‘দনবাস’ কেন রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তি আলোচনার কেন্দ্রে


গত শুক্রবারের আলাস্কা সম্মেলনে ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধের প্রধান শর্ত হিসেবে পুরো দনবাস অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ চেয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক নিয়ে দনবাস অঞ্চল গঠিত। এটি পূব ইউক্রেনে অবস্থিত। এর মধ্যে লুহানস্ক প্রায় পুরোপুরি রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে ক্রামাতোরস্ক ও স্লোভিয়ানস্ক শহরসহ দোনেৎস্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো এখনো ধরে রেখেছে ইউক্রেন। তাই ইউক্রেনের শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত দোনেৎস্ক অঞ্চল পুরোপুরি দাবি করেছেন পুতিন।
তবে ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব বরাবরই প্রত্যাখান করে আসছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, ইউক্রেনের কোনো ভূখণ্ড আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার কাছে হস্তান্তরের বিরোধিতা করছেন দেশটির প্রায় ৭৫ শতাংশ নাগরিক। ফলে দনবাস অঞ্চলটি ঘিরেই শান্তি আলোচনায় একপ্রকার অচলাবস্থা তৈরির আশঙ্কা করছেন বিষেশজ্ঞরা।
দ্য গার্ডিয়ান বলছে, দোনেৎস্ক অনেক আগে থেকে মস্কোর প্রধান লক্ষ্যবস্তু। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো এ অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে রুশ বাহিনী। পরে ২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরু পর অঞ্চলটির বড় একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় রাশিয়া।
বর্তমানে দনবাসের ৪৬ হাজার ৫৭০ বর্গ কিলোমিটার বা ৮৮ শতাংশই রাশিয়ার দখলে। এর মধ্যে লুহানস্কের পুরোটাই এবং দোনেৎস্কের এক তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করছে মস্কো। তবে দোনেৎস্কের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর বেশিরভাগই এখনও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে ইউক্রেন। এর জন্য অবশ্য চড়া মূল্যও দিতে হয়েছে কিয়েভের। এই অঞ্চলের দখল ধরে রাখতে হাজার হাজার মানুষের জীবন গিয়েছে।
দনবাসের অবস্থান এবং কেন এটি চান পুতিন?
দনবাস আসলে দোনেৎস বেসিনের সংক্ষিপ্ত রূপ। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত দনবাস মূলত কয়লা ও ভারী শিল্পে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলের অনেক মানুষই রুশ ভাষায় কথা বলেন। সোভিয়েত ইউনিয়েনের সময়ে সেখানকার কয়লা খনি ও ইস্পাত কারখানাগুলো সোভিয়েতে শিল্পায়নের মূল চালিকাশক্তি ছিল।
সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পরও রাশিয়ার প্রতি এই অঞ্চলের মানুষের রাজনৈতিক আনুগত্য বজায় ছিল। তবে ২০১৪ সালে ক্ষমতাচ্যুত ক্রেমলিনপন্থি প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়ার পর দনবাসে সংঘাত শুরু হয়।
এর পরপরই ক্রিমিয়া দখল করে মস্কো এবং পূর্ব ইউক্রেনজুড়ে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। রুশ অস্ত্র ও যোদ্ধাদের সহায়তায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো দোনেৎস্ক ও লুহানস্কে স্বঘোষিত ‘পিপলস রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়।
এই বিচ্ছন্নতাবাদীদের তৎপরতা দোনেৎস্কতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলে। এরপর ২০১৯ সালে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে সংঘাতের অবসান ঘটানোর অঙ্গীকার নিয়ে প্রচার চালান বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি নিজেও রুশভাষী। এই নির্বাচনে দোনেৎস্কের মানুষই জেলেনস্কিকে নির্বাচিত করেন।
এরপর ২০২২ সালে দনবাসের অধিবাসীদের সুরক্ষা দেওয়ার অজুহাতেই ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করেন পুতিন। এক টেলিভিশন ভাষণে তিনি দাবি করেছিলেন, দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের স্বঘোষিত ‘পিপলস রিপাবলিক’ তার কাছে সাহায্য চেয়েছে, কারণ কিয়েভ সেখানকার রুশভাষী অধিবাসীদের ওপর ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে।
তবে এটি নিছক একটি অজুহাত বলেই মত দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। কারণ মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই এই অঞ্চল ছাড়িয়ে কিয়েভ অভিমুখে অগ্রসর হতে শুরু করে রুশ সেনাবাহিনী। জেলেনস্কি সরকারকে উৎখাত করে পুরো ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়াই মস্কোর উদ্দেশ্য ছিল।
সাধারণ রাশিয়ানদের চোখে দনবাস কেমন
বছরের পর বছর ধরে মস্কোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন গণমাধ্যমগুলোতে দনবাসকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে সেখানে রুশভাষীদের ওপর অনেক অত্যাচার করা হয়। তাদের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। তবে বাস্তবে এই প্রচারণা তেমন একটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি।
রাশিয়ানদের মনে ক্রিমিয়ার মতো গভীর ঐতিহাসিক ও আবেগময় গুরুত্ব বহন করে না দনবাস। ২০২২ সালে সংঘাত শুরুর আগে এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত হওয়া উচিত বলে মনে করতেন মাত্র এক চর্তুথাংশ রুশ নাগরিক।
তবে আগ্রাসন চলমান থাকায় ধীরে ধীরে এই ধারণা বদলাচ্ছে। অধিকাংশ রুশ এখন পুতিনের দনবাসের জনগণকে ‘সুরক্ষা’ দেওয়ার ধারণা সমর্থন করেন। তাছাড়া, ভূখণ্ডগুলো এখন রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করার পক্ষেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন রয়েছে।
দনবাস পেলেই কী পুতিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে
শুক্রবারের বৈঠকে পুতিন ট্রাম্পকে বলেছেন, দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের বিনিময়ে তিনি দক্ষিণ ইউক্রেনের খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলে সম্মুখযুদ্ধ স্থগিত রাখতে এবং আর না এগোতে রাজি রয়েছেন।
এই দুটি ও দনবাসের দুটি অঞ্চল মিলিয়ে মোট চারটি অঞ্চলের পুরো নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি শুরু থেকে বারবার করে আসছেন পুতিন। এ ছাড়াও ইউক্রেনের খারকিভ, সুমি ও চেরনিহিভ অঞ্চলের ভেতরে তথাকথিত ‘বাফার জোন’ প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছেন তিনি।
ক্রেমলিনের এক সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, পুতিন আসলে সুযোগসন্ধানী। তিনি যখন আগ্রাসন শুরু করেছিলেন, তখন তার নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমার চিন্তা ছিল না। তবে একবার সাফল্যের স্বাদ পেলেই তার লোভ বাড়তে থাকে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে, রাশিয়ার অর্থনৈতিক বা সামরিক সক্ষমতা দনবাসের বাইরে বেশি দূর অগ্রসর হওয়ার মতো নয় বলেও মনে করেন অনেক সামরিক বিশ্লেষক। তবে সবকিছু নিঃশেষ করে দেওয়ার মতো এই যুদ্ধ বছরের পর বছর ধরে চলতে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের।
অন্যদিকে, দনবাসের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ছাড়তে নারাজ ইউক্রেন, ক্রামাতোরস্ক ও স্লোভিয়ানস্কের গুরুত্বপূর্ণ শহরের নিয়ন্ত্রণ এখনো ধরে রেখেছে তারা। এই অঞ্চল ছেড়ে দেওয়া ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে রাশিয়াকে একটি লঞ্চপ্যাড উপহার দেওয়ার সমতূল্য বলে সতর্ক করেছে কিয়েভ।