ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য হামলা নিয়ে ট্রাম্প শিবিরেই ঘোর অসন্তোষ-বিভক্তি


ইরানের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য মার্কিন হামলার ইঙ্গিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের মধ্যে বিভাজন দেখা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে যুদ্ধে জড়ানোর শঙ্কায় তাঁর ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ (মাগা) শিবিরের অনেকেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পেছনে এ শিবিরের বড় ভূমিকা ছিল।
ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী কিছু রিপাবলিকান নেতাও তার এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। অনুরোধ করছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে এ যুদ্ধে না জড়াতে। এই ঘনিষ্ঠজন ও নেতাদের মধ্যে রয়েছেন প্রেসিডেন্টের সাবেক শীর্ষ উপদেষ্টা স্টিভ ব্যাননও। তিনি বরাবরই ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ দর্শনের অন্যতম মুখ।
আজ বুধবার ওয়াশিংটনে ‘ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর’ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ব্যানন সতর্ক করে বলেন, কূটনৈতিক সমাধানের পথে না গিয়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংসে ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে সামরিক অভিযান চালানো যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে না।
‘আমরা আবার সেই পথে যেতে পারি না। এটা দেশকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে। আরেকটা ইরাক চাই না আমরা,’ বলেন ব্যানন।
ট্রাম্প প্রশাসনের ইরানবিষয়ক নীতির হঠাৎ মোড় ঘুরে যাওয়ায় তারই সমর্থক ‘মাগা’ শিবিরের রক্ষণশীল অংশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। কয়েক সপ্তাহ আগেও ট্রাম্প যেখানে ইরানের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক সমঝোতার কথা বলছিলেন, এখন সেখানে ৩০ হাজার পাউন্ডের মার্কিন ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা ব্যবহারের সম্ভাবনা আলোচনায় আসছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরানবিরোধী পদক্ষেপে গেলে ট্রাম্প তার নিজের শক্তিশালী শিবিরের বিরোধিতার মুখে পড়তে পারেন। এ সমর্থক শিবির মূলত তাঁর পররাষ্ট্রনীতি-সংক্রান্ত সতর্কতা ও যুদ্ধবিরোধী অবস্থানকে সমর্থন করেই পাশে ছিল। ইরান ইতিমধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি হামলায় জড়ায়, তবে এর জন্য মার্কিনদের চড়া মূল্য দিতে হবে—যদিও সেই মূল্য কী হবে, তা স্পষ্ট করেনি তেহরান।
সামনে নির্বাচন, সমর্থক হারানো ঝুঁকি
ইরান–ইসরায়েল সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রকে জড়ালে, সেটি হবে বৈদেশিক ঝামেলায় যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে ট্রাম্পের সতর্ক থাকার নীতির বিপরীত। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে তাঁর সদ্ভাব গড়ার প্রচেষ্টা এতে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আবার ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের প্রচেষ্টা ও শুল্ক নিয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি সইয়ের আলোচনা থেকেও মনোযোগ সরিয়ে নিতে পারে এটি।
সংবিধান অনুযায়ী তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করতে না পারলেও ২০১৬ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হতে সাহায্য করা ‘মাগা’ জোট ট্রাম্পের জন্য এখনো গুরুত্বপূর্ণ। এ জোটের মনোভাব ক্ষুণ্ন হলে তাঁর জনপ্রিয়তায় ধস নামতে পারে, যা ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে পারে।
‘ইরান পারমাণবিক অস্ত্র পাবে না’: ট্রাম্প
এমন বিভক্তি নিয়ে হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বুধবার ট্রাম্প অবশ্য উদ্বেগহীন ভঙ্গিতে বলেন, ‘আমার সমর্থকেরা আজ আমাকে আগের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন, আমিও তাঁদের।’ তাঁর ভাষ্য, ‘আমি শুধু একটা জিনিসই চাই—ইরানের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র যেন না থাকে।’
ট্রাম্প স্বীকার করেন, সমর্থকদের একটা অংশ এখন হয়তো (তার সিদ্ধান্তে) একটু অসন্তুষ্ট। তবে কেউ কেউ আবার তাঁর সঙ্গেই একমত যে ইরানের হাতে পারমাণবিক শক্তি যাওয়া উচিত নয়।
‘আমি যুদ্ধ চাই না। কিন্তু যদি তাদের (ইরান) যুদ্ধ করা অথবা পারমাণবিক অস্ত্র রাখা—এ দুটির মধ্যে একটি বেছে নেওয়ার বিষয় হয়, তাহলে আপনাকে যা করার, তা করতে হবে’, বলেন ট্রাম্প।
বিভাজন প্রকট, কিন্তু সমর্থন ধরে রাখবেন ট্রাম্প
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে আইন প্রণয়নে যুক্ত থাকা এবং সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের ঘনিষ্ঠ মার্ক শর্ট বলেন, ইরান ইস্যুতে রিপাবলিকানদের মধ্যে ‘গভীর বিভাজন’ দেখা যাচ্ছে। যদিও তাঁর বিশ্বাস, ট্রাম্পের অনুসারীরা শেষ পর্যন্ত তাঁর পাশেই থাকবেন।
শর্ট বলেন, ‘বিভাজন এখন স্পষ্ট হলেও, ট্রাম্পপন্থীরা আদর্শ নয়, মানুষটির প্রতি আনুগত্য বেশি দেখান।’ তবে তার মতে, ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন ট্রাম্পের জন্য রাজনৈতিকভাবে লাভজনকও হতে পারে।
ঐতিহ্যগতভাবে রক্ষণশীল ভোটাররা (রিপাবলিকান) ইসরায়েলের পক্ষে থাকার বিষয়টিকে সমর্থন করেন।
রয়টার্স/ইপসোসের মার্চ মাসের এক জরিপ বলছে, ৪৮ শতাংশ রিপাবলিকান মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ইসরায়েলকে যেকোনো হুমকির মুখে সামরিক সহায়তা দেওয়া। এ বিষয়ে মাত্র ২৮ শতাংশ একমত নন। তবে উল্টো চিত্র ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে। তাদের ২৫ শতাংশ এ বিষয়ে একমত, ৫২ শতাংশ একমত নন।
‘মাগা’–এর প্রভাবশালী কণ্ঠ এবং মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি মারজোরি টেইলর গ্রিন ও সাবেক ফক্স নিউজ উপস্থাপক টাকার কার্লসনও ইরান ইস্যুতে ট্রাম্পকে সতর্ক হতে বলছেন। গ্রিন গত রোববার সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, ‘যারা ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে জড়াতে চাইছে, তারা আমেরিকা ফার্স্ট/মাগা নয়। আমরা বিদেশে যুদ্ধ করা নিয়ে ক্লান্ত।’
তবে ট্রাম্পের আরেক ঘনিষ্ঠজন, সাউথ ক্যারোলাইনার রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম ফক্স নিউজে বলেন, তিনি চান ট্রাম্প যেন ‘ইসরায়েলকে কাজ শেষ করতে সাহায্য করেন’। কারণ তাঁর মতে, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু ‘ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি।’
রিপাবলিকান পার্টির ভেতরে দ্বন্দ্ব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে গত মঙ্গলবার রাতে টাকার কার্লসন ও টেক্সাসের রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজের বিতর্কে।
বিতর্কে ক্রুজ যখন ইরানে ‘সরকার পরিবর্তনের’ পক্ষে কথা বলেন, তখন কার্লসন তীব্র বিরোধিতা করেন। বলেন, ‘আপনি ইরান সম্পর্কে কিছুই জানেন না!’ উত্তরে ক্রুজ বলেন, ‘আমি তো টাকার কার্লসনের মতো ইরান-বিশেষজ্ঞ নই।’ এরপর কার্লসন বলেন, ‘আপনি একজন সিনেটর, যিনি অন্য দেশের সরকার ফেলে দেওয়ার ডাক দিচ্ছেন।’