রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের ৩ স্থানে মৃত্যুফাঁদ, এক মাসে ৭ প্রাণহানি


রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের মিঠাপুকুর অংশের চার কিলোমিটারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কপথ এখন রীতিমতো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। এই অংশের অন্তত তিনটি স্থানে দীর্ঘদিন ধরে কোনো ট্রাফিক সিগন্যাল বা সড়ক পারাপারের ব্যবস্থা না থাকায় ঘন ঘন দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে প্রাণ যাচ্ছে অনেকের, অনেকের জীবন বাঁচলেও দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের মতে, দক্ষিণ এশীয় উপআঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা (সাসেক) প্রকল্পের আওতায় মহাসড়ক নির্মাণ হলেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। ফলে সড়কে বেড়েছে দুর্ঘটনা।
এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে গড়ের মাথা চৌরাস্তা, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন-সংলগ্ন বৈরাতী রোড মোড় এবং উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম হাট এলাকা শঠিবাড়িতে।
ঝুঁকিপূর্ণ এসব স্থানে যথাযথ ট্রাফিক সিগন্যালের পাশাপাশি ফুট ওভারব্রিজ বা আন্ডারপাস নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় জনসাধারণ।
গড়ের মাথা
মিঠাপুকুর উপজেলা পরিষদ এবং থানা থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরত্বে গড়েরমাথা নামক স্থানটি। এখানে চৌরাস্তা রয়েছে।
পশ্চিম দিক থেকে দিনাজপুর-ফুলবাড়ি কয়লাখনির সড়ক, পূর্ব দিক থেকে বালারহাট এলাকার সড়ক এসে গড়ের মাথা নামক স্থানে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এতে করে চৌরাস্তায় রূপ নিয়েছে এই স্থানটি।
অথচ এমন গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম স্থানেও কোনো ফ্লাইওভার বা আন্ডারপাস নির্মাণ করা হয়নি। এমনকি নির্দিষ্টভাবে ট্রাফিক সিগন্যাল না থাকায় দূরপাল্লার যেকোনো যানবাহন চালকের বোঝার উপায় নেই যে সামনে চৌরাস্তা রয়েছে। ফলে প্রায়ই ঘটছে ছোটবড় দুর্ঘটনা।
বৈরাতী রোড
মিঠাপুকুর উপজেলার ইমাদপুর ইউনিয়ন থেকে মিলনপুর ইউনিয়ন পর্যন্ত একটি আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় দুই বছর আগে নির্মিত সড়কটি শঠিবাড়ি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন-সংলগ্ন রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, এখানে কোনো ওভারপাস নির্মাণ করা হয়নি। এর ফলে যানবাহনগুলোকে প্রায় দেড় কিলোমিটার ঘুরে মিলনপুর সড়কে উঠতে হয়। এ ছাড়া রংপুর থেকে আসা কোনো যাত্রী বা যানবাহন মিলনপুর ইউনিয়নের এই সড়কে যেতে চাইলে দেড় কিলোমিটার ঘুরে আসতে হয়।
সড়কের মাঝখানে বড় ইটের দেওয়াল নির্মাণ করে দুই ভাগে বিভক্ত থাকায় অনেকেই ট্রাফিক আইন মানছেন না। ফলে দ্রুতগামী যানবাহনের চাপায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারানোর পাশাপাশি পঙ্গুত্ব বরণ করার মতো ঘটনাও ঘটছে।
শঠিবাড়ি
উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় হাট শঠিবাড়ি। এই হাটকে মিঠাপুকুরের বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবেই জানেন স্থানীয়রা। ঐতিহ্যবাহী এই বাজারকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে রংপুর-ঢাকা মহাসড়ক।
নবনির্মিত এই মহাসড়কের মাঝখানে ইটের বড় দেওয়াল দিয়ে এই বিভক্তি তৈরি করায় ব্যবসায়ীরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেনই, সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও হারিয়েছে এলাকাটি।
এখানেও ওভারপাস বা ফ্লাইওভার না থাকায় প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। এই এলাকায় ব্যাংক, বীমা, সরকারি অফিস, মার্কেট ও ছোটবড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সড়কের মাঝখানে নির্মিত কংক্রিটের দেওয়াল পারাপারের কোনো সেতুবন্ধন না থাকায় প্রতিদিন শত শত মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ব্যস্ততম এই হাট এলাকায় প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষ ও ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড় থাকে। অথচ এখানে কোনো ফুট ওভারব্রিজ বা কার্যকর আন্ডারপাস নেই। ফলে গত একমাসে অন্তত ৭ জন পথচারী দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
জনসাধারণ ও ব্যবসায়ীদের দাবি
শঠিবাড়ি হাটের ব্যবসায়ী শেখ সাদী, লালন ও রায়হান প্রধানসহ অনেকেরই অভিযোগ, কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে, অথচ রাস্তা পারাপারে কোনো নিরাপদ ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, দেওয়াল টপকে মানুষ রাস্তা পার হচ্ছে। শঠিবাড়ি স্কুলের সামনে একটি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হলেও সেটি ব্যবহারযোগ্য নয় বলে দাবি তাদের।
তারা জানান, আন্ডারপাসটি এমন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে, সেখান দিয়ে সাধারণ মানুষের যাতায়াত নেই বললেই চলে। ফলে আন্ডারপাস থাকলেও তা কার্যত অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
এলাকাবাসীর দাবি, দ্রুত এই এলাকায় ফুট ওভারব্রিজ অথবা আন্ডারপাস নির্মাণ করা হোক, যাতে জনগণের জীবন ও জীবিকা নিরাপদ থাকে।
নিরাপদ ও পরিকল্পিত যোগাযোগ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে প্রায় একই কথা জানান গড়ের মাথা ও বৈরাতী রোড এলাকার সাধারণ মানুষ।
বড়দরগা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘গত এক মাসে শঠিবাড়ি এলাকায় ১ নারীসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়াও মিঠাপুকুরের অন্যান্য এলাকায় আরও ৩-৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আমরা জনবহুল এলাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণ করার বিষয়ে সড়ক ও জনপদ বিভাগে অবগত করেছি। তবে দুর্ঘটনা রোধে জনগণকেও সচেতন হতে হবে।’
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবরে দুঃখপ্রকাশ করলেও আপাতত ফ্লাইওভার করার কোনো সুযোগ নেই বলে জানান রংপুর সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘তবে জনস্বার্থে ঝুঁকিপূর্ণ স্পটগুলোর বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করব।’
মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জিল্লুর রহমান বলেন, ‘মহাসড়কে দুর্ঘটনা এড়াতে নিরাপদ সড়কের দাবিতে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অবহিত করা হবে।’