সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোটে ইতিবাচক ইসি কর্মকর্তারা

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট প্রতিবেদক
প্রকাশিত:১০ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৫৭ এএম
সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোটে ইতিবাচক ইসি কর্মকর্তারা

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট আয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে। তবে এই গণভোট জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে, নাকি আগে-পরে হবে– তা নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। অন্যদিকে গণভোট আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রস্তুতির বিষয় নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। 

ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, তারা আগে থেকেই ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছেন। এ অবস্থায় সরকার যদি গণভোটের সিদ্ধান্ত নেয়, নতুন করে সেটি আয়োজনের প্রস্তুতিও শুরু করতে হবে তাদের। তবে এটিতে খুব বেশি সমস্যা হবে না। গত বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পঞ্চম দফার বৈঠকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়। বৈঠকের পর ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, বিশেষজ্ঞরা সর্বসম্মতভাবে জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় হিসেবে মতামত দিয়েছেন। সেটি হচ্ছে, একটি আদেশ জারি করতে হবে। ওই আদেশের মাধ্যমে গণভোট আয়োজন করতে হবে।

সেই গণভোট কখন-কীভাবে হবে, তা নিয়ে এখনও মতভেদ আছে। কোনো কোনো দল সংসদ নির্বাচন ও গণভোট এক দিনে করার প্রস্তাব দিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের এক মাস আগে গণভোট করার প্রস্তাবও এসেছে। অবশ্য এর আগে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে গণভোটের বিধানটি আগামী সংসদে উত্থাপন করে পাস করানোর সুপারিশ করা হয়েছিল। 

নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ গণমাধ্যমে বলেন, এই মুহূর্তে গণভোটের বিষয়টি নির্ভর করছে পলিটিক্যাল কনসেনসাসের (রাজনৈতিক সমঝোতা) ওপর। গণভোটের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয় ব্যাপার, সরকারের ব্যাপার। সরকার যদি মনে করে, গণভোট করবে, তাহলে আমরা গণভোট ইনশাআল্লাহ করতে পারব। 

তবে সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একসঙ্গে গণভোট হলে বড় ব্যয় সাশ্রয় হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এত ব্যয়বহুল কাজ দুদিনে করাটা কঠিন হবে। কাজেই সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয়, আমাদের কোনো বিষয় নয়। দুই নির্বাচন একত্রে করলে অনেক টাকা বেঁচে যায়। ফেব্রুয়ারিতে দুই নির্বাচন একসঙ্গে করা সম্ভব। সেটাই ভালো হবে। 

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার ব্যয়ের হিসাব দিয়েছে ইসি। ১২ কোটি ৬৩ লাখের বেশি ভোটারের সংসদ নির্বাচনে থাকবে ৪০ হাজারের বেশি ভোটকেন্দ্র। সেখানে ভোটকক্ষ থাকবে আড়াই লক্ষাধিক। প্রথমবারের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোট নেওয়ার আয়োজন হচ্ছে ‘আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ব্যালটের’ মাধ্যমে। সেখানেও ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এই নির্বাচনে ১০ লাখের বেশি লোকবল নিয়োজিত থাকবে। 

ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে গণভোট আয়োজন করলে আগের ব্যয় বরাদ্দের সঙ্গে কিছুটা যোগ করলেই হবে। আর আলাদা দিনে দুই ভোট করতে হলে আলাদা বাজেটে অনেক বেশি খরচ হবে। কেননা তখন দুই দফায় একই মাপের আয়োজন করতে হবে। 

যেভাবে গণভোটের বিধান ও বাতিল
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে মতামত নেওয়ার পদ্ধতিই হলো গণভোট। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান, অর্থাৎ বাহাত্তরের সংবিধানে গণভোটের বিধান ছিল না। ১৯৭৯ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে গণভোটের বিধান যুক্ত করেন। ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী মামলায় ১৪২ ধারাটি বাতিল ঘোষণা করে আদালত গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনার কথা বলেন।

দেশে এখন পর্যন্ত তিন গণভোট 
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে মোট তিনবার গণভোট হয়েছে। ১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালে এই গণভোট হয়। এর মধ্যে ১৯৭৭ সালের ৩০ মে প্রথম গণভোট হয়েছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়। ৯৮.৮ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট এবং ১.১২ শতাংশ ‘না’ ভোট পড়েছিল। ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ দেশে দ্বিতীয়বার গণভোট হয় রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়। এতে ৯৪.১১ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ এবং ৫.৫০ শতাংশ ‘না’ ভোট পড়ে। সর্বশেষ ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ১৪২ (১ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তৃতীয়বার গণভোট হয়। ভবিষ্যতে দেশে কোন ধরনের সরকার পদ্ধতি চলবে, জনগণের কাছে তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। সেবার ৮৪ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট এবং ১৫.৬২ শতাংশ ‘না’ ভোট পড়েছিল।

আইন সংশোধন নিয়ে প্রশ্ন
আদালতের রায়ে গণভোট ফিরলেও সংবিধানে এ-সংক্রান্ত বিধানটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বহাল হবে কিনা– তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কেননা, জেনারেল ক্লজ অ্যাক্ট ১৮৯৭-এর ৬ ধারা অনুযায়ী কোনো আইনকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে সংসদে আইনটি পাস করানোর দরকার হয় বলে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের ভাষ্য।

অবশ্য সংসদবিষয়ক গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেন, সুনির্দিষ্টভাবে চারটি আর্টিকেলের বিষয়ে গণভোটের বিধান রয়েছে। আইনগত কোনো বাধা নেই। হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত মামলার রায়ে গণভোট ফেরানোর কথা বলেছে। সরকার চাইলে জনমত যাচাইয়ের জন্য গণভোট করতে পারে। 

নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ বলেন, গণভোট আয়োজনে আইনগত কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। সরকারে বা ঐকমত্য কমিশনে সিদ্ধান্ত হলে বাস্তবায়ন করা যাবে। 

এক দিনে দুই ভোট, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
একসঙ্গে সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের সম্ভাব্যতা নিয়ে মত দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ। তিনি বলেন, দুই নির্বাচন এক দিনে হলে ভোটকেন্দ্র, ভোটার, রিটার্নিং অফিসার, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা সবই একই থাকবে। শুধু দুটি ব্যালট পেপার। একটা জাতীয় নির্বাচন, আরেকটা গণভোটের। আবার পরিশ্রম, লোক নিয়োগ ও আয়োজনও একবারে করা যাবে। 

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আবদুল আলীম বলেন, দ্রুত সিদ্ধান্ত হলে ইসির জন্য এটা বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে না। তার মতে, এ কাজে জনসচেতনতায় প্রচারও চালাতে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তিনটি ব্যালট পেপারে ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা মানুষের রয়েছে। ফলে এবার সংসদ নির্বাচন আর গণভোট একসঙ্গে হলে ভোটারদের বোঝাতে সমস্যা হবে না। 

পৃথিবীর অনেক দেশেই সাধারণ নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট হয়, সে কথা তুলে ধরে অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেন, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট দেওয়াই এখন সবচেয়ে সহজ উপায়। একসঙ্গে হলে মানুষের কনফিউজড হওয়ার সম্ভাবনাও কমবে। 

নির্বাচন কমিশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব মিহির সারওয়ার মোর্শেদ ১৯৯১ সালে গণভোট আয়োজনে নিজের যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ওই গণভোট দ্বাদশ সংবিধান সংশোধন বিল নিয়ে হয়েছিল জাতীয় নির্বাচনের পর। রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার থেকে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় ফেরা নিয়ে সেই গণভোট হয়। তবে এবার একসঙ্গে করা গেলে ভালো হবে।