জাবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগ: শিক্ষকদের গ্রুপিংয়ে কম নম্বর পেলেন শিক্ষার্থী


জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অনার্স চতুর্থ বর্ষের (৪৯তম ব্যাচ) এক শিক্ষার্থীর গবেষণার রিপোর্টে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নম্বর কমিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে একই বিভাগের দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
তারা হলেন—প্রভাষক অশীষ কুমার দত্ত ও অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান।
এই ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বরাবর একটি অভিযোগপত্র দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) দুপুরে জাবি উপাচার্য বরাবর অভিযোগপত্রটি পাঠিয়েছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী রবিন হোসেন।
এতে বলা হয়, ‘গত ৫ মার্চ আমার অনার্স ৪র্থ বর্ষের রেজাল্ট প্রকাশিত হয়। আমি গত ১০ মার্চ ফলাফলের গ্রেডশিট উত্তোলন করি। সেই গ্রেডশিটে আমার ‘রিসার্চ রিপোর্ট’ কোর্সে ‘ডি’ গ্রেড দেখতে পাই, যা আমার প্রত্যাশার চেয়ে বহুলাংশে কম। বিগত বছরে অনার্সের কোনো পরীক্ষায় আমি ‘ডি’ গ্রেড পাইনি। আমার বিভাগের ‘ওয়াইল্ডলাইফ’ ব্রাঞ্চের কিছু শিক্ষক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটা করেছেন। এমতাবস্থায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে আমার এই রিপোর্টটির রেজাল্ট পুনঃনিরীক্ষণ না করা হলে, আমি আমরণ অনশনে বসব।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ‘প্রাণিবিদ্যা বিভাগে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রজেক্ট/রিসার্স রিপোর্ট কোর্স করতেই হবে। এটা বাধ্যতামূলক। এটি দুই ক্রেডিটের একটি মূল্যায়নভিত্তিক কোর্স। এখানে প্রথম পরীক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীর সুপারভাইজার, পাশাপাশি দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরীক্ষক হিসেবে বিভাগের অন্য দুজন শিক্ষক নম্বর দিয়ে থাকেন।’
রবিন হোসেন বলেন, ‘আমি ওয়াইল্ডলাইফ ব্রাঞ্চের প্রফেসর ড. মনিরুল হাসান খানের অধীনে আমার গবেষণা রিপোর্ট সম্পন্ন করি। যিনি অরাজনৈতিক শিক্ষক হিসাবে পরিচিত। এতে অন্য গ্রুপের আওয়ামীপন্থি শিক্ষকরা ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে ইচ্ছাকৃতভাবে নম্বর কম দেন। আমার দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরীক্ষক উভয়ই আওয়ামীপন্থি।’
‘আমি বিভাগের চেয়ারম্যান এবং উপাচার্য বরাবর অভিযোগপত্র দিয়েছি। আমার গবেষণা রিপোর্ট অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষকের মাধ্যমে মূল্যায়ন করুক, এতে আমার মার্কস না বাড়লে মেনে নেব, আর যদি বাড়ে তাহলে যেন তদন্ত সাপেক্ষে একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। অন্যথায় আমি অনশনে বসব,’ বলেন ওই শিক্ষার্থী।
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মাস্টার্সের এক শিক্ষার্থী মারফত জানা যায়, বন্যপ্রাণিবিদ্যা গবেষক শিক্ষকদের মধ্যে দুটি গ্রুপ রয়েছে। একটি আওয়ামীপন্থি, অন্যটি অরাজনৈতিক। আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের নেতৃত্বে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য ও জুলাই হামলায় অভিযুক্ত অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ, প্রফেসর ড. কামরুল হাসানসহ অন্যন্য আওয়ামীপন্থি শিক্ষকরা। অরাজনৈতিক গ্রুপটির নেতৃত্বে আছেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিরুল হাসান খানসহ অন্যন্য শিক্ষকরা। তাদের মধ্যকার দ্বন্দের কারণে ভুগতে হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক এক শিক্ষার্থী জানান, ‘এখানে শিক্ষকদের মাঝে প্রচুর গ্রুপিং হয়ে থাকে। আমি একজন শিক্ষকের অধীনে থিসিস করেছিলাম, যার ফলে অন্যগ্রুপের শিক্ষকরা আমাকে ভাইভাতে অনেক কম মার্কস দিয়ে রেজাল্ট ধসিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ বাকি কোর্সগুলোতে আমি ভালো করেছিলাম। শুধু আমি না, আমার মতো আরও অনেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটছে, কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারেননি।’
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর সুপারভাইজার অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুল হাসান খান বলেন, ‘আমার অধীনে দুজন শিক্ষার্থী কাজ করেছেন। তার মধ্যে একজনকে অকৃতকার্য করা হয়েছে এবং ভুক্তভোগী রবিনকে 'ডি' গ্রেড দেওয়া হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ একটি অস্বাভাবিক বিষয়। কেননা, আমি দেখেছি তার অন্যান্য বিষয়গুলোতে অনেক ভালো মার্কস আছে। আমি বিষয়টি বিভাগীয় প্রধানকে জানিয়েছি। অথোরিটি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে আশা করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওই শিক্ষার্থী একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এটা ভালো কাজ হয়েছে। আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুজ্জামান মনির বলেন, ‘মার্কস দেওয়ার ক্ষেত্রে পরীক্ষা কমিটির কোনো ইখতিয়ার নেই। পরীক্ষা কমিটি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিস ও বিভাগের শিক্ষকদের যোগ করা মার্কস ক্রোস চেক করেন। ওই শিক্ষার্থী প্রশাসনের কাছে নিজের আবেদন পেশ করতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রশাসন এ বিষয়ে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেবেন।’
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মানছুরুল হক বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে এখন কিছুই বলতে পারছি না। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী একটি অভিযোগপত্র দিয়েছেন। আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্তসাপেক্ষে একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, ‘এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে জানতে পেরেছি। এ ব্যাপারে এখনই কিছু বলতে পারছি না। অভিযোগপত্র এখনো হাতে পাইনি। অভিযোগপত্র সম্ভবত অফিসে এসেছে। আমার হাতে এলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী তদন্তসাপেক্ষে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
অভিযুক্ত দুই শিক্ষক প্রভাষক অশীষ কুমার দত্ত ও অধ্যাপক ড. কামরুল হাসানের সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাদের কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।