দেশে সোনার দাম ২৬ মাসেই দ্বিগুণ

Bangla Post Desk
বাংলা পোস্ট প্রতিবেদক
প্রকাশিত:০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০২:০০ পিএম
দেশে সোনার দাম ২৬ মাসেই দ্বিগুণ

সোনা সব সময়ই দামি ধাতু। তবে বৈশ্বিক অস্থিরতার সুযোগে ধাতুটির মূল্য অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে বাড়ছে। তাতে প্রায় ২৬ মাসের ব্যবধানে সোনার দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এখন প্রতি ভরির দাম দুই লাখ টাকার বেশি। সোনার দাম এখানে থামবে, এমন কোনো লক্ষণ নেই। উল্টো দাম আরও বাড়ার ইঙ্গিত মিলছে।

বৈধ পথে সোনা আমদানি না হলেও বৈশ্বিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে এর প্রভাব দেশেও পড়ে। বর্তমানে সোনার বৈশ্বিক দর ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। প্রতি আউন্সের (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) দাম চার হাজার ডলার ছুঁই ছুঁই করছে। আগামী বছরের মধ্যে সেটি ৪ হাজার ৯০০ ডলারে উন্নীত হতে পারে—এমন পূর্বাভাস দিচ্ছে বিশ্বের নামীদামি বাজার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান।

বিশ্ববাজারে সোনার দাম বাড়লে দেশেও বাড়বে, এমনটাই বলছেন দেশের জুয়েলার্স ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে সমাজের অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে সোনা। ধনিক শ্রেণি ছাড়া আর কেউ সোনার অলংকার কিনবে না। তাতে অল্প কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যদের ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়বে। টানা মূল্যবৃদ্ধির কারণে কয়েক দিন বড় জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো ক্রয়াদেশ পেয়েছে। এরপর বিক্রয়কেন্দ্রগুলো ক্রেতাশূন্য। আর ছোট ও মাঝারি দোকানগুলো বেচাবিক্রির খরায় ভুগছে।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সোনার ভরি ছিল ১৭০ টাকা। ১০ বছরের ব্যবধানে দাম বেড়ে হয় ৩ হাজার ৭৫০ টাকা। পরের ২০ বছরে সোনার দাম দ্বিগুণ হয়। ২০০০ সালে ২২ ক্যারেটের সোনার ভরি ছিল সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৯০০ টাকা। এর পরের দশকে ধাতুটির দাম দ্রুতগতিতে বাড়ে। ২০১০ সালে প্রতি ভরির দাম ছিল ৪২ হাজার ১৬৫ টাকা।

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো সোনার দাম ৫০ হাজার টাকা হয়। এর সাড়ে পাঁচ বছর পর, অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুলাইয়ে এক লাখ টাকা ভরি হয়। এরপর উত্থান-পতনের মধ্যে থাকলেও গত ফেব্রুয়ারিতে সোনার ভরি দেড় লাখ টাকার মাইলফলকে পৌঁছায়। আর গতকাল মঙ্গলবার বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৭২৬ টাকা। এরপর মঙ্গলবার রাতে আরেক দফা বেড়েছে দাম। তার মানে প্রায় ২৬ মাসের ব্যবধানে সোনার ভরি দ্বিগুণ হয়েছে।

সোনার দাম বাড়লে একদিকে নতুন করে অলংকার কেনা ব্যয়বহুল হয়, অন্যদিকে পুরোনো অলংকারের মূল্যমান বাড়ে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আপনি যদি দুই বছর আগে ২২ ক্যারেটের এক ভরি ওজনের অলংকার ১ লাখ ৭৭৭ টাকায় কিনে থাকেন (ভ্যাট ও মজুরি ছাড়া হিসাব), এখন সেটি বিক্রি করতে গেলে আপনি প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬০৩ টাকা পাবেন। তার মানে ভরিতে আপনার মুনাফা ৬৫ হাজার ৮২৫ টাকা। উল্লেখ্য, গয়না বিক্রি করতে গেলে বর্তমান ওজন থেকে ১৭ শতাংশ বাদ দিয়ে মূল্য নির্ধারণ করা হয়।

পুরোনো অলংকার বিক্রির কি এখন সেরা সময়—এমন প্রশ্নের জবাবে জুয়েলার্স সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দিন দিন সোনা দামি ধাতু হচ্ছে। বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে দাম আরও বাড়বে। ফলে সোনার অলংকার নিরাপদভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। এখন ধরে রাখতে পারলে ভবিষ্যতে ভালো মুনাফা মিলবে।

দাম আর কত বাড়বে

বিশ্ব অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির সঙ্গে সোনার দামের সম্পর্ক রয়েছে। অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা মানে সোনার বাজারে মূল্যবৃদ্ধি। কারণ, অস্থির সময়ে বিভিন্ন দেশ সোনায় বিনিয়োগ করে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়েও সোনার দাম বেশি বাড়ে।

করোনার সময়, অর্থাৎ ২০২০ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) সোনার দাম ২ হাজার ৭০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। পাঁচ বছরের ব্যবধানে সেই দাম প্রায় দ্বিগুণ হওয়ার পথে রয়েছে। গতকাল বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম একপর্যায়ে ৩ হাজার ৯৮০ ডলারে ওঠে।

রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় কারণে বিনিয়োগকারীরা সোনায় বিনিয়োগে ঝুঁকেছেন। যুক্তরাষ্ট্র নীতি সুদহার আরও কমাতে পারে—এ আশঙ্কায় দাম আরও বেড়েছে। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে সোনা ক্রয় করছে। সে কারণে চলতি বছর বৈশ্বিক বাজারে সোনার দাম এখন পর্যন্ত ৫১ শতাংশ বেড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস গত সোমবার দেওয়া এক পূর্বাভাসে বলেছে, ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে প্রতি আউন্স সোনার দাম ৪ হাজার ৯০০ ডলারে পৌঁছাতে পারে। যদিও আগে প্রতিষ্ঠানটির পূর্বাভাস ছিল আগামী বছরের ডিসেম্বরে সোনার দাম হতে পারে ৪ হাজার ৩০০ ডলার।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের জুয়েলার্স সমিতির একজন নেতা বলেন, বৈশ্বিক বাজারে সোনার দাম আউন্সপ্রতি আর এক হাজার ডলার বাড়লে দেশে প্রতি ভরি সোয়া দুই লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। যেহেতু বৈধ পথে আমদানি হয় না, সে কারণে বিশ্ববাজারের থেকে দেশে সোনার দাম সব সময়ই কয়েক হাজার টাকা বেশি থাকে।

জুয়েলারিশিল্প কি টিকবে

সারা দেশে প্রায় ৪০ হাজার জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ভেনাস জুয়েলার্স, আমিন জুয়েলার্স, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড, আপন জুয়েলার্স, সুলতানা জুয়েলার্সের মতো বেশ কিছু ব্র্যান্ড থাকলেও অধিকাংশই ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান।

সোনার আকাশচুম্বী দামের কারণে দেশের জুয়েলারিশিল্প টিকবে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে জুয়েলার্স সমিতির সাবেক সভাপতি এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, অনেক দিন ধরেই দেশের নির্দিষ্ট একটি শ্রেণি সোনার অলংকার কেনে। দাম যতই বাড়ুক না কেন, তারা কেনা বন্ধ করবে না। ফলে জুয়েলারিশিল্প ধ্বংস হবে না। তুলনামূলক কম আয়ের মানুষের জন্য ১৮ ক্যারেটের অলংকার তৈরির প্রবণতা বাড়তে পারে। এমন অলংকারে ৭৫ শতাংশ খাঁটি সোনা থাকে।

এনামুল হক আরও বলেন, সোনা যেভাবে দ্রুত দামি হচ্ছে, তাতে বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে ধাতুটি। যদিও বিনিয়োগের সুযোগ নেই বললেই চলে। বেসরকারি তফসিলি ব্যাংকের মাধ্যমে সোনা বেচাবিক্রির সুবিধা যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক চালু করে, তাহলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। একই সঙ্গে জুয়েলারিশিল্পও লাভবান হবে।