এডিস মশা চেনার উপায়
বর্তমানে গ্রাম কিংবা শহর— সর্বত্রই মশা আর মশাবাহিত রোগ যেন এক আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে। মশা দেখলেই অনেকে আতঙ্কে থাকেন এই যেন ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু কিংবা চিকুনগুনিয়া হলো। মশার কারণে অবশ্য আতঙ্কিত না হয়েও উপায় নেই। ছোট্ট এই জীবের কামড়ে প্রতি বছরই অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, মারাও যাচ্ছেন অনেকে। চলতি বছরেও সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মুশতাক হোসেন বলেছেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে এডিস মশার নির্মূল করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সেই কাজটির আমরা ঠিক মতো করতে পারিনি। কেবল কীটনাশকের ধোঁয়া ছিটিয়ে এডিস মশার প্রাদুর্ভাব কমানো সম্ভব নয়, প্রয়োজন কমিউনিটি এনগেজমেন্ট বা সাধারণ মানুষের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। অতীতে এডিস মশা থাকলেও ডেঙ্গু টেস্টের তেমন সুযোগ না থাকায় তার অস্তিত্ব নিয়ে এত বেশি গবেষণা বা চিন্তার সুযোগ ছিল না।
তিনি বলেন, ১৯৯৮ সালে কিছু রোগীর দেহে ডেঙ্গু ভাইরাস ধরা পড়ে। ১৯৯৯ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে রাজধানীর অনেক রোগীর দেহে ডেঙ্গুর জীবাণু পাওয়া যায়। ২০০০ সালের দিকে ডেঙ্গুর প্রকোপও আরও বেড়ে যায়। তখন থেকেই মূলত এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কী করা যেতে পারে, সে বিষয়ে গবেষণা ও ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়েও নানা সচেতনতামূলক প্রচার একটু একটু করে শুরু হয়।
আইইডিসিআরের তথ্যানুযায়ী, দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা প্রকট আকার ধারণ করে ২০১৯ সালে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রকোপের তীব্রতা দেখা গিয়েছিল। সে বছর এক লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং মারা যায় ১৭৯ জন। এরপর ২০২৩ সালে ইতিহাসের সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
এদিকে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বা আইইডিসিআরের তথ্যানুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৯৫ হাজার ৫৭৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর একই সময়ে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৩৮৬ জনের। অবশ্য অতীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এর থেকেও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। তবে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে সব থেকে বেশি, প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই বছর মারা গিয়েছিলেন প্রায় দুই হাজার জন।
কীভাবে চিনবেন এডিস মশা
সারা পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার প্রজাতির মশা রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে যেসব প্রজাতি বেশি দেখা যায়, তার মধ্যে অ্যানোফিলিস, এডিস ও কিউলেক্স— এই তিন ধরনের মশাই বেশি ক্ষতিকর। স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। এডিস মশার কামড়ে ছড়ায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া। আর ফাইলেরিয়া বা গোদরোগের কারণ কিউলেক্স মশার কামড়। ডেঙ্গি বা প্রচলিত ভাষায় ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক হলো এডিস ইজিপ্টাই এবং এডিস এলবোপিকটাস জাতের মশা।
কিটতত্ত্ববিদরা বলেছেন, ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশা খালি চোখে দেখেই শনাক্ত করা সম্ভব।
এ বিষয়ে ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোলের তথ্যানুযায়ী, এডিস ইজিপ্টাই এবং এডিস এলবোপিকটাস জাতের মশার দেহে সাদা কালো ডোরাকাটা দাগ থাকে, যে কারণে এটিকে টাইগার মশাও বলা হয়ে থাকে। সাধারণত এজাতীয় মশা মাঝারি আকারের হয়ে থাকে। এর অ্যান্টেনা বা শুড় দেখতে কিছুটা লোমশ হয়।
এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা অনুযায়ী, এডিস মশার অ্যান্টেনায় অনেকটা দাড়ির মতো থাকে। পুরুষ মশার অ্যান্টেনা স্ত্রী মশার চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি লোমশ দেখতে হয়।
অন্যদিকে দেহের ডোরাকাটা দাগ ও অ্যান্টেনা দেখে এডিস মশা চেনা সম্ভব বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, এডিস মশা সাধারণত স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে এবং শহর এলাকার সৌন্দর্যবর্ধক বাগান, পাত্র বা টবে জমে থাকা পানিতে জন্মায়। তবে ২০১৯ সালে এক গবেষণায় দেখা গেছে, নোংরা পানিতেও বংশ বিস্তার করতে পারে এ মশা।
কবিরুল বাশার আরও বলেন, অন্যসব প্রাণীর মতো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে মশারও কিছু ধরনগত পরিবর্তন হয়। ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপ বা ধরন রয়েছে। প্রতি বছর একই ধরনের সংক্রমণ নাও হতে পারে। যে কোনো ভাইরাসই খুব দ্রুত মিউটেশন ঘটায়। আগে কেবল শহর এলাকায় এডিস মশার প্রাদুর্ভাব দেখা গেলেও বর্তমানে নগরায়ণের প্রভাবে গ্রামেও এটি পৌঁছে গেছে বলে জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার।
