বাংলাদেশ ও ভূমিকম্প ঝুঁকি, আর্থিক প্রভাব ও করণীয়

Bangla Post Desk
মো. ইকবাল হোসেন চৌধুরী
প্রকাশিত:২৩ নভেম্বর ২০২৫, ০২:১৮ পিএম
বাংলাদেশ ও ভূমিকম্প ঝুঁকি, আর্থিক প্রভাব ও করণীয়
ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটি পরিচিত বাস্তবতা। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন, খরা—এসব দুর্যোগ নিয়মিতভাবে মোকাবেলা করে টিকে থাকে দেশের মানুষ। তবে ভূমিকম্প অন্য সব দুর্যোগের তুলনায় ভিন্ন বৈশিষ্ট্য, তীব্রতা ও ঝুঁকি বহন করে। ভূমিকম্প অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের তুলনায় সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত, সবচেয়ে দ্রুত এবং সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক।

ঘূর্ণিঝড় বা বন্যার মতো আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ কম থাকায় ভূমিকম্পের ক্ষতি প্রতিরোধ পুরোপুরি করা যায় না, কমানো যায়।

বাংলাদেশ ভৌগোলিক কারণে পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থিত। ভারতীয়, বার্মিজ ও ইউরেশীয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলের কাছে অবস্থান করায় এখানে মাঝারি থেকে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা প্রবল। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান ও গবেষণা বলছে, ঝুঁকির মাত্রা বাস্তব এবং বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা অত্যন্ত বেশি।

গত ২১ নভেম্বর এ সংঘটিত  ভূমিকম্প এক প্রাকৃতিক সতর্কবার্তা বহন করে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক শতকে দেশে অন্তত ২০০টিরও বেশি ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় ধরনের ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। বছরে গড়ে ২৫ থেকে ৩০টি ক্ষুদ্র ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে, যার বড় অংশ সিলেট, চট্টগ্রাম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। আন্তর্জাতিক সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি-জাইকার এক গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকায় ম্যাগনিচিউড ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে ৭০ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, দুই লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে এবং সামগ্রিক ক্ষতি হতে পারে ৩০ থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার।

ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে ওঠা নগরীগুলোর একটি হওয়ায় ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি বহুগুণ বাড়তে পারে। একটি বড় ধরনের ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে বহুমাত্রিক—অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ তিন থেকে পাঁচ ট্রিলিয়ন টাকা (৩০ থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার) ছাড়াতে পারে, যা বাংলাদেশের জিডিপির ১০ থেকে ১৫ শতাংশের সমান। অবকাঠামোগত ক্ষতি; সেতু, রাস্তা, ভবন, ফ্লাইওভার, হাসপাতাল, স্কুল—সব মিলিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ঝুঁকিতে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি সরবরাহ বিঘ্নিত হলে নগরজীবন অচল হয়ে পড়তে পারে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম দেশের মোট অর্থনৈতিক উৎপাদনের প্রায় ৬০ শতাংশ বহন করে, গার্মেন্টস ও শিল্পাঞ্চলে উৎপাদন বন্ধ হলে রপ্তানি খাতে মারাত্মক আঘাত আসবে।


আর্থিক ও ব্যাংকিং খাত ঝুঁকিগ্রস্ত হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের ঋণ শোধে অক্ষমতা বাড়লে নন-পারফরমিং লোন বা খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাবে। বীমা কম্পানিগুলোর সক্ষমতা দুর্বল হওয়ায় বড় ক্ষতি সামাল দিতে তারা অক্ষম হয়ে পড়তে পারে।

ভূমিকম্প প্রতিরোধ নয়, ক্ষয়ক্ষতি কমানোই প্রধান লক্ষ্য। এখানে সরকারের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। BNBC, Bangladesh National Building Code বা বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুসরণ বাধ্যতামূলক করা এবং রাজউক, সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সুষুম মনিটরিং নিশ্চিত করা জরুরি। পুরনো স্কুল, হাসপাতাল ও আবাসিক ভবনগুলো পুনর্মূল্যায়ন করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা ও রেট্রোফিটিং করা। দেশে আরো সিসমিক স্টেশন, ভূপ্রযুক্তি গবেষণাগার ও আঞ্চলিক মনিটরিং সিস্টেম প্রয়োজন। ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সিভিল ডিফেন্সকে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ ও আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে। স্কুল ও অফিসে নিয়মিত ভূমিকম্প মহড়া বাধ্যতামূলক করা উচিত। মিডিয়া ও সরকারি প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।

সরকারের পাশাপাশি রিয়েল এস্টেট খাত ভূমিকম্পজনিত ঝুঁকি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিএনবিসি বা বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুসারে ভূমিকম্প সহনীয় নকশা, সঠিক ভিত্তি ও মানসম্মত ইট-সিমেন্ট-রড ব্যবহারের বিকল্প নেই। ঢাকার মতো নরম মাটিতে নির্মাণের আগে সঠিক ঝড়রষ ঞবংঃ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাজের মান নিশ্চিত করতে প্রকৌশলী ও তদারককারীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। স্ট্রাকচারাল ডিজাইন ও ব্যবহৃত উপকরণের প্রমাণ ক্রেতাকে জানানো রিয়েল এস্টেট কম্পানির নৈতিক দায়িত্ব।

ভূমিকম্প বাংলাদেশের জন্য বাস্তব ও গুরুতর হুমকি, এটি কোনো অনুমান নয়, বৈজ্ঞানিক সতর্কতা। তবে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর সুযোগ এখনো আছে। জাপান পৃথিবীর সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলোর একটি হওয়ায়, সেখানে ভূমিকম্প মোকাবেলায় অত্যন্ত উন্নত ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। জাপান যে প্রধান পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছে, তা হলো উন্নত বিল্ডিং কোড ও ভূমিকম্প সহনশীল নির্মাণ, উন্নত ভূকম্পন পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ ব্যবস্থা, শিক্ষা-মহড়া ও জনসচেতনতা, উন্নত গবেষণা ও প্রযুক্তি, সুনামি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, নগর পরিকল্পনায় দুর্যোগ সহনশীলতা ও জরুরি সাড়া ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা। জাপানের ভূমিকম্প মোকাবেলা ব্যবস্থা বিশ্বে সবচেয়ে উন্নত, কারণ সেখানে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, কঠোর বিল্ডিং কোড, প্রযুক্তি, জনসচেতনতা ও জরুরি সাড়া ব্যবস্থা—সবই সমন্বিতভাবে কাজ করে। বাংলাদেশ যদি একই ধরনের নীতি, প্রযুক্তি ও সচেতনতা গ্রহণ করতে পারে, তাহলে একটি বড় ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষতি অর্ধেকে নেমে আসতে পারে।

দায়িত্বশীল সরকার, সচেতন রিয়েল এস্টেট খাত এবং প্রস্তুত জনগণ—এই তিনটি স্তম্ভ পৃথিবীর যেকোনো ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ দেশকে নিরাপদ রাখতে পারে। বাংলাদেশকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—প্রস্তুত হয়ে বাঁচবে, নাকি উদাসীনতায় বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে।

লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক

জেসিএক্স ডেভেলপমেন্টস লি.