ফেনীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৭ স্থানে ভাঙন, ৩৫ গ্রাম প্লাবিত


ফেনীতে টানা ভারি বৃষ্টি ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি পানিতে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৭টি স্থানে ভেঙে গেছে। এতে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন ২০ হাজার মানুষ। বন্ধ রয়েছে ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়কে যানচলাচল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে করে যাতায়াত করছেন সাধারণ মানুষ।
ফেনী বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি জানিয়েছে, প্লাবিত এলাকার অনেক বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বৈদ্যুতিক মিটার ও সাব-স্টেশন ডুবে যাওয়ায় নিরাপত্তার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এ ব্যবস্থা চলতে পারে।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ফেনী জেলায় মঙ্গলবার বিকাল ৩টা থেকে আজ বুধবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বর্তমানে বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে। বৃষ্টি না হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
বাঁধের ১৭ স্থানে ভাঙন, ৩৫ গ্রাম প্লাবিত
টানা তিন দিনের ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের ১৭টি স্থানে ভাঙন ধরেছে। প্লাবিত হয়েছে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার অন্তত ৩৫ গ্রাম। পরশুরামে মুহুরী নদীর গেজ ষ্টেশনে মঙ্গলবার সকাল ৬টায় পানির লেভেল ৬.৯৭ মিটার, রাত ৮টায় ১৩.৮৫ মিটার ছিল (বিপদসীমা ১২.৫৫ মিটার)। যা বিপৎসীমার ১৩০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। দীর্ঘ সময় বিপদসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় পরশুরাম উপজেলায় মুহুরী নদীর ডান তীরে জিরো পয়েন্টে বাংলাদেশ ভারত টাই বাঁধের সংযোগস্থল দিয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে।
মুহুরী নদীর উভয় তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে পরশুরাম উপজেলার জঙ্গলগোনা-২টি (মুহুরী, ডান তীর), উত্তর শালধর- ১টি (মুহুরী নদীর ডান তীর), নোয়াপুর - ১টি (মুহুরী নদীর বাম তীর), পশ্চিম অলকা- ১টি (মুহুরী নদীর বাম তীর), ডি এম সাহেবনগর- ১টি (সিলোনিয়া নদীর বাম তীর), পশ্চিম গদানগর-১টি (সিলোনিয়া নদীর বাম তীর), দক্ষিণ বেড়াবাড়ীয়া -১টি (কহুয়া নদীর বাম তীর), পূর্ব সাতকুচিয়া- ১টি (কহুয়া নদীর ডান তীর), উত্তর টেটেশ্বর- ১টি (কহুয়া নদীর বাম তীর) সহ ১০টি স্থানে ভাঙ্গন হয়েছে এবং ফুলগাজী উপজেলায় দেড়পাড়া ২টি (মুহুরী নদীর ডান তীর), শ্রীপুর- ২টি (মুহুরী নদীর ডান তীর), উত্তর দৌলতপুর ১ টি (কহুয়া নদীর ডান তীর), কমুয়া ১টি (সিলোনিয়া নদীর বাম তীর) সহ ৭টিসহ মোট ১৭টি স্থানে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছে।
এছাড়া, বন্যায় বাঁধের বিভিন্ন স্থানে পানি উপচিয়ে বন্যা বাঁধে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে বন্যার পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। সবশেষ সকাল ১০ টায় পানির লেভেল ১৩.৮৫ মিটার। বিকেল ৫ টায় পানির লেভেল ১২.৭৪ মিটার।
বন্যা-দুর্গত এলাকায় ট্রাক-পিকআপ যাতায়াত
বন্ধ হয়ে গেছে ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়কে যানচলাচল। জরুরি প্রয়োজনে পিকআপে করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফুলগাজী থেকে ফেনীর উদ্দেশে যাচ্ছেন মানুষ।
রাহেনা আক্তার নামে এক যাত্রী বলেন, রাস্তায় ট্রাক-ট্রলি ছাড়া আর কোনো যানবাহন নেই। চিকিৎসার প্রয়োজনে শহরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছি। ভাড়া সিএনজি অটোরিকশার চেয়ে অনেক বেশি নিচ্ছে। ঝুঁকি থাকলেও নিরুপায় হয়ে যাচ্ছি।
মো. লিংকন নামে ট্রাকের আরেক যাত্রী বলেন, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সড়কে পানি বাড়ছে। ভাঙনের স্থান দিয়ে পানি প্রবেশ করে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। প্রয়োজনের তাগিদে বাড়তি ভাড়া ও ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছি।
মফিজুল ইসলাম নামে এক পিকআপের চালক বলেন, সড়কের অনেক স্থানে পানি থাকায় রাস্তায় সিএনজি অটোরিকশাসহ যানচলাচল বন্ধ রয়েছে। ভাড়া সিএনজি অটোরিকশার চেয়ে ৫০ থেকে ৭০ টাকা বেশি নিচ্ছি। জরুরি প্রয়োজনে গাড়িতে মানুষদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
পরশুরামের চিথলিয়া এলাকার আবদুল মান্নান জানান, মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে পানি ঘরে ঢুকতে শুরু করে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি। গত বছরও বন্যায় সব হারিয়েছি, এবার আবারও একই পরিস্থিতি।
মির্জানগরের রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করেন, পাউবো কর্মকর্তাদের অবহেলায় বলামুখা বাঁধের প্রবেশপথ বন্ধ করা হয়নি। সময়মতো ব্যবস্থা নিলে এ বিপদ এড়ানো যেত।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, পরশুরামের মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমা ছাড়িয়েছে। মঙ্গলবার (৮ জুলাই) রাত ১২টায় নদীর পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ১৩.৯২ মিটার, যা বিপৎসীমার চেয়ে ১.৫৭ মিটার বেশি। মাত্র ১৫ ঘণ্টায় নদীর পানি ৬.৯২ মিটার (২২ ফুট ১০ ইঞ্চি) বেড়েছে।
ফেনী পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন সতর্ক করে দিয়ে বলেন, উজানে ভারতের ত্রিপুরায় বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে পানির স্তর আরও বাড়তে পারে, নতুন করে বাঁধ ভাঙনের আশঙ্কা রয়েছে।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ফেনীতে ৪৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার (৮ জুলাই) বেলা ৩টা থেকে আজ বুধবার (৯ জুলাই) বেলা ৩টা পর্যন্ত ( ২৪ ঘণ্টায়) আবহাওয়া অফিস ফেনীতে বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে ১৪১ মিলিমিটার। ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান বলেন, বুধবার রাতে ও বৃহস্পতিবারও মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টি হতে পারে।
উপজেলা প্রশাসন যা বলছেন
পরশুরামের ইউএনও আরিফুর রহমান বলেন, মাঠ পর্যায়ে সার্বক্ষণিক মনিটরিং চলছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হলেও এখনও অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছেন না। ২৮৯টি পরিবারের ১ হাজার ২৩৭ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন। ২০৫টি পশু আশ্রয়ন কেন্দ্রে রয়েছে।
ফুলগাজীর ইউএনও ফাহরিয়া ইসলাম জানান, উপজেলার অন্তত সাতটি স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙেছে। এতে ১৪টি গ্রাম পানির নিচে চলে গেছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে দেড় শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের জন্য শুকনো খাবার ও রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বুধবার (৯ জুলাই) উপজেলার সব উচ্চ মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, ফুলগাজী ও পরশুরামে ১৩১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ৩৮০টি পরিবারের প্রায় ১ হাজার ৫৩২ জন মানুষ ইতোমধ্যে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। দুর্গতদের জন্য সাড়ে ১৭ লাখ টাকার খাদ্য সহায়তা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
বন্যা দুর্গতদের পাশে জেলা প্রশাসন
জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা করা হয়েছে। ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, সোনাগাজী, দাগনভূঞা ও ফেনী সদর উপজেলায় ত্রাণকার্য (নগদ) ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা উপ-বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। উপজেলায় ত্রাণকার্যক্রম (চাল) ১২০ টন উপ-বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় ৪০০ প্যাকেট শুকনা ও অন্যান্য খাবার উপ-বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
ফুলগাজী, পরশুরাম ও ফেনী সদর উপজেলায় যথাক্রমে ১৫৩টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় গ্রহণকারীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। জেলা ও উপজেলায় ২ হাজার ৫৪৭ জন দক্ষ স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে।
জেলার সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ, মাদরাসার প্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র (কম্পিউটার,ল্যাপটপ,প্রিন্টার) এবং প্রয়োজনীয় নথি যথাযথভাবে সংরক্ষণের ও নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে আগস্টে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ফেনীতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এতে ২৯ জনের প্রাণহানি হয়। পানিবন্দি ছিলেন ১০ লাখের বেশি মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সড়ক যোগাযোগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যানবাহন, ঘরবাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ প্রায় সব খাত। সেই বন্যায় প্রায় ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ২০ লাখ ৫০০ টাকার ক্ষতি হয়েছিল।