কার্বন বাণিজ্য কী? এটি কীভাবে কাজ করে?


কার্বন নির্গমন, প্রধানত কার্বন-ডাই-অক্সাইড (CO₂) এবং মিথেন (CH₄) এর আকারে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্রের স্তর বৃদ্ধির জন্য দায়ী, যা ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, দাবানল, খরা, তাপপ্রবাহ ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংঘটন ও তীব্রতা বৃদ্ধি করে। কার্বন নির্গমন হ্রাসের বহুমুখী পরিবেশগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং স্বাস্থ্যগত উপকারিতা রয়েছে। কার্বন বাণিজ্য (Carbon Trading) কার্বন নির্গমন হ্রাসের একটি উপায় এবং একইসঙ্গে একটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক ব্যবস্থা। আসুন জেনে নেই কার্বন বাণিজ্য কীভাবে কাজ করে এবং কেন এটি বাংলাদেশের জন্য লাভজনক ও কার্যকরী হতে পারে।
কার্বন বাণিজ্য কী?
কার্বন বাণিজ্য, যা কার্বন নির্গমন বাণিজ্য নামেও পরিচিত। এটি একটি বাজারভিত্তিক পদ্ধতি যা গ্রিনহাউস গ্যাস (GHG) নির্গমন হ্রাসে সহায়তা করে। এটি দেশ, কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দিষ্ট পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড বা অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের অধিকার প্রতিনিধিত্বকারী অনুমতি (permit) কেনা-বেচার সুযোগ দেয়। কার্বন নির্গমনের উপর মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে এটি অংশগ্রহণকারীদের কার্বন নির্গমনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস করতে এবং পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করে।
কার্বন নির্গমন বাণিজ্য একটি ক্যাপ-অ্যান্ড-ট্রেড (Cap-and-Trade) ব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত হয়। যেখানে সরকার বা সংশ্লিষ্ট সংস্থা মোট নির্গমনের জন্য একটি সীমা (cap) নির্ধারণ করে। কোম্পানিগুলো নির্দিষ্ট সংখ্যক কার্বন ক্রেডিট (carbon credits) পায় বা ক্রয় করে, যা তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ কার্বন-দেয়-অক্সাইড (CO₂) নির্গমনের অনুমতি দেয়। যদি কোনো কোম্পানি নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে কম কার্বন নির্গমন করে—তাহলে তারা অতিরিক্ত কার্বন ক্রেডিট অন্যদের কাছে বিক্রি করতে পারে। আর যদি কোনো প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সীমার বেশি কার্বন নির্গমন করে—তাহলে তাদের অতিরিক্ত কার্বন ক্রেডিট কিনতে হবে বা শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।
কার্বন বাণিজ্য কার্বন নির্গমন হ্রাসের একটি কার্যকরী ব্যবস্থা। কারণ এটি ব্যবসাগুলোকে পরিবেশবান্ধব হতে আর্থিকভাবে উৎসাহিত করে। তবে, এটি তখনই কার্যকরভাবে কাজ করে, যখন সঠিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়—যাতে প্রকৃত নির্গমন কমে।
কার্বন ক্রেডিট বিক্রির প্রক্রিয়া
কার্বন ক্রেডিট বিক্রির প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়, যেখানে ক্রেডিট তৈরি করা থেকে শুরু করে ক্রেতা খুঁজে লেনদেন সম্পন্ন করা পর্যন্ত বিভিন্ন পদক্ষেপ জড়িত। নিচে ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করা হলো—
কার্বন ক্রেডিট উৎপাদন
প্রথমে, একটি প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পকে গ্রিনহাউস গ্যাস (GHG) নির্গমন কমাতে বা অপসারণ করতে হবে। এই কার্যক্রমের মধ্যে বনায়ন, নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প, বা কার্বন ক্যাপচার অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। কার্বন নির্গমন হ্রাসের পরিমাপ ও যাচাই পদ্ধতি অবশ্যই স্বীকৃত তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সত্যায়ন হতে হবে।
যাচাই ও সার্টিফিকেশন
প্রকল্পটি নিম্নলিখিত স্বীকৃত কার্বন স্ট্যান্ডার্ডের মাধ্যমে যাচাই ও অনুমোদিত হতে হবে:
- ভেরিফায়েড কার্বন স্ট্যান্ডার্ড (VCS)
- গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড (Gold Standard)
- ক্লিন ডেভেলপমেন্ট মেকানিজম (CDM)
- ক্লাইমেট অ্যাকশন রিজার্ভ (CAR) ইত্যাদি।
এই মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতিটি কার্বন ক্রেডিট ১ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড (CO₂) হ্রাস বা অপসারণের সমতুল্য।
কার্বন রেজিস্ট্রিতে নিবন্ধন পদ্ধতি
যাচাইকরণের পরে কার্বন ক্রেডিটগুলো নিম্নলিখিত প্ল্যাটফর্মে নিবন্ধিত হয়:
- ভেরা (Verra)
- আমেরিকান কার্বন রেজিস্ট্রি (American Carbon Registry - ACR)
- গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড রেজিস্ট্রি (Gold Standard Registry) ইত্যাদি।
প্রতিটি কার্বন ক্রেডিটকে একটি নির্দিষ্ট সিরিয়াল নম্বর দেওয়া হয়, যা ডাবল কাউন্টিং প্রতিরোধ করে।
কার্বন বাণিজ্য কোথায় ঘটে? কার্বন ক্রেডিটের ক্রেতা কারা?
কার্বন ক্রেডিট কেনাবেচার দুটি প্রধান বাজার রয়েছে:
নিয়ন্ত্রিত বা বাধ্যতামূলক বাজার (Compliance Market)
সরকার কার্বন নির্গমনের নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করে, যেখানে নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি কার্বন নির্গমন করলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্বন ক্রেডিট কিনতে হয়। ক্যাপ-অ্যান্ড-ট্রেড (Cap-and-Trade) ব্যবস্থা অনুসারে, যারা কম পরিমাণে কার্বন নির্গমন করে তারা অতিরিক্ত ক্রেডিট বিক্রি করতে পারে, আর যারা সীমার বেশি কার্বন নির্গমন করে, তাদের কার্বন ক্রেডিট কিনতে হয় বা শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। কিছু দেশে কার্বন ট্যাক্স আছে, যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলো কার্বন ক্রেডিট কিনে তাদের কর কমাতে পারে।
কিছু নির্ভরযোগ্য কার্বন বাজারের উদাহরণ:
- ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এমিশনস ট্রেডিং সিস্টেম (EU ETS)
- ক্যালিফোর্নিয়া ক্যাপ-অ্যান্ড-ট্রেড প্রোগ্রাম
- চীনের জাতীয় ETS
- রিজিওনাল গ্রিনহাউস গ্যাস ইনিশিয়েটিভ (RGGI)
স্বেচ্ছাসেবী কার্বন বাজার (Voluntary Carbon Market - VCM)
- কোম্পানি ও ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কার্বন নির্গমন ক্ষতিপূরণ করতে ক্রেডিট কেনে।
- এই বাজারের ক্রেডিট সাধারণত বনায়ন, নবায়নযোগ্য শক্তি ও কার্বন ক্যাপচার প্রকল্প থেকে আসে।
- এখানে কোনো সরকারি বাধ্যবাধকতা নেই, বরং প্রতিষ্ঠানগুলোর টেকসই উন্নয়ন ও ব্র্যান্ডের সুনাম বৃদ্ধির জন্য কেনাকাটা করা হয়।
- প্রধান ক্রেতারা: টেক কোম্পানি, এয়ারলাইনস এবং বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ড যেগুলো নেট-জিরো লক্ষ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
- স্বীকৃত যাচাইকারী সংস্থা: ভেরা (VCS or Verra), গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড (Gold Standard), আমেরিকান কার্বন রেজিস্ট্রি (ACR), ক্লাইমেট অ্যাকশন রিসার্ভ (Climate Action Reserve or CAR)।
কার্বন ক্রেডিট বিক্রয় ও লেনদেন
কার্বন ক্রেডিট কেনাবেচা শিকাগো ক্লাইমেট এক্সচেঞ্জ (Chicago Climate Exchange), ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট এক্স (Climate Impact X) ইত্যাদির মাধ্যমে হতে পারে। দালাল বা ট্রেডাররা সরাসরি ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে চুক্তি করতে সহায়তা করে। কার্বন ক্রেডিটের মূল্য নির্ভর করে মান, চাহিদা এবং বাজারের অবস্থার উপর।
অবসান (Retirement) বা পুনরায় বিক্রয় (Trading)
- অবসান (Retirement): ক্রেতারা ক্রেডিট বাতিল করতে পারে এবং এটি রেজিস্ট্রিতে লিপিবদ্ধ হয়, যাতে নির্গমন ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত হয়।
- পুনরায় বিক্রয় (Trading): ক্রেতারা চাইলে ক্রেডিট পুনরায় বিক্রি করতে পারে।
কার্বন বাণিজ্যের সুফলতা ও উপকারিতা
কার্বন নির্গমন হ্রাসে উৎসাহ দেয় – কার্বন বাণিজ্য বিভিন্ন কলকারখানা ও ব্যবসাগুলোকে কার্বন নির্গমন হ্রাসে আর্থিকভাবে উৎসাহিত করে।
সবুজ প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়ায় – কার্বন বাণিজ্য বিভিন্ন কলকারখানার পণ্য উৎপাদন পদ্ধতিতে পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তির বিকাশে সহায়তা করে।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে – কার্বন বাণিজ্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে গ্রিন প্রযুক্তি গ্রহণে সহায়তা করে।
সাশ্রয়ী জলবায়ু পদক্ষেপকে উৎসাহিত করে– কার্বন বাণিজ্য বিভিন্ন কলকারখানার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুষম পন্থায় কার্বন নির্গমন কমানোর সুযোগ দেয়।
টেকসই প্রকল্পের জন্য অর্থায়নের সুযোগ তৈরি করে – সরকার নবায়নযোগ্য শক্তি ও সংরক্ষণ প্রকল্পের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে পারে।
কার্বন বাণিজ্যের চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা
গ্রীন ওয়াশিং (Greenwashing) এর ঝুঁকি – কিছু প্রতিষ্ঠান বাস্তবিক অর্থে কার্বন নির্গমন হ্রাসের পরিবর্তে শুধু ক্রেডিট কিনতে পারে।
মূল্য অস্থিরতা – কার্বন ক্রেডিটের মূল্য সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয়, যা ব্যবসার জন্য অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।
নিয়ন্ত্রণের অভাব – দুর্বল বিধিনিষেধ বা ফাঁকফোকর থাকলে কিছু প্রতিষ্ঠান কার্বন বাণিজ্য ব্যবস্থার অপব্যবহার করতে পারে।
সারসংক্ষেপ
কার্বন বাণিজ্য শিল্প ও ব্যবসাগুলোর জন্য কার্বন নির্গমন হ্রাসে আর্থিক প্রণোদনা তৈরি করে। যারা নির্ধারিত সীমার নিচে কার্বন নির্গমন করতে পারে, তারা অতিরিক্ত কার্বন ভাতা বিক্রি করতে পারে। আর যারা নির্ধারিত সীমার বেশি কার্বন নির্গমন করে, তাদের কার্বন ক্রেডিট কিনতে হয়।
এই ব্যবস্থাটি কার্বন নির্গমন কমানোর জন্য আর্থিক সুবিধা প্রদান করে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অবদান রাখতে পারে।
কার্বন বাণিজ্যের কার্যকারিতা এবং প্রভাব বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর কার্যকারিতা নির্ভর করে বিভিন্ন নিয়ম ও বাজার কাঠামোর উপর। এসব দিক বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, কীভাবে কার্বন বাণিজ্য আমাদের ভবিষ্যতকে আরও টেকসই করতে সাহায্য করতে পারে।