চুনিয়াগাড়ির বেহাল তিন সড়কে থমকে আছে সম্ভাবনা


নওগাঁ সদর উপজেলার অন্যতম বৃহৎ গ্রাম চুনিয়াগাড়ি। চারপাশে ধানখেত, পুকুর আর শান্ত গ্রামীণ জীবনের ছবি; তবে গ্রামে ঢুকতেই বদলে যায় চিত্র। রাস্তা যেন ধানের জমি! খানাখন্দে ভরা কাদাপথ পেরিয়ে চলতে হয় শিক্ষার্থী, কৃষক, রোগী আর দিনমজুরদের।
চুনিয়াগাড়ির বাসিন্দাদের এখন শুধু একটাই দাবি— ‘রাস্তা চাই’। কারণ এই তিনটি ভাঙাচোরা গ্রামীণ সড়ক যেন তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এক অদৃশ্য বাধার দেওয়াল তুলে দিয়েছে।
চলাচলে সীমাহীন দুর্ভোগ
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নওগাঁ সদর উপজেলার ৯ নম্বর চণ্ডিপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত চুনিয়াগাড়ি গ্রামটি কয়েকটি অংশে বিভক্ত। গ্রামের ছোট চুনিয়াগাড়ি থেকে বড় চুনিয়াগাড়ি যাওয়ার প্রায় এক কিলোমিটার পর্যন্ত মাটির রাস্তা। যে রাস্তা দিয়ে শুষ্ক মৌসুমে কোনোমতে চলাচল করা গেলেও বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই রাস্তার খানাখন্দ ভরে যায় বৃষ্টির পানিতে। তখন দেখে বোঝার উপায় থাকে না—এটি রাস্তা নাকি ফসলের জমি।
আবার গ্রামের বটতলি থেকে বিশ্ববাঁধ পর্যন্ত আরেকটি আধা কিলোমিটার সড়কেরও বেহাল দশা। এই সড়কে ইট বিছানো থাকলেও বহু বছর মেরামত কিংবা সংস্কার না করার কারণে সড়কের একাধিক জায়গায় ইট উঠে গিয়ে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে রাস্তা দিয়ে ছোট ছোট গ্রামীণ যানবাহন চলাচলের ঝক্কি পোহানো নো লাগেই, অনেকসময় গাড়ি উল্টে স্থানীয়দের আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।
এ ছাড়া, গ্রামের তালতলি থেকে বিশ্ববাঁধ সড়কের প্রায় আধা কিলোমিটার অংশের অবস্থাও বেহাল। বর্ষার সময় এই সড়ক দিয়ে বাইরের কেউ চলাচল করতে চান না। কিন্তু গ্রামের বাসিন্দাদের সেই সুযোগ নেই। দুর্ভোগকে সঙ্গী করেই প্রতিনিয়ত কষ্ট করেই গলার কাঁটা এই তিনটি গ্রামীণ সড়ক দিয়ে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
প্রভাবিত হচ্ছে গ্রামের শিক্ষাব্যবস্থা
চুনিয়াগাড়ি গ্রামের তালতলি-বিশ্ববাঁধ সড়কের বেহাল দশার কারণে বর্ষা মৌসুমের পুরোটাজুড়েই ভয়ে শিক্ষার্থীরা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই যায় না। এমনকি গ্রামের তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো শিক্ষক যোগদান করলেও দুর্গম পরিস্থিতির কারণে তারা অন্যত্র চলে যাওয়ার তোড়জোড় করেন।
ছোট চুনিয়াগাড়ি থেকে বড় চুনিয়াগাড়ি যাওয়ার সড়কটির করুণ অবস্থার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলাচলের সময় রাস্তার গর্তের পানিতে পড়ে গিয়ে ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের কাদায় লুটোপুটি খেতে হয় বলে জানান অভিভাবকরা।
অর্থনৈতিক উন্নয়নেও বড় বাধা
চুনিয়াগাড়ির কৃষকরা ফসল ফলাতে পিছিয়ে নেই, কিন্তু তা বাজারে পৌঁছানো বিরাট এক ঝক্কির ব্যাপার।
সড়কের বেহাল দশার কারণে ছোট ছোট গ্রামীণ বাহনগুলো গ্রামে যেতে চায় না। ফলে এই গ্রামের কৃষক থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষদের উৎপাদিত কৃষি পণ্য স্থানীয় পর্যায়ে কম দামে বিক্রি করতে হয়।
আরও পড়ুন: জামালগঞ্জে পরিত্যক্ত সেতু দিয়ে ঝুঁকিতে চলাচল, দুর্ভোগে ৩৫ গ্রামের মানুষ
সরেজমিনে দেখা যায়, বটতলী থেকে বিশ্ববাঁধ পর্যন্ত আধা কিলোমিটার রাস্তায় বিছানো ইট অনেক আগেই উঠে গেছে; তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। এতে করে পোল্ট্রি খামারিদের মুরগি পরিবহন কিংবা কৃষকের ধান বিক্রি—সবকিছুতেই যুক্ত হয়েছে লোকসানের ঝুঁকি।
ক্ষোভের শেষ নেই গ্রামবাসীর
চুনিয়াগাড়ি গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মতিন ও ফায়জুল বারি বলেন, পুরো চুনিয়াগাড়ি গ্রামে স্থায়ীভাবে অন্তত পাঁচ হাজার মানুষের বসবাস। প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর যোগাযোগ-ব্যবস্থাকে উন্নয়ন-বঞ্চিত করে পুরো দেশের আধুনিকায়ন করা কখনোই সম্ভব নয়। আগে গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করতে হবে, তবেই দেশের চালিকাশক্তি কৃষকরা আধুনিক হবে। আর কৃষকরা আধুনিক মানেই বাংলাদেশ আধুনিক। তাই চুনিয়াগাড়ি গ্রামের মতো দেশের যতগুলো গ্রামের গ্রামীণ সড়ক বেহাল রয়েছে, সেগুলোর উন্নয়ন করতে হবে, তবেই দেশের কাঙ্ক্ষিত সার্বিক উন্নয়ন হওয়া সম্ভব।
গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষক আলমগীর বাবু বলেন, ‘গ্রামের যোগাযোগ-ব্যবস্থার এমন বেহাল দশার কারণে প্রতিনিয়তই আমরা উন্নয়নের দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছি। ভালো পরিবার থেকে ছেলেমেয়েদের বিয়ের সম্বন্ধও আসে না। গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলাচলের রাস্তা খুবই খারাপ হওয়ার কারণে অভিভাবকরা সন্তানদের শিক্ষাদানে আগ্রহ হারাচ্ছেন। ফলে বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় প্রতিনিয়তই কমছে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা।’
তিনি বলেন, ‘গ্রামটি কৃষিপ্রধান হওয়ার কারণে কৃষকরা কষ্ট করে ফসল উৎপাদন করলেও রাস্তা খারাপ হওয়ার কারণে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন বছরের পর বছর।’
আরেক বাসিন্দা ময়েন উদ্দিন বলেন, বিগত সরকারের সময়ে গ্রামের এই রাস্তাগুলোর বিন্দুমাত্র উন্নয়ন করা হয়নি। বছরের পর বছর স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার ও স্থানীয় নেতারা সরকারের বরাদ্দের হরিলুট করেছেন। তাই বৃহৎ এই গ্রামের জনগোষ্ঠীর জীবনমানের কথা চিন্তা করে দ্রুত তিনটি রাস্তার উন্নয়ন করতে সরকারের একান্ত সুদৃষ্টি কামনা করছি।
প্রশাসনের আশ্বাস
নওগাঁ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইবনুল আবেদীন বলেন, ‘গ্রামীণ জীবনমানে সার্বিক পরিবর্তন আনতে হলে গ্রামের চলাচলের রাস্তার আধুনিকায়নের কোনো বিকল্প নেই। আমরা চুনিয়াগাড়ির রাস্তাগুলোর বর্তমান অবস্থা পরিদর্শন করে দ্রুত আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেব।’