আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ রোধে মাথা ব্যথা নেই সরকারের

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট প্রতিবেদক
প্রকাশিত:২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৫:৫৯ পিএম
আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ রোধে মাথা ব্যথা নেই সরকারের

জালের মতো অলিগলিতে পরিপূর্ণ ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের একটি। উন্নয়নের জোয়ারে দূষণে হাবুডুবু খাচ্ছে এই নগরীর বাসিন্দারা। কবে যে সতেজ বাতাসে তারা প্রাণভরে শ্বাস নিয়েছেন, অনেকেই তা ইয়াদ করতে পারবেন না। এর ফলে শহরে প্রাণঘাতী বিভিন্ন রোগ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকায় লাখো প্রাইভেটকার, বাস, মোটরসাইকেল, সিএনজি, অটোরিকশা, ভ্যান ও ডবল ডেকার বাসসহ হরেক রকমের গাড়ি প্রতিটি মুহূর্তে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। এসব গাড়ি থেকে কালো মেঘের মতো বেরিয়ে আসে ধোঁয়া।

এর পাশাপাশি নির্মাণকাজ, ইটভাটা ও কলকারখানার দূষণ ঢাকার বাতাসকে আরও অস্বাস্থ্যকর করে তুলেছে। এসবের সঙ্গে এসে মিশছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর দূষিত বায়ু।

বাংলাদেশের মোট বায়ুদূষণের ৩৫ শতাংশই আশপাশের দেশগুলো থেকে আসছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু আন্তঃদেশীয় এই দূষণ রোধে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।

সব মিলিয়ে ঢাকায় এমন এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যা বাসিন্দাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ হয়ে উঠছে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরের একটিতে রূপান্তরিত হয় ঢাকা। বর্তমানে এই শহরে গড় গাড়ি চালানোর গতি ঘণ্টায় সাড়ে চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির কাছাকাছি।

বায়ুমান সূচক (একিউআই) অনুসারে, ঢাকার বাতাস সবসময়ই বিশ্বের সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর তালিকার উপরের দিকে থাকে। কখনও কখনও তা ঝুঁকিপূর্ণও হয়ে ওঠে।

এই প্রতিবেদন লেখার সময় বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯টায় ২০৯ একিউআই স্কোর নিয়ে বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী। শুধু তা-ই নয়, দূষণের স্কোরে ডবল সেঞ্চুরি পার করেছে বিশ্বের একটিমাত্র শহর—ঢাকা। ঢাকার এই বাতাস নাগরিকদের জন্য ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’।

দূষণ-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপসের এক জরিপে দেখা গেছে, ডিসেম্বরে বায়ুদূষণের যে সার্বিক অবস্থা ছিল, তা গত ৯ বছরে সর্বোচ্চ। আবার এ বছরের জানুয়ারিতে দূষণের মান ছিল ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ঢাকায় জানুয়ারিতে একাধিক দিন বায়ুদূষণের মান ৩০০-এর বেশি হয়েছে।

২০২৩ সালে বাংলাদেশে পিএম ২.৫ মাইক্রোনের গড় ঘনত্ব ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বার্ষিক বায়ুমান নির্দেশনার চেয়ে ১৬ গুণ বেশি।

আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ কী?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম জানান, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে যে দূষণ বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে সেইসব দেশে যে দূষণ যায়, সেটিই হচ্ছে আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ।

আন্তঃসীমান্ত দূষণের বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘হিমালয় থেকে, আবার ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও চীনের একটি অংশ থেকে দূষণ বাংলাদেশে আসে। এতে পুরো বাংলাদেশের ওপর দূষণ ছড়িয়ে পড়ে। শীতকালে এটা বেশি আসে।’

ড. আবদুস সালাম বলেন, ‘পার্টিকেল যত ফাইনেস্ট (সূক্ষ্ম) হবে, তত বেশি সময় ধরে তা বাতাসে ভেসে বেড়াতে ও দ্রুত ভ্রমণ করতে পারবে।’

গত ২৫ বছর ধরে বায়ুদূষণ নিয়ে গবেষণা করে আসছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এই অধ্যাপক।

তিনি আরও বলেন, ‘শীতকালে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে এ দূষণ বাংলাদেশে আসে। বর্ষাকালে কিছু জিনিস বাংলাদেশ থেকে ভারতে যায়। বাংলাদেশে যদি ১০০ শতাংশ বায়ুদূষণ থাকে, তার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ আসে বাইরের দেশ থেকে।’

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আইনুন নিশাত বলেন, ‘বাতাসের যে গতিবেগ, তাতে ভারত থেকে দূষণ আসাটা স্বাভাবিক। একসময় উত্তর দিক থেকে, আবার একসময় দক্ষিণ দিক থেকে বাতাস (বাংলাদেশে) আসে। এই প্রক্রিয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিম, উত্তর-পূর্ব দিক থেকেও বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বাতাস প্রবাহিত হয়। এই সময়ে আমাদের পাশের দেশ ভারতের দূষিত বায়ুর কিছু অংশ আমাদের এখানে আসে।’

তিনি বলেন, ‘এটা আসে প্রাকৃতিকভাবে, তারা যে জোর করে দূষণ পাঠায়—এমন না। এ অঞ্চলের সবাই যদি বায়ুদূষণ রোধ করে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’

রাস্তার ধুলা বায়ুদূষণ নয়!

অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, ‘অনেকে মনে করেন, রাস্তার ধুলাই বায়ুদূষণ, কিন্তু সেটা ঠিক নয়। রাস্তার ধুলা বেড়ে যাওয়া কিংবা কমে যাওয়া বায়ুদূষণ নয়। রাস্তার ধুলা বড় বড় পার্টিকেল (কণা), এগুলো নাকের ভেতরে ঢুকতে পারে না। যেগুলো নাকের মধ্যে ঢুকতে পারে না, সেগুলো মানুষের কোনো ক্ষতি করে না।’

বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন তিনি এভাবে, ‘পার্টিকেলের (কণা) আকার যত ক্ষুদ্র হবে, সেটা ততই ক্ষতিকর হবে। বড় পার্টিকেলগুলো নাকের মধ্যে ঢোকে না, যে কারণে মানুষের তত ক্ষতি করে না। রাস্তার ধুলা পাবলিক ন্যুইসন্স (অস্বস্তি) তৈরি করে মাত্র, এটা সত্যিকারের বায়ুদূষণ নয়।’

তার মতে, বাতাসের মান নির্ভর করে ভাসমান সূক্ষ্ম ধূলিকণা (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম-১০) ও অতিসূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণের (পিএম ২.৫) ওপর, যা পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পার্টস পার মিলিয়ন-পিপিএম) এককে।

তিনি বলেন, ‘পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) দুই দশমিক পাঁচ কিংবা তার চেয়ে ছোট এক মাইক্রোমিটারের সমান, যেটাকে আল্ট্রাফাইন পার্টিকেল বলে। সেগুলো মানুষের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আল্ট্রাফাইন পার্টিকেল একেবারে ছোট আকারের। এর মধ্যে কিছু আছে, যেগুলো আজকে গ্যাস থাকে, কাল পার্টিকেলে রূপান্তরিত হয়—সেগুলো মানুষের ক্ষতি করে।’

‘সিএনজি মেশিন ট্রিলিয়নের বেশি আল্ট্রাফাইন পার্টিকেল তৈরি করে। তারপর বড় বড় গাড়ি থেকে ব্ল্যাক কার্বন, ব্রাউন কার্বন ও পার্টিকেলসহ সবকিছু নির্গত হয়। পুরোনো প্রাইভেটকার থেকেও এসব দূষণ বের হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘দুই কারণে এটা বের হয়। তার একটা হচ্ছে, এগুলো পুরনো, আরেকটা হচ্ছে এগুলোর কলকব্জা ঠিকমতো কাজ করে না।’

‘গাড়ি যত পুরোনো হয়, তত তার কানভার্শন এফিশিয়েনসি (রূপান্তর ক্ষমতা) কমে যায়। এতে দূষণ বাড়তে থাকে।’

সুরাহার পথ কী?

আন্তঃদেশীয় দূষণ বন্ধে পাশের দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার বিকল্প নেই বলে মনে করেন অধ্যাপক আব্দুস সালাম। তার ভাষ্যে, ‘তাদের বলতে হবে যে আপনাদের দূষণ বন্ধ করুন, আমরাও আমাদেরটা বন্ধ করব। অথবা পাশের দেশ থেকে শিখতে হবে, তারা কীভাবে দূষণ কমাচ্ছে। সেভাবে দূষণ কমাতে আমাদেরও পদক্ষেপ নিতে হবে।’

যেসব কারণে বায়ুদূষণ হচ্ছে, ধীরে ধীরে সেগুলো সমাধান করতে হবে বলে জানান ঢাবির এই অধ্যাপক। ‘আমাদের যানবাহন থেকে দূষণ হয়, এটা সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়া যায়। যেমন: পুরোনো গাড়িগুলো ব্যবহার করা যাবে না; যে জ্বালানি তেল ব্যবহার করা হচ্ছে, তারও একটি নির্দেশিকা তৈরি করতে হবে ইত্যাদি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের আশপাশের দেশগুলোতে এ নিয়ে নির্দেশনা আছে। পরিচ্ছন্ন তেল আনতে হবে এবং নতুন গাড়ি চালাতে হবে। তাহলে এই সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে। তারপর আমাদের আশপাশে শিল্প কারখানাগুলো থেকে কী ধরনের দূষণ বের হচ্ছে, সেটাও বের করতে হবে।’

‘আমাদের একটা আইন আছে যে, শিল্পকারখানা থেকে দূষণ বের করা যাবে না—সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে। শহরটাকে পরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করতে হবে। প্রতিটি এলাকায় খেলার মাঠ থাকতে হবে, জলাধার থাকতে হবে। রাস্তাঘাট ঠিকমতো থাকতে হবে। তাহলে সুস্থ ও সুন্দর একটা শহর হবে।’

বায়ুদূষণ রোধে পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও চীনকেও সম্পৃক্ত করা যেতে পারে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আন্তঃদেশীয় দূষণ বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে কাঠমান্ডু রোডম্যাপকে কার্যকর করতে পদক্ষেপ নিতে হবে।’

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ‘আমাদের দেশের নিজস্ব বায়ুদূষণের পাশাপাশি যদি ৩৫ শতাংশ পাশের দেশ থেকে আসে, এটা তো থেকেই যাবে। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রয়োজন। দুটো জিনিস করা যেতে পারে— তথ্য দেওয়া-নেওয়া ও বিহেভিয়ার স্টাডি (অবস্থার পর্যবেক্ষণ) করা। এভাবে মানুষকে সতর্ক করা যেতে পারে।’

বাংলাদেশ, ভারত দুই দেশই বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের ১৪টি শহরে মনিটরিং করা হয়, ভারতও বড় বড় শহরগুলোতে মনিটর করে। বাতাসের দিকটা আবহাওয়া দপ্তর মনিটর করে। যখন ভারত থেকে দূষিত বায়ু আমাদের দেশে আসছে, তারা জানিয়ে দিলে আমরা জনগণকে সতর্ক করতে পারি।’

ঢাকায় কেন এত দূষণ?

ঢাকার দূষণের জন্য বেশ কয়েকটি উপকরণকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, গাড়ির কালো ধোঁয়া।

অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ‘পেট্রোল ঠিকমতো না পুড়লে কালো পার্টিকেল (কণা) তৈরি হয়। দেখবেন, নতুন গাড়িতে এগজস্ট পাইপে তেমন কোনো ধোঁয়া থাকে না। পুরোনো গাড়ির এফিশিয়েন্সি (সক্ষমতা) কম থাকে।’

‘ফ্লাইওভারের স্লোপে দেখি, ট্রাক উঠতে পারছে না। অতিরিক্ত ভার বহন করলেই পেট্রোল ঠিকমতো পোড়ে না; তখন এই কালো ধোঁয়া বের হতে থাকে। আমাদের ১০ টনের ট্রাক ২৫ টন নিয়ে রওনা দেয়। ওভারলোডিং, ইঞ্জিনের রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই কালো ধোঁয়া বের হয়,’ বলেন তিনি।

এই জলবায়ু বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ঢাকায় ব্যাপক আকারে অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলছে। আপনি যদি উত্তরায় যান, এরপর এয়ারপোর্টের দিকে তাকালে অনেক দূর পর্যন্ত ধোঁয়াশা দেখতে পাবেন। নির্মাণকাজের জায়গায় বালু, সিমেন্ট খোলা ফেলে রাখা হয়। নির্মাণসামগ্রীর ওপর দিয়ে যখন বাতাস প্রবাহিত হয়, তখন ধূলিকণা উপরে ওঠে। এভাবে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’

তিনি বলেন, ‘রাজধানীর আশপাাশের ইটের ভাটাগুলো হয় উত্তর, নয়তো দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। আমাদের বাতাস বারো মাসের মধ্যে সাত-আট মাসই উত্তর থেকে দক্ষিণে, দক্ষিণ থেকে উত্তরে যায়। তার মানে দাঁড়ায়, গাজীপুর থেকে সব ধোঁয়া আসছে ঢাকা শহরে।’

‘এছাড়া রাস্তাঘাটের ধুলা যখন ঝাড়ু দেওয়া হয়, তখন সেটা ছড়িয়ে পড়ে। উন্নত দেশগুলোতে তাদের নগরকে আশপাশের জলাশয়ের পানি দিয়ে ধুয়ে দেয়। আর আমাদের বিমানবন্দর এলাকার মতো দু-চারটি জায়গা ছাড়া এটা করা হয় না।’

যেভাবে দূষিত-নগরী নয়াদিল্লি

আইনুন নিশাত বলেন, ‘ভারতের দিল্লিতে যখন ওদের আমন ধান কেটে ফেলা হয়, কিংবা আরও পরে এপ্রিল-মে মাসে যখন বোরো ধান, গম কাটা হয়, তখন খালি চোখেই বোঝা যায় যে প্রচণ্ড দূষণ। শহরের রাস্তা দিয়ে গেলে ২০ থেকে ২৫ ফুট দূরে কিছু দেখা যায় না। ধোঁয়াশায় পুরো অঞ্চল ঢাকা থাকে।’

‘ধানের ও গমের যে গোড়া থেকে যায়, সেটা পোড়ানোর কারণে এমনটা হয়। ধান কিংবা গমের গোড়া কেটে নিতে যা খরচ, তার চেয়ে পুড়িয়ে দিলে খরচ কম হয় বলে কৃষকরা এটা করে থাকেন।’

কাঠমান্ডু রোডম্যাপের হালহকিকত

বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানের সমন্বয়ে গঠিত অঞ্চল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত এয়ারশেডের একটি, সংক্ষেপে যেটিকে দ্য আইজিপি-এইচএফ বলে। এয়ারশেড হলো একটি ভৌগোলিক এলাকা যেটির মধ্যে বায়ুদূষণ সীমাবদ্ধ থাকে ও সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে চলাচল করে।

কাঠমান্ডু রোডম্যাপে ২০৩০ সালের মধ্যে এই অঞ্চলের বাতাসে বছরে গড় পিএম২.৫ প্রতি ঘনমিটারে ৩৫ মাইক্রোগ্রামে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। এর অর্থ হচ্ছে, বাতাসের মান উন্নত করে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমিয়ে আনতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও) এই মান নির্ধারণ করে দিয়েছে। ২০২২ সালের ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর নেপালে একটি বৈঠকের আয়োজন করেছিল ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেইন ডেভলপমেন্ট (আইসিআইএমওডি) ও বিশ্বব্যাংক।

বায়ুদূষণ রোধে চার দেশের প্রথম কোনো পদক্ষেপ ছিল এটি। হিমালয়ের পাদদেশ ও সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে বাতাসের মান উন্নয়নে সে সময় কাঠমান্ডু রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হয়। দুই দিনের আলোচনা শেষে ১৫ ডিসেম্বর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

আইসিআইএমওডির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, উন্নয়নের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো বায়ুদূষণ। যে কারণে বায়ুমান ব্যবস্থাপনা (একিউএম) জোরালোভাবে প্রযোগ করা দরকার। বায়ুমান বাড়াতে বহুদেশীয় পদক্ষেপ নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তবে বর্তমানে এসে কাঠমাণ্ডু রোডম্যাপের আর কোনো কার্যকারিতা নেই বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা। তিনি ইউএনবিকে বলেন, ‘এমন একটি রোডম্যাপ নেওয়া হয়েছিল, তবে পরে সেটি আর এগোয়নি। এটি এখন অকার্যকর।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আসলে বিষয়টি এগোনো যায়নি। আমরা নিজের দেশের বায়ুদূষণই বন্ধ করতে পারিনি।’

বায়ুদূষণে যে সমস্যা হতে পারে

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসভিত্তিক দ্য হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বে যেসব কারণে সবচেয়ে বেশি অকালমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, সেই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বায়ুদূষণ। আর প্রথমটি হচ্ছে রক্তচাপ।

স্বল্প সময়ের জন্য বায়ুদূষণের কবলে পড়লে অ্যাজমা, হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোকও হতে পারে। বিশেষ করে যেসব বয়স্ক মানুষের আগে থেকেই চিকিৎসা-সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য এ ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি।

আর দীর্ঘমেয়াদে বায়ুদূষণে থাকলে হার্ট ও ফুসফুসের মারাত্মক সমস্যা দেখা দেওয়ার শঙ্কা আছে, যা মানুষকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যেতে পারে। বায়ুদূষণের কারণে হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) ও ফুসফুসে প্রদাহের মতো শারীরিক জটিলার সৃষ্টি হতে পারে।

জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে ৫০ কোটির বেশি শিশু অস্বাস্থ্যকর বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে। প্রতিদিন পাঁচ বছরের কম বয়সী ১০০টি শিশুর মৃত্যুর সঙ্গে বায়ুদূষণের সম্পর্ক রয়েছে।

ইউনিসেফের পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক জুন কুনিজি বলেন, বায়ুদূষণে শিশুর শারীরিক বিকাশ কমে যায়, ফুসফুসে ক্ষতি করে এবং মানসিক দক্ষতার বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়। প্রতিটি শ্বাসই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু দূষণের কারণে তা বহু শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

অধ্যাপক আব্দুস সালাম এ বিষয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রতি বছর দেড় থেকে দুই লাখ মানুষ বায়ুদূষণের কারণে মারা যান। এতে দেশের মানুষের গড় আয়ু ছয় থেকে আট বছর পর্যন্ত কমে যাচ্ছে। এছাড়া এই দূষণের কারণে মানুষ যে রোগে আক্রান্ত হন, তাতে বাংলাদেশের জিডিপির পাঁচ শতাংশ খরচ হয়ে যায়, যা ১৪ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলারের সমান।’

বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘বায়ুদূষণের কারণে একটি প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ আবশ্যক। তবে সেটি তখনই সম্ভব হবে, যখন যেসব জায়গাগুলো থেকে বায়ুদূষণ হচ্ছে, অগ্রাধিকারভিত্তিতে সেগুলো নিরসনে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’