেত্রে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা—এই তিন অভিযোগে হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে ট্রাইব্যুনাল।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হাসিনা বর্তমানে ভারতে পলাতক। ইতোমধ্যেই আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, হাসিনাকে ফেরাতে চেয়ে ভারতের কাছে আবারও চিঠি দেবেন। তবে বিচারের সম্মুখীন হতে ভারত তাকে আদৌ বাংলাদেশের হাতে তুলে দেবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে। ওই চুক্তি অনুযায়ী আদালতের রায়ে প্রত্যর্পণ করানোর মতো অপরাধ করে থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে এক দেশ অপর দেশের হাতে তুলে দেবে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরেই হাসিনাকে ফেরত চেয়ে নয়াদিল্লিকে ‘কূটনৈতিক চিঠি’ (ভার্বাল নোট) পাঠিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। ওই চিঠির প্রাপ্তিস্বীকারও করেছিল ভারত।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল তখন জানিয়েছিলেন, হাসিনার প্রত্যর্পণের বিষয়ে বাংলাদেশের একটি চিঠি তারা পেয়েছেন। কিন্তু তখন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আগে ওই চিঠির বৈধতা যাচাই করতে চায় নয়াদিল্লি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, কোনো দেশের অন্তর্বর্তী সরকার (যা জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়) অন্য রাষ্ট্রের নির্বাচিত সরকারের কাছে কোনো রাজনৈতিক নেতার প্রত্যর্পণ চাইলে, আইনি দিকগুলো খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
অক্টোবরে ফের হাসিনার প্রত্যর্পণের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে দেয় ভারত। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্রী জানান, এর সঙ্গে আইনি বিষয় জড়িয়ে আছে। উভয় দেশের মধ্যে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি যে, এটি একটি বিচার বিভাগীয় এবং আইনি প্রক্রিয়া। এর জন্য দু’দেশের সরকারের মধ্যে আলোচনা এবং পরামর্শের প্রয়োজন রয়েছে। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি এবং এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও একসঙ্গে কাজ করার জন্য তৈরি।
ভারত কি হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করতে বাধ্য?
বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির মধ্যে থাকা বেশ কয়েকটি শর্তের জন্যই ভারত হাসিনাকে ফেরাতে বাধ্য নয় বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক অনিন্দ্যজ্যোতি মজুমদার বলেন, ভারত হাসিনাকে ফেরাতে বাধ্য নয়। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত চুক্তি থাকলেও সেখানে এমন কিছু শর্ত রয়েছে, যার জন্য নয়াদিল্লি সেটি মানতে বাধ্য নয়।
প্রত্যর্পণ চুক্তির ওই শর্তের কথা বলে হাসিনাকে প্রত্যর্পণে ভারত বাধ্য নয় বলে জানান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমনকল্যাণ লাহিড়ীও। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী বলেন, ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে বন্দি প্রত্যর্পণ নিয়ে চুক্তি রয়েছে। কিন্তু সোমবারের রায়ের পর বাংলাদেশে হাসিনার প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ওই চুক্তিতে থাকা নিয়ম অনুসারেই ভারত হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ করতে বাধ্য নয়।
এ প্রসঙ্গে আইনগত দিকটি ব্যাখ্যা করে কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবী অরিন্দম দাস বলেন, হাসিনা এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারেন। কিন্তু দেশে না-থাকার জন্য হাসিনাকে যদি তা করতে বাধা দেওয়া হয়, তাহলে তা মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল।
একই সঙ্গে, ট্রাইবুনালের রায়ের প্রতিলিপি পাঠানো হলেও ভারত তা মানতে বাধ্য নয় জানিয়ে এই আইনজীবী বলেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী, যদি কোনো দেশে কারো জীবনের ঝুঁকি থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আশ্রয় দেওয়া দেশ তাকে ফেরত পাঠাতে বাধ্য নয়। হাসিনার ক্ষেত্রেও এই আইনের কথা তুলে ধরতে পারে ভারত।
কী বলছে ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তি
২০১৩ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তখন ভারতের শাসন ক্ষমতায় ছিল মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার। অন্যদিকে, বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিলেন হাসিনা। তাদের মধ্যে হওয়া সেই চুক্তিতে বলা হয়েছিল- আদালতের রায়ে প্রত্যর্পণ করানোর মতো অপরাধ করে থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে এক দেশ অপর দেশের হাতে তুলে দেবে।
বিষয়টির ব্যাখ্যায় বলা হয়- ন্যূনতম এক বছরের জেল হতে পারে, এমন অপরাধ করে থাকলে সেই ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণ করা হবে। এ-ও বলা হয় যে, সেই অপরাধকে চুক্তি স্বাক্ষর করা দুই দেশেই শাস্তিযোগ্য হতে হবে। অপরাধে প্ররোচনা দেওয়া বা সাহায্য করা ব্যক্তিকেও প্রত্যর্পণ করা যেতে পারে বলে জানানো হয়। ২০১৬ সালে প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করতে চুক্তি সংশোধন করা হয়। সংশোধিত চুক্তিতে বলা হয়, কারও নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলেই তাকে প্রত্যর্পণ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে অপরাধের প্রমাণস্বরূপ কোনো তথ্যপ্রমাণ দাখিল করতে হবে না।
সম্প্রতি হাসিনার বিরুদ্ধেও একাধিক মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। সংশোধিত চুক্তি অনুসারেই তাকে প্রত্যর্পণ করার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
কোন কোন ক্ষেত্রে প্রত্যর্পণ হবে না
তবে চুক্তিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, অপরাধটির যদি রাজনৈতিক চরিত্র থাকে, তাহলে প্রত্যর্পণ করা হবে না। খুন, গুম করা এবং অত্যাচার (যেগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটিতে হাসিনা অভিযুক্ত) রাজনৈতিক অপরাধের তালিকায় রাখা হবে না বলেও চুক্তিতে বলা হয়েছে।
এই চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, বিচারের নেপথ্যে যদি সৎ কোনো উদ্দেশ্য না-থাকে, তাহলে ভারত বা বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণ করবে না।
সেক্ষেত্রে হাসিনাকে প্রত্যর্পণ না-করার জন্য এই যুক্তিগুলো খাড়া করতে পারে ভারত। হাসিনা নিজেও বারবারই তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক আচরণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন। বিচারের নামে প্রহসনের অভিযোগও তুলেছেন।
কেন এই চুক্তি করা হয়েছিল?
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় গা ঢাকা দেওয়া অপরাধীদের নাগাল পেতেই প্রত্যর্পণ চুক্তি করেছিল ভারত ও বাংলাদেশ। সেই সময় (২০১৩ সাল) উত্তর-পূর্ব ভারতে অশান্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করার পরিকল্পনা নিয়ে বেশ কয়েকজন উগ্রপন্থি বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন বলে অভিযোগ জানায় ভারত। আবার বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের রাজ্যগুলোতে জেএমবির সদস্যরা ঘাঁটি গেড়েছে বলে খবর মেলে। উভয় দেশে আশ্রয় নেওয়া অপরাধীদের প্রত্যর্পণ করার জন্যই এই চুক্তি স্বাক্ষর করে ভারত ও বাংলাদেশ।
বস্তুত, বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের জেরে ২০২৪ সালের অগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হন স্বৈরাচারী হাসিনা। পতন হয় তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের। ৫ অগস্ট বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় এন হাসিনা। তার পর থেকে তিনি ভারতেই অবস্থান করছেন। সূত্র: আনন্দবাজার
